২ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৫:৫৩

মূল্য বৃদ্ধি না করেও জ্বালানি খাতের ভর্তুকি কমানো সম্ভব

গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি না করে জ্বালানি খাতের অপচয় রোধ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলেই ভর্তুকি কমানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। বক্তারা বলছেন, ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে ভর্তুকি কমানোর কথা বলেছে। কিন্তু এটা যুক্তিসংগত নয়। এটা সুবিচারও নয়।

তাই আমরা আইএমএফকে বলব, দাম বাড়ানোর শর্ত না দিয়ে কোথায় অসংগতি আছে, সেটা খুঁজে বের করতে।’ গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ক্যাব আয়োজিত ‘অসাধু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবসা সুরক্ষায় মূল্যবৃদ্ধি নয়, জ্বালানি সুবিচার চাই’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন। এ সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব পর্যায়ে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা, সমতা, যৌক্তিকতা ও জবাবদিহি তথা জ্বালানি সুবিচার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ক্যাবের পক্ষ থেকে ১৩ দফা দাবি জানানো হয়।

বক্তব্যে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ আইন ২০১০-এর আওতায় প্রতিযোগিতাহীন ব্যক্তি বিনিয়োগে খাতটির উন্নয়ন অব্যাহত আছে।

তাতে বিনিয়োগকারীরা খেয়ালখুশিমতো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি করে লুণ্ঠনমূলক মুনাফা বৃদ্ধির সুযোগ নিচ্ছে। ফলে আর্থিক ঘাটতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তা সমন্বয়ে মূল্য ও ভর্তুকি উভয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।

এম শামসুল আলম বলেন, ‘সরকার এখন ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের জন্য দিশাহারা হয়ে আইএমএফের পেছনে দৌড়াচ্ছে। সেখানে জনগণের স্বার্থ ও কল্যাণ তথা জ্বালানি নিরাপত্তা সুরক্ষা নিশ্চিত করা এখন আর সরকারের জন্য ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই ভোক্তারা চরম উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। এ অবস্থায় জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে আমরা সরকারের প্রতি জানাচ্ছি, অসাধু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবসায় লাগাম দিন, মূল্যবৃদ্ধি থেকে সরে আসুন, মানুষকে অভয় দিন।’

ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, জ্বালানি খাতে সরকারের অনেক অর্জন রয়েছে।
কিন্তু যথাসময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে বা অনীহা রয়েছে। ফলে তার দায়ভার নিতে হচ্ছে ভোক্তাকে। আইএমএফের পরামর্শে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি না করে বরং জ্বালানি খাতের অপচয় রোধ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলেই ভর্তুকি কমানো সম্ভব।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, গত ২৫ এপ্রিল ঋণ কর্মসূচির আওতায় পর্যবেক্ষণে আসা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক প্রতিনিধিদল অর্থবিভাগের বাজেট অনুবিভাগের সঙ্গে ভর্তুকি নিয়ে করা বৈঠকে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারে ভর্তুকি উঠিয়ে দামবৃদ্ধির মাধ্যমে সরবরাহ ব্যয় সমন্বয়ের সুপারিশ করেছে। ভর্তুকির অর্থ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রমে খরচ করার পরামর্শ দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থবিভাগ বলেছে, খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে আপাতত কৃষিতে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দেবে সরকার। তবে ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি করা হবে। বোঝা যায়, জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টি তাদের মাথায় নেই। তারা কি বোঝে না, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না!

সম্মেলনে আরো বলা হয়, জনগণকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেবা দিয়ে সরকার মুনাফা করে। এ মুনাফা ব্যবসায় যেভাবে হয়, সেভাবে হয় না। দামবৃদ্ধি দ্বারা সে মুনাফা দেওয়া বা বৃদ্ধি করা হয়। পাবলিক কম্পানির মালিক হিসেবে সরকার একদিকে সেসব কম্পানির মুনাফার ভাগ পায়, অন্যদিকে আলাদাভাবে সরকার করপোরেট ট্যাক্সও নেয়। সরকার যদি শুধু খরচ উসুল করত, মুনাফা না নিত, তাহলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেবার দামবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে থাকত এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হতো। ফলে জনগণের কল্যাণ হতো, সরকারকেও আর অসাধু ব্যবসায় জড়িয়ে পড়তে হতো না, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নও বিনিয়োগকারীদের অসাধু ব্যবসার শিকার হতো না, জনগণ জ্বালানি সুবিচার পেত।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এজাজ হোসাইন বলেন, ‘সরকার যে মূল্যবৃদ্ধি করবে (বিদ্যুৎ-জ্বালানির), সেটা আমি দেব। কিন্তু তার মধ্যে যে চুরি ও অপচয় রয়েছে, তার দায় কেন আমি নেব? জ্বালানি নেই, তবু পাওয়ার প্লান্ট করা হচ্ছে। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক কেন অনিয়মের খোঁজ নেয় না। বাংলাদেশে এখনো ৩০ শতাংশ ফার্নেস অয়েল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীর কোথাও ৫ শতাংশের বেশি নেই। এসব বিষয়ে দাতা সংস্থাগুলো কেন পদক্ষেপ নিচ্ছে না?’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি একটি স্টেটেটিক পণ্য বা সেবা। নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির এই মূল্যবৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয়। এটা বিইআরসির গণশুনানির মাধ্যমে করতে হবে, আর সেটাই কাম্য। কিন্তু নির্বাহী আদেশে বিইআরসির শক্তিকে খর্ব করে রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে অধিকার হারাচ্ছে জনগণ।

https://www.kalerkantho.com/online/business/2024/05/03/1384381