২ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৫:৩৮

দলতন্ত্র-ভয়তন্ত্রের কবলে বিশ্ববিদ্যালয়

-প্রফেসর আবদুল লতিফ মাসুম

বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় যতই বড় হতে থাকে কাঠামোগুলো, ততই বাড়তে থাকে আমাদের উচ্চাশা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যে জগৎ তা থেকে মাধ্যমিক পর্য়ায়ে পরিচয়ের প্রভাবটি আরেকটু সমৃদ্ধ হয়। কলেজ বা মহাবিদ্যালয় সেই সমৃদ্ধির সোপান আরও শক্তপোক্ত হয়। আর যখন একজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পা রাখে তখন সে একটি বৈশ্বিক পরিসর, পরিবেশ এবং আবহাওয়াতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাথমিক ভিত বিনষ্ট হয়েছে। মাধ্যমিকটি ক্রমহ্রাশমান। মহাবিদ্যালয় মহা সমস্যায় নিমজ্জিত। আর বিশ্ববিদ্যালয় দলতন্ত্র এবং ভয়তন্ত্রের কবলে সামগ্রিকভাবেই বিপর্য়স্ত। এই জাতির যাত্রা শুরু থেকেই শাসক দল ছাত্র সমাজকে তাদের ক্ষমতা আরোহন এবং অন্যকে ক্ষমতা থেকে অবরোহনের সোপান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্য়ন্ত যে চিত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার হয়েছে তা থেকে নিঃসন্দেহে ৫০ বছর পরে দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি ‘যথা পূর্বং তথা পরং’। বরং সেদিনের সন্ত্রাস আর দাপটের চেয়ে আজকের অবস্থা সার্বেকভাবেই বিপদগ্রস্থ, বিপর্য়স্ত এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বিভীষিকাময়। সেদিন ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ খুনের ঘটনা ঘটেছে তাদেরেই আনুকূল্যে। তখন সে বিষয়টি আলোচিত ও নিন্দনীয় হওয়ার পরিবেশ ছিলো। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সিভিল সোসাইটির বুদ্ধিজীবিগন এখনকার মত এত সস্তা দরে বিক্রিত হননি। এখন ৭ খুন নয় হাজারো খুনের ঘটনা ঘটে, নিরবে নিভৃতে অন্যায় অনাচার নিপীরন নির্য়াতন সেখানে নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। হলের গেস্টরুম যেটি ছাত্রদের শুভকামনার যায়গা ছিল এখন তা অশুভ কর্মের ক্ষেত্রভূমিতে পরিনত হয়েছে। বিগত ১৭ বছর ধরে এই দৃশ্য বিরামহীনভাবে সহ্য করছে ছাত্র সমাজ। আর গোটা জাতি বেমালুম নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তা অবলোকন করছে।

