৪ মে ২০২৪, শনিবার, ৫:৫৬

দাবদাহে বিবর্ণ রূপসী নগরী

ইবনে নূরুল হুদা

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ভূপৃষ্ঠ এখন উত্তপ্ত কড়াইয়ের রূপ নিতে চলেছে। ফলে বিশ্ব হারাতে বসেছে নিজস্ব অস্বকীয়তা ও জীববৈচিত্র। বিষয়টি নিয়ে বৈশ্বিক পরিসরে অনেক লম্বা-চওড়া কথা এবং নিয়মিত বিরতিতে বৈশি^ক জলবায়ু সম্মেলন হলেও তা কথামলার ফুলঝঁড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ফলে সার্বিক পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকেই যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

মূলত, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব বিশ্ব পরিস্থিতিকে বিপর্যস্ত ও অশান্ত করে তুললেও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেননি। এ খাতে প্রয়োজনীয় ব্যয় বরাদ্দও করা হচ্ছে না। অথচ উদ্ভূত পরিস্থিতি অনুযায়ী বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে। পক্ষান্তরে বিশ্ব নেতারা বরাবরই বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সামরিক ব্যয় কমানোর ব্যাপারে খুবই সোচ্চার হলেও ভেতরে ভেতরে ঘটছে তার পুরোপুরি উল্টোটা। কারণ, বিশ্বে সামরিক ব্যয় এখন সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলে বিশ্বশান্তি নিয়ে নতুন শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে যুদ্ধ-বিগ্রহও।

ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসন স্বল্প মেয়াদি হবে বলে ধারণা করা হলেও পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকেই যাচ্ছে। দিনের পর দিন যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটছে। মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিও এখন রীতিমত জটিল আকার ধারণ করেছে। এমতাবস্থায় বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও বৈশ্বিক নিরস্ত্রীকরণের জন্য যেখানে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে ইতিবাচক মনোভাবে নিয়ে এগিয়ে আশা দরকার সেখানে লাগামহীন সামরিক ব্যয়বৃদ্ধি ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা বিশ্ব শান্তির জন্য নতুন জটিলতার সৃষ্টি করেছে। ফলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ।

বিশ্বে যখন শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা জোরালোভাবে জোরালোভাবে অনুভূত হচ্ছে, তখন লাগামহীনভাবে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি পুরো পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী সামরিক ব্যয় সর্বকালের সর্বোচ্চ এখন পর্যায়ে পৌঁছেছে। জানা গেছে, গত বছর সারাবিশ্বে সামরিক ব্যয় ছিল ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। সম্প্রতি শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত আন্তর্জাতিক সংগঠন স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে। সংগঠনটি ১৯৪৯ সাল থেকে সামরিক ব্যয় নিরীক্ষণ করছে। সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে এই ব্যয় বৈশ্বিক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২.৩ শতাংশ হয়ে গেছে, যা আগের বছর (২০২২) ছিল ২.২ শতাংশ। এর অর্থ হল পৃথিবীর প্রতিটি পুরুষ, নারী এবং শিশুকে গত বছর সামরিক ব্যয়ের জন্য গড়ে ৩০৬ ডলার কর আরোপ করা হয়েছিল। স্নায়ুযুদ্ধের পরে এটিই সর্বোচ্চ হার।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ব্যয় সব দেশে সমানভাবে বাড়েনি। মাত্র ডজন খানেক দেশে এই ব্যয় ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ৯১৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে। এককভাবে বিশ্বের সামরিক ব্যয়ের সর্বোচ্চ ৩৭ শতাংশের জন্য দায়ী বিশ্বের শক্তিধর এই দেশটি। ২৯৬ বিলিয়ন ডলার খরচ করে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চীন। তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে রাশিয়া (১০৯ বিলিয়ন ডলার) ও ভারত (৮৩.৬ বিলিয়ন ডলার)।

গত বছর ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার পর দেশটির সামরিক ব্যয় রেকর্ড ২৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে সাড়ে ২৭ বিলিয়ন ডলার, যা দেশটির জিডিপির ৫ দশমিক ৩ শতাংশের সমান। সৌদি আরবের সামরিক ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। গোটা মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির ৯ শতাংশের জন্য দায়ী এই দুই দেশ।

