৮ জানুয়ারি ২০২৪, সোমবার, ১১:১০

প্রহসনের নির্বাচন বাতিল ও কেয়ারটেকার সরকারের অধিনে নির্বাচনের নতুন তারিখ ঘোষণার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন

প্রহসনের নির্বাচন বাতিল ও অবিলম্বে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনের নতুন তারিখ ঘোষণার দাবিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ৮ জানুয়ারি দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি এ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ-এর সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোঃ তাহের, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর জনাব নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের ভারপ্রাপ্ত আমীর জনাব আবদুর রহমান মুসা প্রমুখ।

দেশবাসীর উদ্দেশে ভারপ্রাপ্ত আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের প্রদত্ত বক্তব্য নিচে তুলে ধরা হলোঃ-
“নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রাসুলিহিল কারীম, আম্মাবাদ।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ ও সংগ্রামী দেশবাসী,

আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

বাংলাদেশের রাজনীতির এক ক্রান্তিকালে আমরা আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। বাংলাদেশে আজ জনগণের ন্যায্য ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই চলছে। গণতন্ত্র হত্যাকারী বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার গত ১৫ বছর যাবত অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে আছে। তারা ক্ষমতা প্রলম্বিত করার লক্ষ্যে এবারো ৭ জানুয়ারি প্রহসনের নির্বাচনের আয়োজন করে। আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন দ্বারা একটি সাজানো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। জামায়াতে ইসলামীসহ প্রায় সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল ঘোষিত তফসিল প্রত্যাখ্যান করে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করতে থাকে। সরকার বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম নির্যাতন চালিয়ে ৭ জানুয়ারি প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা নবায়নের ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রহসনের নির্বাচন বর্জন করে ও ভোটদান থেকে বিরত থাকে। সরকারের হুমকি-ধমকি অগ্রাহ্য করে জনগণের এই সাহসি ও দৃঢ় সিদ্ধান্তে আমি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দেশবাসীকে আন্তরিক মোবারকবাদ ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। জনগণের এ ভূমিকা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশের জনগণ সামষ্টিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে কখনো ভুল করেনি। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলনে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং আন্দোলন সফল করে তুলেছিল। বাংলাদেশে চলছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। গণতান্ত্রিক বিশ্ব ও প্রতিষ্ঠানসমূহ বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে। দেশের জনগণ নিজেদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা ও কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করে যাচ্ছে। সরকার জনমতকে অগ্রাহ্য করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য নীল-নকশা প্রণয়ন করে। তারা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রহসনের নির্বাচন সফল করে তোলার লক্ষ্যে নিজেদের দলীয় লোকদের স্বতন্ত্র, ডামি ও বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে এবং জনগণকে ভয় দেখিয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধ্য করার মাধ্যমে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর অপকৌশল গ্রহণ করে। সেই সাথে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করা হয়। ২৮ অক্টোবর থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলের ৩৫ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয় এবং মাত্র ২ মাসের মধ্যে ৬২টি মামলায় ১৬ শতাধিক নেতাকর্মীকে সাজানো ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় ফরমায়েসি রায়ের মাধ্যমে সাজা প্রদান করা হয়। সরকারের পরিকল্পনা ছিল জনগণকে দমিয়ে রেখে জাল ভোট প্রদান করে এবং দলীয় লোকদের দ্বারা ভোটকেন্দ্রে ভীড় জমিয়ে ভোটার উপস্থিতির মহানাটক মঞ্চস্থ করা। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ সাহসিকতা ও দৃঢ়তার সাথে সরকারের হুমকি-ধমকি অগ্রাহ্য করে ৭ জানুয়ারির প্রহসনের ভোট বর্জন করে সরকারের সকল ষড়যন্ত্র বানচাল করে দিয়েছে। জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত এই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,