‘সে ইতিহাস করুন ইতিহাস’। ২০০৯ সাল থেকে যে অশুভ বৃক্ষের রোপন গত ১৭ বছরে সেই বিষবৃক্ষ ফলে ফুলে সুশোভিত হয়ে দলতন্ত্র ও ভয়তন্ত্রের রাজত্ব কায়েম করেছে। সে ইতিহাস লিখলে মহাকাব্য রচিত হতে পারে। তাই অতি সাম্প্রতিক বিষয়ের মধ্যে সীমিত থাকলেই তাদের দলতন্ত্র ও ভয়তন্ত্রের অসংখ্য উদাহরণ মিলবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েট এর ঘটনাবলী একটি টেস্টকেস হিসেবে বিশ্লেষন করা যায়। ২০১৯ সালের অক্টোবরে বুয়েটের শেরে বাংলা হলের মেধাবী দেশ প্রেমিক শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের একদল গুন্ডা বাহিনী। এই ঘটনায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তাদের দাবী অনুযায়ী ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। তখন সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ‘জরুরী বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঐ সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়। ২০১৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্য়ন্ত ছাত্র রাজনীতিবিহীন বুয়েট চলছিল ভালোভাবেই। কিন্তু সব ভালো কারো কারো সয় না। তাই ঐ বিজ্ঞপ্তিকে উপেক্ষা করে গত ২৭ মার্চ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জোর করে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। দেশের অন্যত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে ছাত্রলীগের দখল হয়ে আছে সে কায়দায় বুয়েট দখল করতে চায় ছাত্রলীগ। বাদসাধে সাধারন শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলনের মুখে ১৯ মার্চ ছাত্রলীগ নেতা ইমতিয়াজ হোসেনের হলের আসন বাতিল করে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। পরে ইমতিয়াজের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ০১ এপ্রিল বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সেই জরুরী বিজ্ঞপ্তির কার্য়কারিতা রহিত করে উচ্চ আদালত। গত ১৭ বছর ধরে শাসক দল বিচার বিভাগের কাধে ভর করে অসংখ্য অন্যায়কে ন্যায়ে পরিনত করার প্রয়াস পেয়েছে। এবারও তাই। ছাত্রলীগের দাবীর মুখে একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের স্বকীয় সত্তার কারনে জারিকৃত একাডেমিক আদেশটি বাতিল হয়ে যায়। বিপরীতে তাদের অনধিকারকে অধিকারে রূপ দেয় বিচার বিভাগ। সেই থেকে বুয়েটে দ্বিপক্ষীয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ঠান্ডা এবং গরম যুদ্ধ চলছে। বুয়েটের সাধারন শিক্ষার্থী, গরিষ্ঠ শিক্ষক সম্প্রদায় এবং সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা শুভানুধ্যায়ীরা চাচ্ছেন ছাত্র রাজনীতির মুক্ত থাকুক এই বিশ্ববিদ্যালয়। আইনুন নিশাত এর মতো উচ্চ মর্য়াদার একাডেমিক ব্যক্তিত্ব বুয়েটে নিরপেক্ষ মর্য়াদার পক্ষে কথা বলছেন। অপর দিকে ছাত্রলীগ তাদের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রীত্বকুল বুয়েটের স্বতন্ত্র মর্য়াদা নিশ্চিত করতে নারাজ। বড় নেতা ওবায়দুল কাদের বুয়েটের দখল নিতে অপযুক্তি দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্য়ন্ত বুয়েট দখলের মুখ্যম যুক্তি তুলে ধরছিলেন। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে যে বুয়েটের একাডেমিক কাউনসিল ‘সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে’ এরকম একটি কূটীল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উচ্চ আদালতের রায়ের ট্রফি পাওয়ার পর আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে বিবেচনা করা হবে। এতে ষ্পষ্ট হলো যে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ সরাসসরি, স্পষ্ট এবং শিক্ষর্থী অনুকুল সিদ্ধান্ত নিতে প্রকাশ্যত অপারগ। তারা সময়ক্ষেপন কারচুপিতে আরও কিছু কালের জন্য ছাত্র রাজনীতির বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখতে চান। তাদের তাগদ নেই একথা বলার যে, ছাত্রলীলের দাবী অন্যায়। অপর দিকে সাধারন শিক্ষার্থীদের নিয়েও তাদের ভয়। রীতিমত ভয়ের সংস্কৃতি ঘিরে ধরেছে বুয়েট প্রশাসনকে। এদিকে ছাত্রলীগের তরফ থেকে ভীতি প্রদর্শনের পুরোনো কৌশল অব্যাহত রয়েছে তথা কথিত মৌলবাদি গোষ্ঠির হাত থেকে ৩১ মার্চ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সমাবেশ করে তারা। সমাবেশের বুয়েট ক্যাম্পাসে গিয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দেয় তারা। ছাত্রলীগের সভাপতি নতুন কথা বলেছেন। সেখানে তারা নাকি নতুন রাজনীতি চালু করবেন। গোট দেশে তাদের পুরোনো রাজনীতি পরিত্যক্ত হওযার বোধ খথকে উৎসারিত নতুন রাজনীতির কথা ভুতের মূখে ধর্মের কথার মত অসাড় মনে হয়।

