গত ১৩ জুন অনির্বাচিত সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব আ.হ.ম মুস্তফা কামাল অনির্বাচিত জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরের জন্য ৫ লক্ষ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার যে মোটা অংকের উচ্চাকাংখী অবাস্তব বাজেট পেশ করেছেন সে সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর জনাব মকবুল আহমাদ আজ ১৪ জুন এক বিবৃতিতে বলেন, “গত ১৩ জুন অনির্বাচিত সরকারের অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামাল অনির্বাচিত জাতীয় সংসদে ৫ লক্ষ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার মোটা অংকের যে, উচ্চাকাংখী অবাস্তব বাজেট প্রস্তাব পেশ করেছেন তা সরকারের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না বলেই দেশের অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন। বছর শেষে গিয়ে অন্যান্য বছরের মত এবারের বাজেটও সংশোধন ও কাট-ছাট করা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না।
সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটে এডিপির লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ২ লক্ষ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লক্ষ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা, বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৫ হাজার ৩৯০কোটি টাকা, দেশীয় উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা, বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। সরকারের ঋণের সুদ পরিশোধ করতে লাগবে ৫৭ হাজার ৭০ কোটি টাকা এবং পূর্বের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে লাগবে ১১ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটের গোটা অর্থের এক তৃতীয়াংশই ঋণ নির্ভর।
বাজেট ঘোষণার পূর্বেই বাংলাদেশের বকেয়া মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লক্ষ ৮১ হাজারা ৫৬৮ কোটি টাকা। বর্তমানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাথা পিছু ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজার ৫শত টাকা। অর্থাৎ আজ যে শিশুটি জন্ম নিয়েছে সে ৬৭ হাজার ৫শত টাকার ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েই জন্ম গ্রহণ করেছে। গত বছর ঋণের সুদ পরিশোধের লক্ষ্য মাত্রা ছিল ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। কিন্তু তার পরিবর্তে ১ হাজার ৯ শত ৩ কোটি টাকা ঋণের সুদ বাবদ পরিশোধ করেছে। এবারও ঋণের সুদ পরিশোধের লক্ষ্যমাত্রা সরকার অর্জন করতে সক্ষম হবে বলে মনে হয় না।
সরকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৩ লক্ষ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এ লক্ষ্য মাত্রা অর্জন করতে পারবে না বলেই অর্থনীতিবিদগণের ধারনা। ঘুষ ও দুর্নীতির কারণেই সরকার এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবেনা। সরকারের বাজেট বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা হলো সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি। এ সমস্যাগুলো ব্যবসা, বাণিজ্য ও দেশী-বিদেশী অর্থ নিয়োগের পথে প্রধান বাধা, যে কারণে দেশে আশানুরুপ বিনিয়োগ হচ্ছে না। সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৮.২% এবং গত বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭.৮৬% , সেটা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। সরকার নানা ধরনের গোজামিলের আশ্রয় নিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দাবী করলেও অর্থনীতিবিদগণ তা মানতে রাজি নয়।
বিগত ৪৮ বছরের মধ্যে বর্তমানে দেশের অর্থনীতি সবচাইতে নাজুক অবস্থায় পড়েছে। দেশে বর্তমানে খেলাপী ঋণের পাহাড় গড়ে উঠেছে। গত মার্চ পর্যন্ত খেলাপী ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ১০ হাজার ৮শত ৭৪ কোটি টাকা। গত তিন মাসে খেলাপী ঋণ বেড়েছে আরো ১৭ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছরই খেলাপী ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।
দেশের অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত হলো সরকারী-বেসরকারী ব্যাংকগুলোতে সরকারী দলের লোকদের ব্যাপক লুটপাট, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎ। দেশের ব্যাংকিং খাত ও শেয়ার বাজার বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দেশের বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে কর্মক্ষম বেকার লোকদের কর্মসংস্থানের কোন সুনির্দ্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। বর্তমানে দেশে স্মাতক ডিগ্রীধারী ৪৭% ভাগ যুবক-যুবতি এবং ৩১% ভাগ নারী ডাক্তার ও প্রকৌশলী বেকার। বিশ্বের সবচাইতে অধিক বেকার জনসংখ্যা অধ্যুসিত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। দেশে ২ কেটির অধিক কর্মক্ষম বেকার রয়েছে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় ৩০ সালের মধ্যে দেশে ৩ কোটি বেকার লোকদের কর্মসংস্থানের পরিকল্পনার যে হাস্যকর বক্তব্য দিয়েছেন তা বেকার লোকদের সাথে তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।
