১০ জুন ২০১৭, শনিবার, ৮:৪২

বাজেট এবং আওয়ামী কোটিপতি প্রসঙ্গ

|| আশিকুল হামিদ || খ্রিস্টান ও ইহুদী প্রধান পাশ্চাত্যের অধীনস্থ হয়ে পড়া বর্তমান পৃথিবীতে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন কতটা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তার উদাহরণ দেয়ার জন্য বিশেষ কিছু দিবসের উল্লেখ করাই যথেষ্ট। যেমন পাশ্চাত্যের উদ্যোগে বছরের একটি দিন ‘বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। মানুষ যাতে বিশেষ করে খাওয়ার আগে-পরে এবং টয়লেটে যাওয়ার পর ভালো করে হাত ধোয়- সেটা শেখানোই দিবসটির উদ্দেশ্য। পাশ্চাত্যের হুকুমে বাংলাদেশকেও হাত ধোয়া দিবস পালন করতে হয়। অথচ এমন দিবস ও উপদেশ বিশ্বের কোনো দেশের মুসলমানদের জন্যই প্রযোজ্য হতে পারে না। কারণ, মুসলমানরা এমনিতেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকেন। বিশেষ করে সালাত বা নামাজের আগে পাঁচবার অজু তো করেনই। সুতরাং পাশ্চাত্যের কাছ থেকে মুসলমানদের অন্তত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা শেখার কিছু নেই। তা সত্ত্বেও দিবসটি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ, পাশ্চাত্যের লোকজন এমনকি টয়লেটে যাওয়ার এবং বিশেষ প্রাকৃতিক কম্ম সারার পরও হাত ধোয় না। তারা টিস্যু ব্যবহার করে- সেটাও কিন্তু খুব বেশিদিন ধরে নয়! এসব কারণেই ভয়ংকর বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তারা। হাত ধোয়ার আড়ালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে পাশ্চাত্য আসলে শিক্ষা নিচ্ছে মুসলমানদের কাছ থেকে। কিন্তু সে কথাটা স্বীকার করতে লজ্জা লাগে বলেই হাত ধোয়া দিবসের মতো উপলক্ষের আড়াল নিয়েছে তারা। দিবসটি মুসলমানদের ওপরও চাপিয়ে দিয়েছে।
বিশ্ব ‘মা দিবস’ও অমন একটি উপলক্ষ, গত মাস মেতে যা অন্য দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষে হইচইও কম করা হয়নি। ‘মা দিবস’-এর নামে দেশে যখন তুমুল হইচই করা হচ্ছিল আমার কিন্তু তখন বারবার ঘুম পাড়ানো গানের কথা মনে পড়েছে। আমাদের মায়েরা শিশুদের ঘুম পাড়ানোর জন্য এখনো গুনগুন করে নানা ধরনের গান গেয়ে থাকেন। এসব গান শুনতে শুনতেই শিশুরা এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম পাড়ানো গানের কথাটা অবশ্য অকারণে মনে পড়েনি। বর্তমান পর্যায়ে আমার কাছে ‘মা’ হিসেবে এসেছে সরকার। শুনে পাঠকরা অবাক হতে পারেন। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখুন, ধর্ষণ ও ছিনতাই-ডাকাতি থেকে জিনিসপত্রের মূল্য পর্যন্ত শুধু নয়, সর্বশেষ মাত্র এক লাখ এক টাকার ওপর আবগারি শুল্ক চাপানো পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়েই সরকার ওই মায়েদের মতো জনগণকে কেবল ঘুম পাড়ানো গানই শুনিয়ে চলেছে। যেমন এই সময়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে সারাদেশে নিন্দা-সমালোচনার যে ঝড় বইছে তার সঙ্গে জড়িত রয়েছে মানুষের অর্থনৈতিক সঙ্গতির প্রশ্ন। কারণ, জিনিসপত্রের দাম শুধু বাড়ছেই। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের আয় বাড়া দূরে থাকুক, তাদের আয়-রোজগারের পথও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকার ব্যস্ত রয়েছে তার কল্পিত সাফল্য এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধ নিয়ে। অর্থমন্ত্রী এমনকি এক লাখ টাকার মালিককেও ‘যথেষ্ট সম্পদশালী’ বলে ঘোষণা দিয়ে বেড়াচ্ছেন! তারও আগে উপলক্ষ তৈরি করার জন্য আবুল মাল অবদুল মুহিত ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার এমন এক বিশাল আকারের বাজেট পেশ করেছেন, যার দু-চারটি মাত্র বিষয় শোনার ও বোঝার পরই মানুষের মাথায় রীতিমতো চক্কর লাগতে শুরু করেছে।
সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে জানানো দরকার, প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি দেখানো হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে যদি ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকাই ঘাটতি রাখা হয় তাহলে সে বাজেটের বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নিয়ে যদু-মধুদেরও কথা বলার অধিকার থাকাটা স্বাভাবিক। কথা কমবেশি বলাও হচ্ছে। কিন্তু যার উদ্দেশে বলা, সে অর্থমন্ত্রীর মধ্যে কিন্তু কোনো ভাবান্তরই লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তাকে বরং সাধারণ সময়ের মতো দৃশ্যপটে দেখা যাচ্ছে- যেমনটি দেখা গেছে বাজেট পেশ করার পর সব সময়। এবার অবশ্য কিছুটা ব্যতিক্রমও ঘটেছে। অন্যান্যবারের মতো মুহিত সাহেবকে খুব বেশি ‘অ্যাগ্রেসিভ’ বা মারমুখী মনে হয়নি। শেয়ারবাজারের লাখ-লাখ বিনিয়োগকারীকে ‘ধান্দাবাজ’ ও ‘কিছু লোক’ বলে তামাশা করার এবং একে-ওকে ‘রাবিশ’ বলার মাধ্যমে ঝামেলা পাকিয়ে আসা অর্থমন্ত্রীকে কথাবার্তায় যথেষ্ট সংযমীও মনে হয়েছে- যদিও অসত্য ও কাল্পনিক তথ্য-পরিসংখ্যান সম্পর্কে যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপনার কারণে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডিকে তিনি বার চার-পাঁচেক ‘রাবিশ’ বলেছেন। বিচ্ছিন্ন এই আক্রমণ সত্ত্বেও সাধারণভাবে বলা হচ্ছে, নির্বাচন সামনে বলেই নাকি মিস্টার মুহিতের মতো বেপরোয়া এবং কাউকে পাত্তা না দেয়া ব্যক্তিকেও এবার সংযম ও সতর্কতা দেখাতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে অন্য একটি তথ্যেরও উল্লেখ করা দরকার। আগে থেকে প্রচার করা হয়েছিল, যেহেতু নির্বাচনী বাজেট সেহেতু এবারের বাজেটে জনকল্যাণের এবং জনগণকে তুষ্ট বা খুশি করার বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হবে। অন্যদিকে অবস্থা কিন্তু যাহা ৫২ তাহা ৫৩-ই রয়ে গেছে। নিজে বিরাট বপুর মানুষ বলেই শেখ হাসিনার অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম থেকে মিস্টার মুহিত বিরাট বপুর সব বাজেট পেশ করে এসেছেন। এবারও করেছেন। এটা তার দশম বাজেট। কিন্তু একদিকে বাজেট বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নিয়ে যেমন কথা উঠেছে, তেমনি প্রাধান্যে এসেছে জনস্বার্থের দিকটিও। এজন্যই বাজেট নিয়ে আলোচনার আগে এর অশুভ প্রভাব সম্পর্কে যৎকিঞ্চিত বলা দরকার। দেখা যাচ্ছে, অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করারও অনেক আগে প্রায় সব ধরনের পণ্যেরই দাম বেড়ে গেছে। যে সব পণ্যের ওপর নতুন কর ধরা হয়েছে সেগুলোর তো বটেই, এমনকি যেগুলোর ওপর কর কমানোর প্রস্তাব করা হবে বলে প্রচারণা চালানো হয়েছিল সেগুলোরও দাম বেড়েছে। এ সম্পর্কিত উদাহরণ দেয়ার নিশ্চয়ই দরকার পড়ে না। আপত্তির কারণ হলো, অর্থমন্ত্রীর তথা সরকারের দায়িত্ব কেবল বাজেট পেশ করা নয়, বাজারও নিয়ন্ত্রণে রাখা। কিন্তু মুহিত সাহেবরা কেবল বাজেট পেশ করেই খালাস হয়ে যান। ওদিকে পকেটের সঙ্গে মানুষের যে গলাও কাটা হচ্ছে সেসব দিকে নজরই নেই তাদের। প্রসঙ্গক্রমে ব্যবসায়ীদের অসততা এবং মুনাফার জন্য অতি লোভের কথা আসতেই পারে, কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সবকিছুর জন্য দায়ী আসলে সরকার। সরকারই টাউট ব্যবসায়ীদের জন্য সুযোগের সৃষ্টি করে দেয়। এবারও দিয়েছে।
