৭ মে ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০:০০

বাংলাদেশ রেলওয়ে : একটি পর্যালোচনা

-ড. মো. নূরুল আমিন

ভুল সিগন্যালে জয়দেবপুরে দুই ট্রেনের সংঘর্ষ শিরোনামে গত শনিবার জাতীয় দৈনিকসমূহে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবর অনুযায়ী জয়দেবপুর রেলস্টেশনের ঢাকামুখী আউটার সিগন্যাল এলাকায় গত শুক্রবার বেলা এগারোটার দিকে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ট্রেন দুটির ইঞ্জিনসহ ৯টি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। তেলবাহী ট্রেনের সঙ্গে যাত্রীবাহী ট্রেনের এই সংঘর্ষে উভয় ট্রেনের চার চালক (লোকো মাস্টার) আহত হয়েছেন। যাত্রীবাহী ট্রেনটিতে ওই সময় যাত্রী না থাকায় বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে যে, সিগন্যালম্যানের ভুলের কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনায় টাঙ্গাইল কম্যুটারের তিনটি বগি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এই দুর্ঘটনায় চারজন আহত হয়েছে এবং তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ এই দুর্ঘটনার জন্য কর্মচারী স্বল্পতাকে দায়ী করেছেন। তবে ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার জন্য রেল মন্ত্রণালয় একটি এবং রেল কর্তৃপক্ষ দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
এদিকে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরানুযায়ী জয়দেবপুরের ট্রেন দুর্ঘটনায় সারা দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। দুর্ঘটনায় পড়া ট্রেন উদ্ধার ও লাইন মেরামতে ৩১ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে। সারা দেশেই ট্রেনের সময়সূচিতে বিপর্যয় ঘটেছে এবং এতে যাত্রীরা চরম দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন। প্রতিটি ট্রেনই ছাড়তে দুই থেকে সাত ঘণ্টা বিলম্ব হয়েছে। বলা বাহুল্য বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে নতুন নতুন রেলস্টেশন হচ্ছে, লাইন সম্প্রসারিত হচ্ছে। আবার একের পর এক ট্রেন দুর্ঘটনাও ঘটছে। দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত সময়ের মধ্যে উদ্ধার কাজ পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত উদ্ধারকারী ট্রেন নেই। যেগুলো আছে সেগুলো অনেক পুরনো। এই অবস্থায় সারা দেশের রেল ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।

গত সপ্তাহে আমি নতুন লাইনে নতুন ট্রেনে আমার কক্সবাজার সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে রেলের সমস্যা এবং সিগন্যালম্যান/ কন্ট্রোল-ম্যানের নিষ্ক্রিয়তা ও দায়িত্বহীনতার ফলে কক্সবাজার এক্সপ্রেস ও পর্যটক এক্সপ্রেসের সম্ভাব্য মুখোমুখি সংঘর্ষের অবস্থা বর্ণনা করেছিলাম। তার এক সপ্তাহের মধ্যে একই কারণে দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে একজন লোকের আহত হওয়া সারা দেশে রেল চলাচলের সিডিউল বিপর্যয়ের ঘটনায় রেল ভ্রমণের ওপর মানুষের অনাস্থা সৃষ্টি হতে পারে বলে আমার ধারণা। আগের শত শত ঘটনার ওপর সরকার ও রেল কর্তৃপক্ষের গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অতীতে কোনো কাজে আসেনি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদন্ত রিপোর্টে চিহ্নিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি অথবা প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের হস্তক্ষেপে নিতে পারেননি।

