২৪ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১২:০৫

তিন হাজার শিল্প-কারখানার বর্জ্য সরাসরি পড়ছে ঢাকার পাশের চার নদীতে

শীতলক্ষ্যা নদীতে অহরহ শিল্পবর্জ্য ফেলা হচ্ছে

দিনের পর দিন দখল ও দূষণে কাহিলদশা রাজধানীর চারপাশের চার নদীর। প্রতিদিন হাজার হাজার ঘনমিটার শিল্পবর্জ্য সরাসরি পড়ছে এসব নদীতে। একদিকে চলে নদী দখল ও দূষণমুক্ত করার অভিযান অন্যদিকে আবার চলে দখল ও দূষণের মহোৎসব। এসব নদীর পানি ব্যবহার তো দূরের কথা রীতমতো বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। বিপজ্জনক মাত্রায় দূষিত হয়ে আছে এসব নদীর পানি। এতে করে ঢাকাও আশে পাশে বসবাসকারী প্রায় দেড়কোটি মানুষের জীবনযাত্রা পরিবেশগত হুমকিতে রয়েছে।
সূত্র জানায়, ঢাকার চারপাশের গুরুত্বপূর্ণ চারটি নদী অব্যাহতভাবে দখল ও দূষণের শিকার হচ্ছে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ প্রভাবশালীদের অবৈধ দখলে ছোট হয়ে গেছে। চার নদীর দখল ও দূষণমুক্ত করার কাজ চলছে ধীর গতিতে। নদীগুলো দখলমুক্ত করতে মাঝে মধ্যে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু অভিযান শেষ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। বর্জ্য ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার কারণে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। কলকারখানার রাসায়নিক দ্রব্য ও বর্জ্যে পানি দূষিত হয়ে বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছে গেছে।
সূত্র জানায়, বুড়িগঙ্গা নদীদূষণের দায়ে চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি ২৩টি কারখানাকে ৫২ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট উইং। দীর্ঘদিন ধরে নদীতে সরাসরি বর্জ্য ফেলে আসছিল রাজধানী ঢাকার সাঁতারকুল, বাড্ডা ও কেরানীগঞ্জে অবস্থিত এসব কারখানা।
শুধু এই ২৩ কারখানা নয়, ঢাকার চারপাশের নদীতে সরাসরি বর্জ্য ফেলছে প্রায় তিন হাজার শিল্প-কারখানা। নদীদূষণের দায়ে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ২ হাজার ৮৯১টি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। বিভিন্ন সময় পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানে এসব প্রতিষ্ঠানকে ২৩৪ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। ধার্যকৃত জরিমানার মধ্যে গত এপ্রিল পর্যন্ত ১৪৭ কোটি টাকা আদায়ও করা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিমানার মুখে পড়া কারখানার মধ্যে তৈরি পোশাক কারখানা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে ওয়াশিং, ডায়িংসহ অন্যান্য শিল্প-কারখানাও। দীর্ঘদিন ধরে কেরানীগঞ্জ এলাকার বিভিন্ন ডায়িং ও ওয়াশিং কারখানা বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) নির্মাণ না করেই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইটিপি নির্মাণের জন্য বহুবার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও মালিকপক্ষ তাতে কর্ণপাত না করে ওয়াশিং ও ডায়িং কারখানার অপরিশোধিত তরল বর্জ্য সরাসরি বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলছে। এতে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে নদীর পানি। পরিবেশ অধিদপ্তরের ১৩ ফেব্রুয়ারির ওই অভিযানে ১১টি ওয়াশিং কারখানা সিলগালাসহ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এছাড়া ঢাকার সাঁতারকুল ও বাড্ডার আশরাফ ওয়াশিংকে ৬ লাখ এবং শাইনিং ওয়াশিংকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
তবে শুধু শিল্প-কারখানাগুলোকে জরিমানা করে নদীদূষণ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় বলে দাবী করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. খলিলুর রহমান বলেন, জরিমানা করে আসলে নদীদূষণ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, জরিমানা গুনে দূষণকারী সহজেই ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। যদি এর সঙ্গে আরো শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে এ ধরনের প্রবণতা কমতে শুরু করবে। নদীদূষণ প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি।
সূত্র জানায়, ঢাকার কেরানীগঞ্জে ছোট-বড় পাঁচ হাজারেরও বেশি গার্মেন্টস কারখানা আছে। এছাড়া রয়েছে ৮০টি ওয়াশিং কারখানা। ওয়াশিং মালিক সমিতির দেয়া তথ্য বলছে, এসব কারখানা থেকে প্রতিদিন ২০-২৪ লাখ লিটার তরল বর্জ্য সরাসরি অপরিশোধিত অবস্থায় পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। পাশেই শ্যামপুর শিল্প এলাকার ৫৯টি প্রিন্টিং অ্যান্ড নিট-ডায়িং কারখানা থেকে প্রতিদিন বের হয় ২৫ হাজার ৫৮২ ঘনমিটার অপরিশোধিত তরল বর্জ্য, যা সরাসরি পড়ছে নদীতে।