খুবই লক্ষণীয় বিষয় হলো, বাজেট বক্তৃতায় যথেষ্ট বাগাড়ম্বর করলেও অর্থমন্ত্রী কিন্তু মানুষের মনে আস্থা সৃষ্টি করতে পারেননি। না পারার প্রথম কারণ ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকার ঘাটতি। বস্তুত বিরাট বপুর বাজেটের মধ্যে ঘাটতির পরিমাণও বিরাটই। প্রথম ধাক্কাটাও খেতে হয়েছে এখানেই। কারণ, টাকার খবর নেই তবু মানুষকে স্বপ্ন দেখানোর কসরত করেছেন অর্থমন্ত্রী। প্রশ্ন উঠেছে, ঘাটতি পূরণের জন্য কল্পিত টাকা যদি যোগাড় না করা যায় তাহলে কিভাবে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেবে সরকার? টাকা যোগাড়ের সম্ভাব্য খাতগুলোও লক্ষ্য করার মতো। যেমন দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সরকারের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়াটা স্বাভাবিক হলেও মুহিত সাহেবরা সীমা তো ছাড়িয়েছেনই, রেকর্ডও করে ফেলেছেন। প্রায় সব অর্থবছরেই প্রাক্কলনের চাইতে অনেক বেশি পরিমাণ টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। এসব খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এতে জানা গেছে, কোনো কোনো অর্থবছরে ২৩ হাজার কোটি টাকার জন্য সরকারকে ঋণের সুদই গুনতে হয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে অবস্থা কেমন হতে পারে সে ব্যাপারে পাঠকরাও হিসাব কষে দেখতে পারেন।
এদিকে সরকার একাই ব্যাংক থেকে এত বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয়ার ফলে ব্যাংকগুলো তো বিপন্ন হচ্ছেই, দেশের অর্থনীতিও মারাত্মক বিপর্যয়ের কবলে পড়ছে। এটাই অবশ্য উদ্বেগের একমাত্র কারণ নয়। আসল কারণ আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সরকারের ভয়ংকর ব্যর্থতা। সরকারের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের পুঁজিবাজার থেকে অন্তত এক লক্ষ কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে। লোপাট করেছে ক্ষমতাসীনদেরই লোকজন। কিন্তু নামকা ওয়াস্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও কারো বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অর্থমন্ত্রী তো বরং জড়িতদের নামগুলোকে ‘ডিলিট’ করতে বা মুছে ফেলতে বলে চমকও সৃষ্টি করেছিলেন। ফলে এ অভিযোগই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সবকিছুর সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের যোগসাজশ ছিল। শেয়ারবাজার লুণ্ঠিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে দেশে নগদ অর্থের তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। সে কারণে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ পাননি বললেই চলে। ফলে নতুন বিনিয়োগ হয়নি, অনেকের পুরনো ব্যবসাও লাটে উঠেছে। ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফসহ দাতাগোষ্ঠীও সাহায্যের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
এমন এক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব যেখানে ছিল অর্থনীতির প্রতিটি খাতকে সচল করে তোলার চেষ্টা চালানো সরকার সেখানে নিজে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার মাধ্যমে উল্টো বাধার পাহাড় তৈরি করে বসেছে। সে অবস্থায় কিন্তু এখনো কোনো শুভ বা ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি। তেমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। কথা শুধু এটুকুই নয়। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে না পারলেও সরকার দফায় দফায় গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পেট্রোল, অকটেন ও সিএনজিসহ জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে। ক’দিন আগেই দ্বিতীয় দফায় বেড়েছে গ্যাসের দাম। এর ফলে উৎপাদন ব্যয় তো বটেই পরিবহন ব্যয়ও বেড়ে গেছে যথেষ্ট পরিমাণে। সব কিছুর জন্যই শেষ পর্যন্ত বাড়তি দাম গুনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বাজার নিয়ন্ত্রণে শুধু নয়, সামগ্রিকভাবে আর্থিক ব্যবস্থাপনাতেও সরকার ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক ব্যর্থতা দেখিয়ে এসেছে। মার্কিন ডলারের কথাই ধরা যাক। বিশ্বের সব দেশে যখন ডলারের দাম কমছে বাংলাদেশে তখন ৭৭/৭৮ টাকার ডলার কিনতে হচ্ছে ৮৬/৮৭ টাকায়। তাও আবার চাহিদা অনুযায়ী যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে না। বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে বলে কাঁচামালের আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে চলেছে। ফলে শিল্পমালিকরা একদিকে অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন অন্যদিকে বেশি দামে বিক্রি করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন। এমন অবস্থায় দেশের রফতানি আয়ই শুধু কমে যাচ্ছে না, একই সঙ্গে জাতীয় অর্থনীতিও সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ওদিকে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের। কারণ, ব্যয় বাড়লেও তাদের আয় বাড়েনি। ফলে সৌখিন পণ্য দূরে থাকুক তারা এমনকি প্রয়োজনীয় অনেক পণ্য কেনাও পরিত্যাগ করেছে। প্রত্যেকে ব্যস্ত রয়েছে প্রধানত চাল-আটাসহ খাদ্যদ্রব্য কেনার জন্য। অর্থাৎ মানুষ এখন কোনোভাবে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে। এমন এক অবস্থার মধ্যেই এবারের বাজেটে সাধারণ মানুষের বিপদ বাড়ানোর পরিষ্কার উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার ব্যাংকের জমানো টাকার ওপর আবগারি শুল্কের নামে ভয়ংকর এক জুলুম চাপিয়ে দিয়েছে। জনগণের মধ্যে বেশি প্রতিক্রিয়া ঘটেছে ব্যাংকে জমানো টাকার ওপর আরোপিত আবগারি শুল্কের কারণে।
বাজেটে দেখা গেছে এবং পরদিনের সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী নিজেও জানিয়েছেন, এখন থেকে কারো ব্যাংকের ব্যক্তিগত বা সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্টে এক লাখ টাকার বেশি জমা পড়লে বা থাকলেই তাকে ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হবে। এখানেও কিন্তু হিসাবের বড় ধরনের মারপ্যাঁচ আছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে, কারো সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্টে এক লাখ টাকা জমা থাকলে বছরশেষে তার লাভ বা মুনাফা হয় ৪০০ টাকা। এই লাভ থেকে আগে আয়কর বা ইনকাম ট্যাক্স কাটা হতো ৬০ টাকা। এর বাইরে এতদিন ৫০০ টাকা কাটা হতো আবগারি শুল্ক হিসেবে। সে পরিমাণকেই এবার ৮০০ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যাদের লাখ টাকার বেশি আছে তারা নাকি ‘যথেষ্ট সম্পদশালী’! অথচ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যখন হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন ও পাচার করা হচ্ছিল তখন একই অর্থমন্ত্রী হাতে তুড়ি বাজিয়ে বলেছিলেন, চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকা কোনো টাকাই নয়! এখন আবার সে তিনিই বলছেন, কারো ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে এক লাখ টাকার ওপর এমনকি এক টাকা থাকলেও সে শুধু ধনি নয় বরং ‘যথেষ্ট সম্পদশালী’ও! এজন্যই মিস্টার মুহিতের ‘মনে হয়েছে’, বছরে ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হলে ওই ব্যক্তির কোনো ‘সমস্যা হবে না!’
