১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, বুধবার, ৯:৪৬

সাংসদের এপিএস কামরুজ্জামান গ্রেপ্তার: বিরোধ আধিপত্য ও ভাগাভাগি নিয়ে

সাংসদ গাজী গোলাম দস্তগীরের পুরানা পল্টনের কার্যালয়ে রূপগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের নেতা মোশাররফ হোসেনকে গুলি করার নেপথ্যে ছিল স্থানীয় আধিপত্য বিস্তার ও ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধের জের। মামলার এজাহার, পুলিশের বক্তব্য এবং আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
তবে সাংসদ গাজী গোলাম দস্তগীর প্রথম আলোকে বলেছেন, গুলি বর্ষণকারী মাসুদ রানা ওরফে আশিক রূপগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান সজীবের লোক। সাংসদকে জড়াতে তাঁর কার্যালয়ে তারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এদিকে ছাত্রলীগ নেতা হাফিজুর রহমানের দাবি, যারা ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা সাংসদেরই লোক। তাই সাংসদ এর দায় এড়াতে পারেন না।
পুলিশ এরই মধ্যে মামলার এজাহারভুক্ত আসামি সাংসদ দস্তগীরের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) কামরুজ্জামান হীরাকে গ্রেপ্তার করেছে। গুলিবর্ষণকারী ছাত্রলীগ নেতা মাসুদ রানাকে ধরতে অভিযান চলছে।
তবে রূপগঞ্জের স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা বলছেন, এলাকায় জমিজমা নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের বিরোধ এখন তুঙ্গে। পাল্টাপাল্টি মামলা চলছে সমানে। গত সোমবার পল্টন থানায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে একটি মামলা করেছেন আহত উপজেলা ছাত্রলীগের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মোশাররফ হোসেনের দুলাভাই (ভগ্নিপতি) রুহুল আমিন। মামলায় বলা হয়, আধিপত্য বিস্তার, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও পূর্বশত্রুতার জের ধরে মোশাররফকে গুলি করেন মাসুদ রানা। এর নির্দেশদাতা হলেন সাংসদের এপিএস কামরুজ্জামান। এ ছাড়া ঘটনার ইন্ধনদাতা ও প্ররোচনা দানকারী হিসেবে আরও কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলায় ঘটনার বিবরণ দিয়ে উল্লেখ করা হয়, কয়েক দিন আগে মোশাররফের সহযোগীদের সঙ্গে মাসুদ রানা ও তাঁর সহযোগীদের বিরোধ হয়। এ ঘটনার মীমাংসার জন্য কামরুজ্জামান তাঁদের ডেকে পাঠান। সোমবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে অন্য তিনজন স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতার সঙ্গে পল্টনে আসেন মোশাররফ। সেখানেই মাসুদ রানাসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও দুজন প্রথমে মোশাররফকে থাপ্পড় মারেন। পরে মাসুদ রানা মোশাররফের পেটে গুলি করে পালিয়ে যান।
ঘটনা সম্পর্কে সাংসদ গাজী গোলাম দস্তগীর গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, সেখানে কীভাবে ঘটনাটি ঘটেছে, তা স্পষ্টভাবে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে। তিনটি ছেলে এসে অফিসে ঢুকে গুলি করে চলে গেছে। সেখানে কোনো কথা-কাটাকাটি হয়নি।
কী কারণে তাঁর কার্যালয়েই এ ঘটনা ঘটানো হলো জানতে চাইলে সাংসদ বলেন, রূপগঞ্জে তিনি যে ‘ভূমিদস্যুবিরোধী’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেটা দমাতেই তাঁর কার্যালয়ে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে মোশাররফের সঙ্গে মাসুদ রানা ও ছাত্রলীগের নেতা সজীবের বিরোধ হয়। এর জের ধরেই মোশাররফকে গুলি করা হয়েছে।
এই মামলার আসামি কামরুজ্জামান হীরা তাঁর ব্যক্তিগত কর্মী কি না জানতে চাইলে সাংসদ বলেন, ‘ওকে কেন এ মামলায় জড়ানো হলো, সেটা বুঝলাম না। ও আমার স্টাফ, এপিএস।’