ইউক্রেন যুদ্ধের পর রুশ আতঙ্কে পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ডের সামরিক ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তবে জার্মানির সামরিক ব্যয় কমেছে। এর আগের বছর ২০২২ সালে বিশ্বের সামরিক ব্যয় ছিল ২ দশমিক ২৪ ট্রিলিয়ন ডলার। সেই বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপজুড়ে সামরিক ব্যয়ে মারাত্মকভাবে বাড়তে থাকে, জানিয়েছে সিপ্রি। তারা জানিয়েছে, বেশিরভাগই রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের জন্য বেড়েছে। তবে পূর্ব ইউরোপের বেশ কিছু দেশ রুশ হুমকির প্রতিক্রিয়ায় সামরিক ব্যয় বাড়িয়েছে।
বিশে^ যখন জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব ও বৈশি^ক উষ্ণতা মোকাবেলায় বিশ^নেতৃবৃন্দকে একযোগে কাজ করার আবশ্যকতা অনুভূত হচ্ছে, তখন সে বিষয়টিকে উপেক্ষা করে সামরিক ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পুরো বিশ্ব পরিস্থিতিকে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির জন্য কোন বৈশ্বিক সম্মেলন না হলেও তা নিরবে-নিভৃতেই ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। পক্ষান্তরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় নিয়মিতভাবে বৈশ্বিক সম্মেলন হলেও ফলাফল রীতিমত অশ্বডিম্ব। মূলত, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সীমাহীন উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার কারণেই সার্বিক পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। লাগামহীনভাবে বেড়েছে বৈশ্বি উষ্ণতা। ফলে বিশে^র বিভিন্ন অঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তীব্র গরমে মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করায় সমুদ্রপৃষ্ঠও উত্তাল হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় বিশে^র বিভিন্ন অঞ্চল সমুদ্র গর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়েছে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে আমরাও মুক্ত নই।

মূলত, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবেই আমাদের দেশে দীর্ঘ পরিসরে তাপদাহ চলছে। তীব্র গরম ও অনাবৃষ্টিতে জনজীবন ইতোমধ্যেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রকৃতি হারাতে বসেছে চিরচেনা রূপ; হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। বাধ্য হয়েই দীর্ঘ পরিসরে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে।

চলমান তাপপ্রবাহ ও অনাবৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রূপসী নগরী ঢাকার জীবনযাত্রায়। ফলে ইতোমধ্যেই নগরজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। অবশ্য রাজধানীর শাহবাগ, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসবাসকারীরা এই গ্রীষ্মে তুলনামূলক কম বিপদে রয়েছেন। কারণ, ঢাকার মধ্যে এসব এলাকায় উষ্ণতার মাত্রা সবচেয়ে কম। রাজধানীর মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ এখন কামরাঙ্গীরচর ও আদাবর এলাকা। এ ছাড়া ধানম-ি এলাকায়ও উষ্ণতার মাত্রা তীব্র হয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৯০ শতাংশ এলাকা তীব্র তাপপ্রবাহের বিপদে রয়েছে। ফলে নগর জীবনে নেমে এসেছে সীমাহীন অস্বস্তি।

বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি থেকে ২৪ এপ্রিল প্রকাশ করা ‘তাপপ্রবাহ: বাংলাদেশ, আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রচ- দাবদাহের এ পরিস্থিতিতে দরিদ্র মানুষের বিপদগুলো চিহ্নিত করতে এই সমীক্ষা প্রতিবেদন ও কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে সংস্থাটি। কোন এলাকায় তাপমাত্রা কেমন, তা চিহ্নিত করার পাশাপাশি মূলত চারটি সূচক আমলে নিয়ে একটি মানচিত্র তৈরি করেছে সংস্থাটি। উষ্ণতার মানচিত্রটি সম্প্রতি হালনাগাদ করা হয়েছে। তাপমাত্রা, জনসংখ্যার ঘনত্ব, দরিদ্র মানুষের উপস্থিতি এবং ঘনবসতির পরিমাণ ও বস্তির সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে সমীক্ষাটি করা হয়েছে।