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্টে যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হচ্ছে সেসব কিন্তু অত্যন্ত আশংকাজনক। যেমন ৮০০ টাকার আবগারি শুল্কই শেষ কথা নয়, ওটা আসলে শুরুর অংক মাত্র। এর সঙ্গে রয়েছে চেক বইয়ের জন্য ২০০ টাকা এবং এটিএম কার্ডের জন্য ৩০০ টাকা। এভাবে বছর শেষে এক লাখ টাকা উল্টো কমে দাঁড়ায় ৯৮ হাজার ৫৪০ টাকা। অর্থাৎ কোনো মানুষ যদি ব্যাংকে এক লাখ এক টাকা জমা রাখে তাহলে বছরশেষে লাভ বা মুনাফা পাওয়ার পরিবর্তে মাশুল ও শুল্কের নামে তাকে উল্টো বরং ১৪৬০ টাকা বাড়তি গুনতে হবে। কথা আরো আছে। জমানো টাকার পরিমাণ এক লাখ এক টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত হলে আবগারি শুল্ক দিতে হবে ৮০০ টাকা- যার পরিমাণ বাস্তবে ১৪৬০ টাকা। যাদের টাকা বেশি অর্থাৎ ব্যাংকে যারা বেশি পরিমাণে টাকা জমা রাখবেন তাদের কিন্তু তুলনামূলকভাবে অনেক কম টাকা শুল্ক দিতে হবে। যেমন- ১. যাদের অ্যাকাউন্টে ১০ লাখ এক টাকা থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত থাকবে তাদের ওপর আবগারি শুল্ক ধরা হয়েছে ২৫০০ টাকা; ২. জমার পরিমাণ এক কোটি এক টাকা থেকে ৫ কোটি পর্যন্ত হলে আবগারি শুল্ক হবে ১২ হাজার টাকা; এবং ৩. যাদের অ্যাকাউন্টে ৫ কোটি টাকারও বেশি থাকবে তাদের কাছ থেকে আবগারি শুল্ক কাটা হবে ২৫ হাজার টাকা।
শুল্কের পরিমাণ সম্পর্কে পাঠকরাও ভেবে ও হিসাব করে দেখতে পারেন। মাত্র এক লাখ এক টাকার জন্য যেখানে ৮০০ টাকার আড়ালে আসলে ১৪৬০ টাকা আদায় করা হবে সেখানে কোটিপতিদের বিষয়টি কিন্তু বিস্ময়কর। কারণ, ৫ কোটি টাকার বেশি পরিমাণের জন্য ২৫ হাজার টাকা শুল্কের প্রকৃত অর্থ হলো, ওই ব্যক্তিকে প্রতি এক লাখ টাকার জন্য গড়ে মাত্র ২০ টাকা শুল্ক দিতে হবেÑ যেখানে সাধারণ মানুষের ওপর চাপানো হয়েছে ১৪৬০ টাকা! বিষয়টি নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনাও ‘যথেষ্টই’ চলছে। বলা হচ্ছে, এক লাখ টাকা সঞ্চয় করতেও একজন মানুষকে অনেক কষ্ট করতে হয়। অন্যদিকে অর্থমন্ত্রী তথা আওয়ামী লীগ সরকার সেই সাধারণ মানুষের ওপরই ১৪৬০ টাকার আবগারি শুল্ক চাপিয়েছে। একই সরকার আবার উদারতা দেখিয়েছে কোটিপতিদের ব্যাপারে। এর মধ্য দিয়েও সম্ভবত শেষবারের মতো প্রমাণিত হয়েছে, এই সরকার আসলে কোন শ্রেণীর স্বার্থে কাজ করে চলেছে। সেখানে আর যা-ই হোক, সাধারণ মানুষের কোনো স্থান নেই। সে নীতি-কৌশল যে কোনো সরকারের নীতিনির্ধারকরা নিতেই পারেন। কিন্তু বর্তমান পর্যায়ে কথা ওঠার কারণ হলো, জাতীয় সংসদের নির্বাচন এগিয়ে আসছে। সে কারণে মিস্টার মুহিতকে তো বটেই, সরকারকেও বুঝতে হবে, এখন আর শুধু মুখের কথায় চিড়া ভিজবে না।
শেষ করার আগে একটি অনুমানের কথা জানিয়ে রাখি। বাজেট কেবল পেশ করা হয়েছে। সংসদে বাজেট নিয়ে আলোচনা হবে এবং সবশেষে আসবে পাস করার প্রশ্ন। পাঠকরা নিশ্চিত থাকতে পারেন, পাস করার ঠিক প্রাক্কালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেশ কিছু নাটকীয় কান্ড ঘটাবেন। সেগুলোর মধ্যে লাখ টাকার ওপর আবগারি শুল্ক বাতিলের ঘোষণা আসতে পারে। এর মধ্য দিয়ে বোঝানো হবে, সাধারণ মানুষের জন্য সরকারের ‘দরদ’ রয়েছে বলেই তিনি আবগারি শুল্ক বাতিল করিয়েছেন বা কমিয়ে দিয়েছেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, সরকার কিন্তু কোটিপতিদের ব্যাপারে কোনো হেরফের করবে না। অর্থাৎ তাদের জন্য শুল্ক গড়ে ২০ টাকাই থাকবে। এর মধ্য দিয়ে আরো একবার জানিয়ে দেয়া হবে, সরকার আসলে কোটিপতিদের সরকার। বড়কথা, এই কোটিপতিরাও কিন্তু হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়েনি। তাদের সৃষ্টি তথা জন্ম ও বিকাশ ঘটেছে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত। বলা যায়, একেবারেই নব্য কোটিপতি তারা!

http://www.dailysangram.com/post/287473-