১৭ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ৭:৫৮

সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের পরিকল্পনা নেই ইসির

দিকনির্দেশনাহীন রোডম্যাপ

আইনি কাঠামো সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করে না ইসি * কালো টাকা এবং পেশিশক্তি প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের কথা নেই * লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, দলগুলোর সভা-সমাবেশের অধিকার নিয়ে কিছু বলার নেই

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ইসি (নির্বাচন কমিশন) ঘোষিত রোডম্যাপে সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই। নির্বাচন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার ক্ষেত্রে ইসির ভূমিকা কি হবে- এ নিয়েও ধোঁয়াশা অবস্থা রয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন, শক্তিশালী, কার্যকর এবং অর্থবহ করার যে দাবি বিভিন্ন মহল থেকে করা হচ্ছে তা কার্যকরের বিষয়েও স্পষ্ট কোনো বক্তব্য নেই ইসির। কালো টাকা এবং পেশিশক্তি প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের বিষয়ে রোডম্যাপে কিছুই উল্লেখ নেই। নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা কি হবে- তা নিয়েও তেমন বক্তব্য নেই। দেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা ইসির রোডম্যাপ বিশ্লেষণ করে যুগান্তরকে এসব কথা বলেন।


তারা বলেন, রোডম্যাপে বলা হয়েছে, নির্বাচন পরিচালনায় বিদ্যমান আইনিবিধি প্রয়োগ করে অতীতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব হয়েছে। কাজেই এখন আইনি কাঠামোর আমূল সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে ইসি মনে করছে না। অধিকাংশ দলের অনাগ্রহ থাকলেও নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতির ব্যবহার নিয়ে ইসির প্রচ্ছন্ন আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে। এসব কারণে শুরুতেই ইসির প্রতি জনগণের মধ্যে সংশয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। এই ইসির অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ইসি রোডম্যাপ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। তারা হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিষয়ে এখানে তেমন কিছুই বলা হয়নি। তারা বলেন, দেশের অধিকাংশ জনগণ যে ধরনের নির্বাচন চায় সেই নির্বাচনের রোডই এখনও তৈরি হয়নি। তার আগেই ম্যাপ তৈরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ইসি।

জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন তাদের রোডম্যাপে অনেক কিছুই খোলাসা করে বলেনি। সব দলের অংশগ্রহণভিত্তিক নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি, রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ করার অধিকার, প্রভাবমুক্ত নির্বাচন প্রভৃতি ইস্যুতে তাদের রোডম্যাপে কোনো কথা নেই।’ তিনি বলেন, ‘সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে, নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবে। এই সহায়তা কেবল তফসিল ঘোষণার পরপরই করতে হবে- তা বলা নেই। তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচন কমিশন অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বাধাগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরতে পারে। এসব বাধা-বিপত্তি দূর করতে সরকারের সহায়তা চাইতে পারে নির্বাচন কমিশন।’

রোববার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে নির্বাচন কমিশন ভবনে এ রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়েই শুরু হল আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। এতে সাতটি করণীয় বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে। সেগুলো হল- আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার, নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও যুগোপযোগী করতে সংশ্লিষ্ট সবার পরামর্শ গ্রহণ, সংসদীয় এলাকা পুনর্নির্ধারণ, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং সরবরাহ, বিধিবিধান অনুসরণপূর্বক ভোট কেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ। নির্বাচন প্রস্তুতির অংশ হিসেবে রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের সঙ্গে সংলাপে বসার কথাও বলা হয়েছে রোডম্যাপে। তবে এতে সব দলের জন্য মাঠ সমান করাসহ অন্যান্য বিষয়ে নেই সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা।

এ প্রসঙ্গে ইসি কার্যালয়ের সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘রোডম্যাপে আগামী সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত ইসির কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। এ রোডম্যাপের নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ বাস্তবায়ন হবে।’

নির্বাচন কমিশন ঘোষিত এই রোডম্যাপ জাতিকে হতাশ করেছে বলে দাবি করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান। রোববার তিনি এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, ‘দেশবাসীর দাবি সব দলের অংশগ্রহণে একটি অংশগ্রহণমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তারা আরেকটি ৫ জানুয়ারি মার্কা নির্বাচন দেখতে চায় না। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন সব দলকে নিয়ে কিভাবে নির্বাচনের আয়োজন করবে কিংবা সব দলের নির্বাচনে আসার বিষয়টি কিভাবে নিশ্চিত করবে- সে বিষয়ে রোডম্যাপে স্পষ্টভাবে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। কিভাবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা হবে- সে বিষয়েও খোলাসা করেনি নির্বাচন কমিশন।’