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পক্ষে বলা হয়েছে, গ্রীষ্মকালে প্রাকৃতিক কারণেই বেশি গরম থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কয়েক বছর ধরে রাজধানীসহ সারাদেশে তীব্র উষ্ণতা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে বাধাগ্রস্ত করছে। নাগরিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, কমছে কর্মক্ষমতা। এতে আরো বলা হয়, সাধারণ নাগরিকেরা বিশেষ করে দরিদ্র মানুষ কী ধরনের গরমের ঝুঁকির মধ্যে আছেন, তা চিহ্নিত করতেই সমীক্ষাটি করা হয়েছে। নগরবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর ৯০ শতাংশ এলাকা গ্রীষ্মকালের প্রায় পুরোটা সময় উষ্ণ বা তাপীয় দ্বীপে পরিণত হচ্ছে। ঢাকার পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা উত্তরা, মিরপুর ও ধানম-িতেও একই ধরনের উষ্ণতার বিপদ তৈরি হয়েছে। অল্প জায়গায় বিপুলসংখ্যক মানুষের বসতি, অতিমাত্রায় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার, গাছপালা ও জলাভূমি না থাকা এবং রাজধানী শহরের বেশির ভাগ জায়গা কংক্রিটের স্থাপনা দিয়ে আচ্ছাদিত হয়ে যাওয়ার কারণে অতি উষ্ণতার ঝুঁকি বছর বছর বাড়ছে।

সমীক্ষায় বলা হয়েছে, কামরাঙ্গীরচর ও আদাবরের তাপমাত্রা এতটাই বেশি যে সেখানে ঘরের বাইরে বের হয়ে অল্প সময় অবস্থান করলেই নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এসব এলাকার রিকশাচালক, ভ্যানচালক, হকার, নির্মাণশ্রমিক ও নিম্নায়ের মানুষের আয় কমে যাচ্ছে। তারা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম কাজ করতে পারছেন। দাবদাহের কারণে রোগবালাই বেড়ে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকার মধ্যে মতিঝিল, ফার্মগেট, মহাখালী, কারওয়ান বাজার ও গুলশান এলাকায় উষ্ণতা মাত্রাতিরিক্ত অবস্থায় পৌঁছেছে। কিন্তু এসব এলাকার বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহারের কারণে ভেতরে অবস্থান করা মানুষ কম ঝুঁকিতে আছেন। তবে ভবনগুলোর বাইরে বা সড়ক এবং উন্মুক্ত স্থানে উষ্ণতা আরও বেড়ে যাচ্ছে এসব ভবনের শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের কারণে।

জানা গেছে, গত বছরের অতিউষ্ণ পরিস্থিতির পর রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং ক্লাইমেট সেন্টার যৌথভাবে ঢাকা শহরের উষ্ণতার বিপদ নিয়ে এই সমীক্ষা করে। সমীক্ষা অনুযায়ী, উষ্ণতার বিপদে থাকা এলাকাগুলো হচ্ছে- কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, গাবতলী, গোড়ান, বাসাবো, টঙ্গী, শহীদনগর, বাবুবাজার, জুরাইন, হাজারীবাগ, পোস্তগোলা, যাত্রাবাড়ী, তেজকুনীপাড়া, নাখালপাড়া, সায়েদাবাদ, কুর্মিটোলা, আজমপুর, কামারপাড়া, মোহাম্মদপুর, আদাবর ও মহাখালী। গ্রীষ্মের পুরো সময়জুড়ে এসব এলাকা তাপপ্রবাহের বিপদে থাকছে। তবে শাহবাগ, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশপাশের এলাকায় উষ্ণতার বিপদ কম। এমন কম ঝুঁকির অন্য এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে উত্তরখান, খিলক্ষেত ও ডেমরা। এসব এলাকার অনেক জায়গায় এখনো ঘনবসতি তৈরি হয়নি। এ ছাড়া এসব এলাকায় এখনো কিছু গাছপালা ও জলাভূমি রয়েছে। সমীক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশে অন্যান্য দুর্যোগের মতো তাপপ্রবাহ বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি তৈরি শুরু করেছে। এমনি মানুষের মৃত্যুও ঘটছে। ফলে এই বিপদকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সব সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উচিত গরমে কষ্টে ভোগা মানুষের পাশে দাঁড়ানো।