ক্ষমতাসীন সরকারের অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও ব্যর্থতার দায় থেকে কোন সেক্টরই রক্ষা পাচ্ছে না। অতি সাম্প্রতিক সময়ে ‘সড়কে যেন হত্যাকান্ড চলছে’। দেশের সর্বত্র যেমন চট্টগ্রামের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যাল-চুয়েটে ঘটেছে একই ঘটনা সেখানে দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দিয়ে চলে যায় বাস। সাভাবিকভাবেই ছাত্ররা সড়ক অবরোধ করে। ঘটনাটির তাৎক্ষনিক ও আইনানুগ পদক্ষেপে না গিয়ে সরকার একাডেমিক কাউন্সিলের মাধ্যমে বন্ধ করে দেয় চুয়েট। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অন্যায় অত্যাচারে জর্জড়িত। একই সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গেস্টরুমে অন্যায় অত্যারের ভুক্তভোগীরা তদন্ত কর্তৃপক্ষ বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিতেও ভয় পায়। এই সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় ৭১ হলে ছাত্রলীগের গেস্টরুম অত্যাচারে অচেতন হয়ে পরেন এক শিক্ষার্থী। জানা গেছে এই ঘটনা তদন্তে কমিটির কাছে ডাকলেও জাননি ঐ শিক্ষার্থী। সাভাবিক ধারনা ছাত্রলীগের চাপে তিনি মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করছে তারই নমুনা এই ঘটনা।

অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানা গেছে যে, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই আর প্রশাসনের বা শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রনে নেই। কোন হলের কোন কক্ষে কে থাকবেন, কে হলে উঠতে পারবেন, কে পারবেন না-এর সবকিছুই নির্ধারন করে দেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগের নেতারা। সব বিশ্ববিদ্যালয় সব হলের একই চিত্র। উদাহরন হিসাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট্ট একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। একবার আমার এক স্বজন আমার কাছে হলে উঠবার ব্যাপারে সহায়তা চায় সে ছিল অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। সুতরাং সে হলে থাকার অধিকার অনেক আগেই অর্জন করেছে। আমি অনুমান করছিলাম যে, ছাত্রনেতারাই সীট বন্টন করেন। আমি তাকে পরামর্শ দিলাম সে যেন অমুক অমুক ছাত্র নেতার সাথে যোগাযোগ করে। সে সেইসব ছাত্রনেতাদের কাছে ঘোরাঘুরি করে ব্যর্থ হল। আমার ধারনা ছাত্রলীগ না করার কারনে তার সীট হয়নি। আমার স্বজনটি বলল আপনি প্রভোস্টকে বলুন। আমি অবশ্য প্রভোস্টের অযোগ্যতা, অক্ষমতা, ও ব্যক্তিত্বহীনতার কথা জানতাম। তবুও যেহেতু সে অনুরোধ উপরোধ করছে, আমি প্রভোস্টকে শক্তভাবে বললাম। সে প্রভোস্টের কাছে গেল। আমার অনুমান সত্য। প্রভোস্ট নিজে সেই ছ্ত্রা নেতাদের কাছে এই ছাত্রটিকে পাঠালো, যার কাছে ঘোরাঘুরি করে ইতিপূর্বে তার সীট হয়নি। পরে অবশ্য আমার অনুরোধে অন্য হলে অবৈধভাবে তার ব্যবস্থাটি হয়েছিলো। এই হলো সাধারণ চিত্র। মজার ব্যাপার ছাত্র নেতাদের সীট দখল একটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো। একবার দখল নিলেই হলো। বছরের পর বছর শুনলে হাসবেন ১২ বছর হয়ে গেছে এমন ছাত্রনেতাও আছে। ছাত্রনেতারা পরীক্ষা দেয় না। নেতৃত্ব হারাবার ভয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেক বিভাগ আছে, যেখানে ভর্তি হওয়া সহজ। যেমন লাইব্রেরী সাইন্স। এখন আবার বিভিন্ন বিভাগে সান্ধকালীন কোর্স খোলা হয়েছে। তাদের বৈধভাবে হলে থাকার অধিকার না থাকলেও ঐ অজুহাতকে কাজে লাগিয়ে ছাত্রনেতারা বছরকে বছর কাটিয়ে দেন। আরও মজার ব্যপার সিঙ্গেল সীট বা ডাবল সীটেড কক্ষগুলোর দিকে ছাত্রনেতাদের সখ বেশি। তারা এককভাবে এসব কক্ষে অনেক অনেক অন্যায়-অপকর্ম চালাতে থাকেন। সংবাদ পত্রে প্রায়ই দেখা যায় যে কাউকে জিম্মি করে চাঁদা আদায় অথবা রাজনৈতিকভাবে গুম হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এসব কক্ষগুলোতে ঐসব কাজে ব্যবহার করা হয়। শুনলে অবাক হবেন যে, এক একটি হলে ছাত্রলীগের এক একটি গ্রুপ আদিপত্য বিস্তার করে। প্রতিপক্ষের সাথে সম্ভাব্য আক্রমন প্রতিহত করার জন্য এমনও ঘটেছে যে বিশেষ বিশেষ যায়গার ছাত্রদেরকে বিতারন করা হয়েছে। সেই কক্ষগুলো তারা দখলে নিয়েছে। মরার উপর খারার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে গনরুম কালচার। এসব রুমে একটি অথবা কয়েকটি কক্ষে অনেক ছাত্র গাদাগাদি করে থাকে। ছাত্রনেতাদের সমর্থনের ডেন হিসাবে এগুলো ব্যবহৃত হয়। বিক্ষোভ কিংবা হামলায় তাদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। না গেলে সীট হারানো এবং নির্মম শাস্তির উদাহরন এবং মৃত্যু ঘটার উদাহরনও রয়েছে।