তিনি বলেন, ‘এছাড়া ইসি কিভাবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে সে বিষয়েও কিছু বলেনি। নির্বাচনী বিধিবিধানের সংস্কার নিয়ে কথা বললেও এটি কিভাবে করা হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই।’ ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, ‘ইভিএম ব্যবহার নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। পৃথিবীর কোথাও এটি ব্যবহৃত হয় না। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলও ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে। এরপরও প্রচ্ছন্নভাবে ইসি ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে। তাহলে কার স্বার্থে নির্বাচন কমিশন এটি ব্যবহার করতে চাইছে? এ বিষয়টিও সবার কাছে একটি বড় প্রশ্ন।’ তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন যে সাতটি করণীয় বিষয়ের কথা বলেছে তা নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠুু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য করার জন্য যথেষ্ট নয়। তারা সংলাপে বসার কথা বলেছে, কিন্তু সংলাপে রাজনৈতিক দলসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা যেসব মতামত দেবে তার কতটুকু গ্রহণ করা হবে- এ নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। নির্বাচন কমিশন তাদের ক্ষমতায়ন নিয়েও কোনো কথা বলেনি, যা খুবই দুঃখজনক। অথচ দীর্ঘদিন ধরেই সব পক্ষের দাবি নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতায়ন। নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা কি হবে- তা নিয়েও কোনো কথা বলেনি তারা।

নির্বাচন কমিশন ঘোষিত রোডম্যাপে জন-আকাক্সক্ষা পূরণে রাজনৈতিক দলসহ ছয় ধরনের অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের গেজেট প্রকাশের সময় নির্দিষ্ট করে দেয়া, রাজধানীর মতো বড় শহরের আসন নির্দিষ্ট করে দেয়া, আরপিও সীমানা নির্ধারণ, অধ্যাদেশ বাংলায় রূপান্তরের প্রস্তাবও করা হয়েছে এই রোডম্যাপে। রোডম্যাপে নারী সংগঠনের নেত্রীদের সঙ্গে বসার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ৩১ জুলাই থেকে অক্টোবর নাগাদ এ সংলাপে পর্যায়ক্রমে নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন পর্যবেক্ষক, নারী সংগঠনের নেত্রী এবং নির্বাচন পরিচালনায় বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানো হবে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, ‘রোডম্যাপে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এখন অপেক্ষা করতে হবে, ওই সংলাপে যেসব পরামর্শ বা প্রস্তাব উঠে আসে, সেগুলোর মধ্যে গ্রহণযোগ্য প্রস্তাবগুলো কমিশন আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে কিনা? এছাড়া রোডম্যাপে অন্যান্য যেসব বিষয় রয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়নে কমিশন কতটুকু আন্তরিক তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’

রোডম্যাপে আরও বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত সময়ে সংসদ নির্বাচন করতে দৃঢ়তার সঙ্গে ও সুচিন্তিত পন্থায় এগিয়ে যাচ্ছে। দেশবাসী একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অপেক্ষায় রয়েছেন। সার্বিকভাবে দেশে জাতীয় নির্বাচনের একটি অনুকূল আবহ সৃষ্টি হয়েছে।’

কালো টাকা এবং পেশিশক্তি প্রভাবমুক্ত নির্বাচন কিভাবে অনুষ্ঠিত হবে সে বিষয়ে ইসির রোডম্যাপে কোনো কথা নেই দাবি করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা পুরো রোডম্যাপ পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মতামত জানাব।’

এ প্রসঙ্গে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘এই রোডম্যাপ একটি ফাঁকা বুলি। এখানে সব দলের অংশগ্রহণ কিভাবে নিশ্চিত করা হবে- তা বলা হয়নি। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কিভাবে নিশ্চিত করা হবে সে সম্পর্কেও কোনো কথা বলেনি ইসি। এসব বিষয়ে কথা না বলে তারা নতুন করে আবার কিছু কিছু জায়গায় আসন বিন্যাসের কথা বলেছে। এর প্রয়োজন কতটা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারও ইশারায় পছন্দের লোকের জয় নিশ্চিত করতে যদি আসন বিন্যাস করা হয় তাহলে এই নির্বাচন নিয়ে শুরুতেই প্রশ্ন উঠবে।’

তিনি আরও বলেন, ইসি সব সময় সংলাপের কথা বলে। অতীতে দেখা গেছে তারা নানান শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপে বসে। কিন্তু এসব সংলাপ থেকে উঠে আসা কোনো প্রস্তাবনাই তারা আমলে নেন না। আর যদি প্রস্তাবনা আমলেই নেয়া না হয়, তাহলে এই সংলাপে বসার কোনো অর্থ নেই।’

তবে এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের চেয়ারম্যান (জানিপপ) ড. নাজমুল আহসান কালিমুল্লাহ। যুগান্তরকে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন অনেক ভেবেচিন্তে এই রোডম্যাপ তৈরি করেছে। আশা করি তারা একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারবে।’

 

http://www.jugantor.com/first-page/2017/07/17/140275/