আমরা বারবার বলে আসছি যে, কেয়ারটেকার সরকার ব্যতীত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে দেশের জনগণ ভোট দিতে যায়নি। ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদন্ধিতায় দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী জাতির সামনে ওয়াদা করেছিলেন, ‘এটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন, শীঘ্রই আরেকটি নির্বাচন হবে’। কিন্তু তিনি তার ওয়াদা রক্ষা করেননি। ২০১৮ সালেও তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ তার কথায় আস্থা রেখে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র শক্তি ব্যবহার করে ভোটের আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখে এবং দিনের বেলায় ভোটের নামে প্রহসন করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জাতীয় সংসদ, সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদসহ কোনো নির্বাচনই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ১৮ মাস পূর্ব থেকে কেয়ারটেকার সরকার গঠন করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে জাতির সামনে বক্তব্য তুলে ধরা হয়। প্রায় সকল বিরোধী দল নির্বাচনে কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়। কিন্তু সরকার পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বিরোধীদলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে প্রহসনের নির্বাচনের আয়োজন করে। জনগণ প্রহসনের এই নির্বাচন বর্জন করার মাধ্যমে মূলত কেয়ারটেকার সরকারের প্রতি তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছে।

প্রিয় দেশবাসী,

নির্বাচনের নামে যে প্রহসন ৭ জানুয়ারি করা হলো, তা আপনারা স্বচক্ষে দেখেছেন। নিম্নে তার কয়েকটি খন্ডচিত্র তুলে ধরা হলঃ-

১। সকাল ১১টা পর্যন্ত দলীয় দু/এক জন লোক ব্যতীত ভোট কেন্দ্রে কাউকে দেখা যায়নি।
২। ৭ বছরের শিশুদের দিয়ে ভোট দেয়ার মত ঘটনা ঘটেছে।
৩। বহু কেন্দ্রে আনসার সদস্যদের ভোট দিতে দেখা গেছে।
৪। অনেক আসনে ভোট গণনার আগেই রেজাল্ট সিট প্রস্তুত করা হয়েছে।
৫। ভোট কেন্দ্রে টাকা দিয়ে ভাড়াটে এনে লাইনে দাঁড় করানো হয়েছে এবং টাকা লেনদেনের দৃশ্য গণমাধ্যমের ক্যামারায় ধরা পড়েছে।
৬। ভোটার উপস্থিতি না থাকায় শাসক দলীয় লোকেরা নির্বিঘ্নে গণহারে জাল ভোট প্রদান করেছে।
৭। ভোট প্রদানের বুথের বাইরে প্রকাশ্য জনসম্মুখে সিল মারার ঘটনা দেখা গেছে।
৮। ভোটের ফলাফল ঘোষণার সময় নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হচ্ছে ২৮% ভোট কাস্ট হয়েছে, পেছনের দিক থেকে বলা হচ্ছে ৪০% ভোট কাস্ট হয়েছে। এ দৃশ্য বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখা গিয়েছে।
৯। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘ভোটার উপস্থিতির হার খুব কম দেখেছি। দু/একজন পর্যবেক্ষক বলেছেন, আমরা এখানে কোনো গণতন্ত্র দেখিনি।’
১০। বাংলাদেশের প্রহসনের নির্বাচন সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ভোটারের সংখ্যা খুব কম ছিল। ভোট পড়ার হার নিম্ন। দমন-পীড়ন-বর্জনে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের নির্বাচন। ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা কম।’

প্রিয় দেশবাসী,

এই নির্বাচনে জনগণের ৩ হাজার কোটি টাকা নষ্ট করা ছাড়া জনগণের কোনো কল্যাণ হয়নি। এটি কোনো নির্বাচনই নয়। যেহেতু জনগণ এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, সুতরাং এই সরকারের ক্ষমতায় থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। আমরা দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে প্রহসনের নির্বাচন বাতিল করে অবিলম্বে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আহ্বান জানাচ্ছি। দেশের জনগণ নির্বাচন বর্জন করে ও ভোটদান থেকে বিরত থেকে যে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সরকার জনগণের দাবি মেনে নিয়ে শুভ বুদ্ধির পরিচয় দিবেন বলে আমরা আশা করি।

জনগণের ন্যায্য ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে যেসব কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে, তা শান্তিপূর্ণভাবে সফল করে তোলার জন্য আমি সংগ্রামী দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।”