বাংলাদেশে রেলপরিবহন ব্যবস্থা চালু হয় ১৬১ বছর আগে ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর। সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ শাসকদের প্রচলিত এই পরিবহনটি মানুষ সহজে গ্রহণ করেছিল। রেল বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তারা সম্মানের চোখে দেখতো। রেলের চাকরি একটা রাজসিক চাকরি ছিল। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হবার পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে হিসেবে এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই রেল পরিবহন সংস্থাটি এখন সারা দেশে বিস্তৃত এবং রেল ব্যবস্থার সংরক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে দুটি ডিভিশনে বিভক্ত- ইস্ট জোন এবং ওয়েস্ট জোন। একজন মহাপরিচালক এর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে ২৭,৫৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এর সাথে জড়িত। বাংলাদেশ রেলব্যবস্থার দৈর্ঘ্য ৩,৬০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে মিটার গেজ ২০২৫ কিমি, ব্রড গেজ ১৫৭৫ কিলোমিটার। এই ৩,৬০০ কিলোমিটারের মধ্যে আবার ডুয়েল গেজের পরিমাণ হচ্ছে ১৬০০ কিলোমিটার। সারা দেশে রেলওয়ের তৈরি ব্রিজ-কালভার্টের সংখ্যা ৩৬৫০টি। এর মধ্যে আয়তনে বড় ৫৪৬টি, ক্ষুদ্র ৩১০৪টি। দীর্ঘতম ব্রিজগুলোর মধ্যে রয়েছে : পদ্মা ব্রিজ, ৬২৫০ মিটার (ব্রড গেজ), রূপসা ব্রিজ, ৫১৩০ মিটার (ব্রড গেজ), বঙ্গবন্ধু ব্রিজ ৪৮০০ মিটার (ডুয়েল গেজ), হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ১৮৪৯ মিটার (ব্রড গেজ) ও মেঘনা ব্রিজ ১০২৪ মিটার (মিটার গেজ)। সারা দেশে রেলস্টেশনের সংখ্যা হচ্ছে ৪৯৮টি। গড়ে প্রতি বছর সাড়ে চার কোটি থেকে ৫ কোটি লোক ট্রেনে যাতায়াত করে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিচালাধীনে ৩১২টি ব্রড গেজ ও ১১৬৪টি মিটার গেজ কোচ আছে। এই এজেন্সিটি ৯০টি ইন্টারসিটি ট্রেন, ৫২টি মেইল বা এক্সপ্রেস ট্রেন, ৬২টি ডেমু বা কম্যুটার ট্রেন, ১৩৫টি শাটল বা লোকাল ট্রেন এবং দুটি আন্তর্জাতিক ট্রেন পরিচালনা করে। আন্তর্জাতিক ট্রেনগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা ও ভারতের কোলকাতার মধ্যে যাতায়াতকারী মৈত্রী এক্সপ্রেস ও ঢাকা-পার্বতীপুর-ঈশ^রদি হয়ে নিউজলপাইগুড়ি এক্সপ্রেস ট্রেন সপ্তাহে দু’দিন দুই দেশের মধ্যে যাতায়াত করে। বলা বাহুল্য ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার ভারতের সাথে রেল যোগাযোগ সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এরপর বর্তমান সরকারের আমলে তা পুনঃস্থাপন করা হয়।
আগেই বলেছি বাংলাদেশ রেলওয়ে ঐতিহ্যবাহী একটি রাজকীয় প্রতিষ্ঠান। সারা দেশে এর মালিকানায় প্রায় ৬০,০০০ একর জমি আছে। বাংলাদেশের মোবাইল ফোন প্রবর্তনের প্রথম দিকে মোবাইল কোম্পানিগুলো রেলওয়ে টাওয়ারসমূহকে ব্যবহার করেই যাত্রা শুরু করেছিল। সৈয়দপুরের রেলওয়ে কারখানা এই উপমহাদেশের অন্যতম বৃহত্তম কারখানা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এত সমৃদ্ধশালী হওয়া সত্ত্বেও এই প্রতিষ্ঠানটি বছরের পর বছর লোকসান দেয়। বছরের পর বছর এর সম্পদ ক্ষয়, দুর্নীতি, ক্ষমতাশালী মহল থেকে নিয়োগ কর্মে হস্তক্ষেপ এবং মামলা-মোকদ্দমা, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি রেল ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছে।

রেল শ্রমিক লীগ রেলওয়ে পরিবর্তনে অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। রেলওয়ের সম্পদ সংরক্ষণে তাদের অবদান খুবই কম। এরশাদ আমলে চট্টগ্রামে রেলগাড়ির তেল চুরির একটি বড় ঘটনা ধরা পড়ে। কিন্তু ইউনিয়ন কর্তৃক অচলাবস্থা সৃষ্টির কারণে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি। দেশে ফি বছর জনসংখ্যা বাড়ছে। এর সাথে যাত্রীসংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু রেলের যাত্রী বাড়ছে না। প্রাইভেট বাস মালিকদের সাথে যোগাসাজশ করে রেলের সময়সূচি তৈরি করাই এর অন্যতম কারণ বলে অনেকে মনে করেন। অভিযোগ করা হয় যে, বাস মালিকরা রেলের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের পয়সা দিয়ে বশ করে এমন এক সূচি তৈরি করান যে সূচি যাত্রীদের অনুকুল নয়। ফলে যাত্রীরা রেলের চেয়ে বাসে যাতায়াতকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। এর সাথে আবার ট্রেনের ধীরগতি, যাত্রা বাতিল ও বিলম্ব এবং নিরাপত্তা সমস্যাও রয়েছে। সূচনালগ্ন থেকেই রেললাইনের স্লিপারসমূহকে মজবুত করার জন্য নুড়ি পাথর দিয়ে গ্রাভেট প্যাকিং করা হয়। যাতে করে ট্রেন চলাচলের সময় প্লেটগুলো নড়চড় হয়ে না যায়। এখন দেখা যায়, মূল্যবান কাঠের তৈরি স্লিপার এবং গ্রাভেল প্যাকিংয়ের জন্য প্রদত্ত নুড়ি পাথরগুলো চুরি হয়ে যাচ্ছে। ফলে রেলের নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে। রেলই একমাত্র এজেন্সি যার নিজস্ব নিরাপত্তা রক্ষী বা পুলিশ বাহিনী রয়েছে। তাদের ডিউটি কী?