ঢাকার উষ্ণতা নিয়ে গত বছর একই গবেষক দল আরেকটি সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করেছিল বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়। এতে বলা হয়েছে, শহরে জমে থাকা ২ দশমিক ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রাকৃতিক তাপমাত্রার সঙ্গে যোগ হয়। সবচেয়ে বেশি উষ্ণ সময় থাকছে দুপুর ১২টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত। এই সময়টাতে শ্রমজীবী মানুষেরা কাজ কমিয়ে দিতে বাধ্য হন। বিশেষ করে ভ্যান ও রিকশাচালকেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। সমীক্ষায় দেখা যায়, ওই সময়ে খাওয়ার স্যালাইনের বিক্রি সাধারণ সময়ের চেয়ে তিন গুণ বেড়ে যায়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে গরমে মাথা ঘোরা, বমি ও ঠাণ্ডা-কাশির সমস্যা বেড়ে যায়। ডায়রিয়া ও কলেরার প্রাদুর্ভাবও বেড়ে যায়। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে করা ওই জরিপে প্রায় ৮৭ শতাংশ উত্তরদাতা এর আগের বছরের চেয়ে বেশি গরম অনুভব করছেন বলে জানিয়েছেন। একজন রিকশাচালক স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এই সময়ে দুই থেকে তিন ঘণ্টা রিকশা কম চালান। এর ফলে তার আয়ও কমে যায়।

এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষে জানানো হয়েছে, সিটি কর্পোরেশন উষ্ণ এলাকাগুলোতে পানি ছিটিয়ে কিছুটা স্বস্তি আনার চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে দরিদ্র মানুষদের ছাতা ও পানির বোতল দেওয়ার কাজ শুরু করা হয়েছে। আর দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে গাছ লাগানো কর্মসূচি।

বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সমীক্ষায় আরও বলা হয়, গ্রীষ্মকালে গরম ও অসুস্থতার কারণে রিকশাচালকেরা মাসে গড়ে ছয় দিনের বেশি সময় কাজে যেতে পারেন না। এ ছাড়া প্রতিদিন গড়ে স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা কম কাজ করতে পারেন। ৮৩ শতাংশ রিকশাচালক জানিয়েছেন, গরমের সময়ে তাদের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় অন্য সময়ের তুলনায় মাসে ৫৩৫ টাকা বেড়ে যায়। একইভাবে হকার, নির্মাণশ্রমিক, দিনমজুর ও নিম্নায়ের মানুষেরা কম কাজ করতে পারছেন। এতে তাদের আয় কমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে গ্রামের তুলনায় গরম অনেক বেশি। এ পরিস্থিতিতে শিশুদের স্কুল বন্ধ রাখা উচিত ছিল। ছোটবেলায় আমরা এই গরমে গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেতাম। আর এখন এই গরমের ঝুঁকির মধ্যে শিশুদের ঠেলে দেওয়া অন্যায় হচ্ছে।

সিটি করপোরেশনের রাস্তায় পানি ছিটানো ও গাছ লাগানোর প্রসঙ্গে এই পরিবেশ ও জলবায়ুবিশেষজ্ঞ বলছেন, এগুলো না করে উচিত ছিল সাধারণ মানুষের জন্য প্রতিটি রাস্তার মোড়ে খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করা; মানুষ যাতে টানা আধা ঘণ্টার বেশি তপ্ত রোদের নিচে না থাকেন, সেই পরামর্শ দেওয়া; রিকশাচালক বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করা। তা না করে যেসব করা হচ্ছে, তা লোক দেখানো বা দায়সারার জন্য। এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট কমছে না বরং ক্রমেই সার্বিক পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করছে। ফলে বিবর্ণ হয়ে উঠছে রূপসী নগরীর জীবনযাত্রা।

শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব বা দাবদাহ নয় বরং নানাবিধ কারণে ঢাকা নগরীর জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, নকশা বহির্ভূত ও ইমারতবিধি লঙ্ঘন করে ইমারত নির্মাণ, যত্রতত্র কলকারখানা, মানহীন যানবাহন, বিষাক্ত ধোঁয়া, সেকেলে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, জলাবদ্ধতা ও অপরিচ্ছন্ন জলাশয় পুরো নগরজীবনকে অস্থির করে তুলেছে। এমতাবস্থায় নগর জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে পরিকল্পিত নগরায়ন সহ সবুজায়নকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। অন্যথায় রূপসী নগরীর অতীত গৌরব অক্ষুণœ রাখা সম্ভব হবে না। ফলে আরো বিবর্ণ হয়ে পড়বে রূপসী নগরীর জীবনযাত্রা।

https://www.dailysangram.info/post/555128