ট্যানারি শিল্পের দূষণ থেকে বুড়িগঙ্গা রক্ষায় হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানাগুলো নিয়ে যাওয়া হয়েছে সাভারের হেমায়েতপুরে। কিন্তু সেখানে গিয়েও নতুন করে ধলেশ্বরী নদীকে দূষিত করছে এ শিল্প। কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণ করা হলেও তা সঠিকভাবে বর্জ্য পরিশোধন করতে পারছে না। ইপিজেডে স্থাপন করা সিইটিপিগুলোরও একই অবস্থা। টঙ্গী এলাকায় থাকা ডায়িং ও ওয়াশিং কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য দূষিত করেছে তুরাগ নদকে। ওয়াশিং কারখানার বর্জ্য সরাসরি পরিবেশে ছাড়া হচ্ছে নরসিংদীতেও।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইটিপি না থাকায় ওয়াশিং কারখানার শতভাগ দূষিত বর্জ্য সরাসরি পরিবেশে গিয়ে মিশছে। আবার অনেক শিল্প-কারখানায় ইটিপি থাকলেও তা বন্ধ রেখেও বর্জ্য সরাসরি পানিতে ফেলছে কর্তৃপক্ষ। এতে দূষিত হচ্ছে কারখানার আশপাশের পরিবেশ।
জানা গেছে, নদীদূষণ রোধে নৌ-পরিবহনমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। টাস্কফোর্সটি নিয়মিত সভা আয়োজনসহ করণীয় বিষয় নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নে বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। শিল্পবর্জ্য হ্রাসের লক্ষ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে তরল বর্জ্য নির্গমনকারী সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে জিরো ডিসচার্জ পলিসি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করে তার সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান সম্প্রতি সংসদে জানিয়েছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যেই ঢাকার চারপাশের চার নদীর দূষণমুক্ত করতে কার্যক্রম শুরু করছে সরকার। এ লক্ষ্যে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের টেকনিক্যাল কমিটি কাজ করছে। কমিটি রিপোর্ট দিলেই দূষণমুক্ত করণের কার্যক্রম শুরু হবে।
মন্ত্রী বলেন, ঢাকার চারপাশে নদী দ্বারা বিস্তৃত। বিশ্বের কোথাও রাজধানী শহরে এ রকম নেই। কিন্তু দুভার্গ্য হলো- মানুষ দ্বারা এই নদী দূষণ সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকার চারপাশের এই চারটি নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষা ও বালু নদীর দূষণরোধে প্রধানমন্ত্রী একটি কমিটি করে দিয়েছেন।
মন্ত্রী বলেন, মূলত ট্যানারির বর্জ্য এবং শিল্প কলকারাখানা বর্জ্যের কারণে এই নদীগুলো দূষণ হয়েছে। ট্যানারির বর্জ্যে ৩০ ভাগ দূষণ হচ্ছে, ৬০ ভাগ হচ্ছে শিল্প বর্জ্যে। এই বর্জ্যে রোধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখনও পুরোপুরি স্থানান্তর হয়নি। ট্যানারি পুরোপুরি চলে গেলে ৩০ ভাগ দূষণ কমে যাবে।
তিনি বলেন, নদীগুলোর দূষণরোধে জনপ্রশাসনের মূখ্য সচিবকে কনভেনার করে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা একটি পরিকল্পনা তৈরি করছে কি করে এই নদীগুলেরা দূষণমুক্ত করা যায়। আশা করছি কমিটি এক মাসের মধ্যে একটা রিপোর্ট দেবে। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই আমরা পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করবো।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাছান মাহমুদ বলেন, যেকোনো মূল্যে দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হবে। দূষণকারী কোম্পানির বিরুদ্ধে ১ শতাংশ ইকোট্যাক্স আরোপের বিষয়ে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হবে।
পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত এক সেমিনারে বলেছেন, সবচেয়ে দূষিত নদী বুড়িগঙ্গা। এরপর তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা। রাজনৈতিক কৌশলে এসব নদী দখল করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পাশাপাশি কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে স্থায়ী সীমানা নির্ধারণ করা উচিত সরকারের। নদী দখল ও এর দূষণ প্রতিরোধে মন্ত্রণালয়গুলোও তাদের সঠিক দায়িত্ব পালন করছে না বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ডা.আব্দুল মতিন বলেন, শুধু ঢাকার চারপাশের চারটি নদ-নদী নয়, দেশের সব নদী আজ হুমকির মুখে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সভাপতি আবু নাসের খান বলেন, ঢাকার চারপাশের নদ-নদীগুলো রক্ষার স্বার্থে বহু আন্দোলন হয়েছে। তাতে কোনো কাজ হয়নি। আমরা সরকারকে সচেতন করতে পারি। পরামর্শ দিতে পারি, কিন্তু কাজ করার দায়িত্ব সরকারের।

http://www.dailysangram.com/post/293011-