রেলওয়ের জনবল কম বলে রেল বিভাগের তথ্য সঠিক বলে আমি মনে করি না, ১৯৭০ সালে তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ৫৫,৮২৫ জন, ১৯৮০ সালে ৫৮,১০৭ জন, ২০০০ সালে ৩৬৬০৩ জন এবং ২০১৫ সালে ২৮৩৫৩ জন। বর্তমানে ২৭,৫৩৫ জন। কাজের অনুপাতে তাদের সংখ্যা বেশি এবং আমি ঢাকা-কক্সবাজার ভ্রমণকালে নিজেই তা প্রত্যক্ষ করেছি। নব্বই-এর দশকের প্রথমদিকে আইএমএফ-বিশ^ব্যাংকের নির্দেশনায় Structural Adjustment Programne-এর আওতায় এবং এর আগে এনাম কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কাজের ভিত্তিতে রেলওয়ের ৪৫ হাজার কর্মচারীকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক-এর মাধ্যমে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ঐ সিদ্ধান্ত পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। তথাপি সময়ে সময়ে জনবল নিয়োগের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, কারণ বছরে গড়ে পুরাতন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্য থেকে ২০০ জন ও তার বেশি লোক অবসর গ্রহণ করেছে। কিন্তু দুর্নীতি, কর্তৃপক্ষীয় হস্তক্ষেপ, ইতোপূর্বে নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়ায় উচ্চ আদালতে ৪০টিরও বেশি রিট পিটিশন দায়ের করার ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ে। পাঠকদের হয়তো মনে আছে যে, ২০১১ সালে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ৪৮৯২ জন কর্মচারী নিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এই উদ্যোগের সাথে সাথেই সেখানে তার কালো বিড়াল ধরা পড়ে। প্রক্রিয়ার মাঝখানে এসে চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে ব্যাপক ঘুষ নেয়া শুরু হয় এবং ঢাকার বিডিআর গেইটে একটি মাইক্রোবাসে ঘুষের ৭০ লাখ টাকা মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাসায় নেয়ার সময় তার এপিএস রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার ইউসুফ আলী ও সিকিউরিটি কমান্ডার ইনামুল হক ধরা পড়েন। মন্ত্রী তার মন্ত্রিত্ব হারান এবং পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট দু’জন কর্মকর্তার জেল হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু ঘুষের এই বিরাট কেলেঙ্কারি থেকে অনেকে রেলওয়ে গেট কেলেঙ্কারি হিসেবে অভিহিত করেছেন- যিনি ধরার ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন সেই ড্রাইভার আবদুল আওয়ালকে গুম করা হয়েছিল, তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার পিতা সাংবাদিক সম্মেলন করে সরকার ও দেশবাসীর সাহায্য কামনা করেছিলেন। কিন্তু কাজ হয়নি।

রেলওয়ে কর্মচারীদের অত্যন্ত সৌভাগ্যবান বলতে হবে। তারা রেলের কোয়ার্টার বরাদ্দ পান। এই কোয়ার্টার শতকরা ৯০ ভাগ ভাড়া দেয়া হয় এবং এই ভাড়া তাদের নিয়মিত আয়ের একটি উৎসও।

রেলওয়ের কিছু টেকনিক্যাল পদ আছে যেগুলো খালি রাখা যায় না। রেলওয়ে ড্রাইভার ও তাদের (সহকারীর লোকোমাস্টার ও সহকারী লোকোমাস্টার) পদ সম্পূর্ণ টেকনিক্যাল। একজন ড্রাইভার হতে হলে কমপক্ষে আট বছরের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। জানা গেছে, এই পদে লোক না থাকায় রেলওয়েকে ৮৬ জন অবসরপ্রাপ্ত ড্রাইভারকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে হয়েছে। তাদের যদি সঠিক জনশক্তি পরিকল্পনা, অবসর ও প্রতিস্থাপন পরিকল্পনা থাকতো তাহলে তারা সহজে সংকট মোকাবেলা করতে পারতেন। রেলওয়েকে গতিশীল ও লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হলে সামগ্রিক এই সিস্টেমটির ওভারহলিং প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। জনবহুল এই দেশে এই ঐতিহ্যবাহী পরিবহন সংস্থাটি মানুষের কল্যাণে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।

https://www.dailysangram.info/post/555388