বর্তমানে দেশে ৪ কোটি লোক দরিদ্র সীমার নীচে বসবাস করছে। অতি দরিদ্র সীমার মধ্যে আছে ২ কোটি মানুষ। দেশের ২ কোটি ৫০ লক্ষ লোক পুষ্ঠিহীনতায় ভুগছে। অথচ বাজেটে দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র লোকদের জন্য কোন সুখবর নেই। তাদের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর এবং ৪ স্তরের ভ্যাটের বোঝা আরো বাড়বে। ধনীদের সারচার্জে বড় ধরনের ছাড় দিয়ে তাদের তুষ্ট করা হয়েছে। ধনীদের সম্পদ কর বা সারচার্জের সীমা ২ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এবারের বাজেটে আয়কর মুক্ত আয়ের সীমা বিগত তিন বছরের মতই ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা রাখা হয়েছে। অথচ বাস্তবতার নীরিখে তা হওয়া উচিত ছিল কমপক্ষে ৫ লক্ষ টাকা।
বাজেটে শিশু খাদ্য তরল ও গুড়া দুধ, সব ধরনের চিনি, গ্লুকোজ, মধু, অলিভওয়েল, ভোজ্য তেল, বৈদ্যুতিক মিটার, ফ্লাক্স, গ্লাস, প্লেট, চুলা, এ্যালুমিনিয়ামের হাড়ি-পাতিল, স্মার্ট ফোন, ভোজ্য তেল ও মোবাইল ফোনে কথা বলা ইন্টারনেট ইত্যাদির দাম বাড়ানো হয়েছে। এ প্রস্তাব গরীব মানুষের স্বার্থের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অপর দিকে মটর সাইকেল, স্বর্ণ, এসি, ফ্রিজের দাম কমানো হয়েছে। যা ধনী লোকদের জন্য সহায়ক হবে।
অপ্রদর্শিত কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা চালু রেখে দুর্নীতিকেই উৎসাহিত করা হয়েছে। সঞ্চয় পত্রের মুনাফার উপর কর দ্বিগুণ করা হয়েছে। সব ধরনের রপ্তানী কর চারগুণ করা হয়েছে। এতে রপ্তানী নির্ভর শিল্প বিশেষ করে পোষাক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকার দেশী শিল্পের সুরক্ষার কথা বললেও সরকারের এ সিদ্ধান্ত পোশাক শিল্পসহ দেশীয় শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারী কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বেতন ভাতা, ভর্তুকী, সুদ, পেনশন ইত্যাদি অনুউন্নয়ন খাতে গোটা বাজেটের ৫৯. ৫% শতাংশ ব্যয় ধরা হয়েছে। অপর পক্ষে উন্নয়ন খাতের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০.৫ শতাংশ। এ থেকে বুঝা যায় সরকার উন্নয়নের ফাঁকা বুলি আওরিয়ে সরকারী আমলা-কর্মচারীদের তোষামোদ করে ক্ষমতায় থাকার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। সরকার দেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড কৃষিখাতের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ রেখেছে ৫.৪% ভাগ। দেশের কৃষকগণ তাদের উৎপাদিত ধান, চাল, পাট ও ইক্ষুর ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। তারা যাতে তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান সে জন্য বাজেটে কৃষিখাতে বরাদ্দ আরো অন্তত: ৫% ভাগ বাড়িয়ে ভর্তূকি দিয়ে হলেও তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য দেয়া উচিত।
শিক্ষাখাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৬.৭৫% ভাগ। শিক্ষাকে কর্মমুখী করার জন্য শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরো বাড়িয়ে ২০%ভাগ করা উচিত।
প্রধানমন্ত্রী ১২ জুন জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘ঘুষ, খাবনা, কাউকে ঘুষ খেতেও দিব না’। অথচ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য সরকার নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত সবাইকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুষ দিয়ে এবং নির্বাচনের পরে সরকারী অর্থে তাদের জন্য ভুরি-ভোজের ব্যবস্থা করে তাদের সন্তুুষ্ট করেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে ঘুষ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোন কথাই নেই। তাই প্রধানমন্ত্রীর মুখে ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ফাঁকা ভুলি মানায় না।
বর্তমান জাতীয় সংসদ জনগণের নির্বাচিত নয়। এ সংসদ দেশের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। এ অনির্বাচিত সংসদের কোন মূল্য জনগণের নিকট নেই। অনির্বাচিত সরকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না বলেই তারা জনকল্যাণকামী বাজেট পেশ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
তাই দেশের রাজনৈতিক দল, জোট, সুশীল সমাজ ও অর্থনীতিবিদগণের বাজেট পর্যালোচনা আমলে নিয়ে প্রস্তাবিত বাজেট সংশোধন করে জনকল্যাণমুখী করার জন্য আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”