মোশাররফ আহত হওয়ার পরও সাংসদকে ফাঁসানোর চেষ্টার কথা উল্লেখ করে সাংসদ বলেন, ‘ঘটনার রাতে হাসপাতালে দু-তিন শ লোক গুলিবিদ্ধ মোশাররফকে ঘিরে ফেলে। তারা কাউকে পাশে ঘেঁষতে দিচ্ছিল না। আমি ভাবলাম এতে রোগীর ক্ষতি হতে পারে। পরে তারাই আবার মামলা সাজাবে। তখন আমি পল্টন থানা-পুলিশকে বলে পাহারার ব্যবস্থা করি। এখন ডাক্তাররা বলেছেন মোশাররফ ঝুঁকিমুক্ত।’
আবার রূপগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান সজীব বলেন, ‘ওরা সবাই সাংসদেরই লোক। পত্রিকায় দেখলাম সাংসদের এপিএসও এর সঙ্গে যুক্ত। কাজেই সাংসদ দায় এড়াতে পারেন না।’
ভুলতা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সহসভাপতি মো. সবুজ ঘটনার সময় সাংসদের কার্যালয়ে ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গুলিবিদ্ধ মোশাররফসহ রূপগঞ্জ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের চার নেতা-কর্মীকে নিয়ে সোমবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তিনি পল্টনে সাংসদের কার্যালয়ে যান। সেখানে তাঁদের দুপুরের খাবার খেতে দেওয়া হয়। খাওয়া শেষে সবার আগে তিনি সাংসদের কার্যালয় কক্ষে ঢোকেন। একটু পরে মোশাররফ ঢোকার পরপরই তাঁকে পিঠে চাপড় মেরে বাইরে আসতে বলেন মাসুদ রানা। জবাবে মোশাররফ চড় মারেন মাসুদ রানাকে। তখনই পকেট থেকে পিস্তল বের করে মোশাররফকে গুলি করেন মাসুদ রানা।
সবুজ বলেন, ১০ ফেব্রুয়ারি বরুনা গ্রামে মোশাররফের সঙ্গে মাসুদ রানার প্রথম দফা তর্কাতর্কি হয়। সেখানে তাঁরা ভূমিদস্যুবিরোধী একটি কর্মসূচিতে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। ওই কর্মসূচি চলাকালে মোশাররফ রাস্তায় মাসুদ রানার গাড়ি থামান। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা হয়।
পুলিশের মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার শিবলি নোমান প্রথম আলোকে বলেন, দুজনের নাম উল্লেখ করে সোমবার রাতেই পল্টন থানায় একটি মামলা করেন গুলিবিদ্ধ মোশাররফের ভগ্নিপতি। সোমবারই পুলিশ এজাহারভুক্ত আসামি কামরুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করেছে। এজাহারভুক্ত প্রধান আসামি মাসুদ রানাকে ধরতে অভিযান চলছে। নারায়ণগঞ্জ পুলিশের সঙ্গে মিলে কাজ করছে পুলিশ।
কী কারণে এ ঘটনা ঘটেছে জানতে চাইলে শিবলি নোমান বলেন, স্থানীয় আধিপত্য বিস্তার ও ভাগাভাগির কিছু বিষয় রয়েছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দুই হাজারের বেশি মামলা করেছে সাংসদের অনুসারী একটি দল। ঢাকা শহর দ্রুতগতিতে রূপগঞ্জ এলাকায় বাড়ছে। এ কারণে এলাকার জমির দাম বাড়ছে। জমি কেনা, জমির ব্যবসা, জবরদখল ইত্যাদি নিয়েই ঘটছে বিবাদগুলো।
উল্লেখ্য, গত ২৬ মাসে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ ও সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন ১৮ জন। এর মধ্যে ২০১৫ সালেই প্রাণ হারান ৭ জন। ২০১৬ সালে ৮ জন। ১১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন ছাত্রলীগের কর্মী ইয়াসিন আরাফাত। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও বিবাদে জড়াচ্ছে সরকারি ওই ছাত্রসংগঠন।
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1081653/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%BE%E0%A6%A7-%E0%A6%86%E0%A6%A7%E0%A6%BF%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%93-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A6%BF-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87