অঘটন ঘটলে বা সংবাদ পত্রে কোনও প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিককালের দূঃখজনক ঘটনাটি। স্বামীকে বের করে দিয়ে স্ত্রীকে ধর্ষন করার ঘটনাটি সর্বত্র নিন্দিত হয়েছিলো। এরকম ছোটখাটো ঘটনায় প্রশাসন কর্তৃত্ব গ্রহণের প্রয়াস চালায়। বিপদে পরলে ছাত্রনেতারাও সাময়িককালের জন্য তা মেনে নেয়। কিন্তু কয়েকদিন চলে গেলে যেই সেই। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গত ৫ বছরে অন্তত ৫ বার সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। শিক্ষকরা বা প্রশাসন নিয়ন্ত্রন নিতে ব্যর্থ হয়েছে বার বার।

এতো গেলো ছাত্রদের অবস্থা। এবার শিক্ষকদের অবস্থা দেখা যাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এককালে ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মানের উদাহরন ছিলো। ১৯৯১ সালের গনতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর এই অবস্থা ক্রমশ নাজুক থেকে নাজুকতর হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যায়ে বিএনপি আমলে শিক্ষকদের খানিকটা তেজ লক্ষ করেছি। একটি ঘটনা মনে পরে যেখানে একজন প্রভাষক সরকারের একজন মন্ত্রীকে মুখোমুখী চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। সেই তেজ আজ নিঃশেষ নিস্তেজ হয়ে গেছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একরম নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শাসক দলের পক্ষ থেকে। কখনও কখনও ‘রাজা যা বলে পারিসদ বলে তার শতগুন’ উদাহরনও রয়েছে। ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বর্তমান সরকারকে পরামর্শ দেন যে, নির্বাচন না করে ই তারা জাতীয সংসদের মেয়াদ বাড়িয়ে দিতে পারে । নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুসের বিরুদ্ধে যখন সরকার ব্যবস্থা নেয়। তখন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত বিশ্ব নেতৃত্ব এর প্রতিবাদ জানায়।

বাংলাদেশের বসংবদ বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যাল থেকে বিবৃতির ঝড় তুলে এই মহান ব্যক্তিত্বের অপমান করে। সরকারের যেকোন সিষয়ে যদি বিতর্ক সৃষ্ঠি অন্ধভাবে এই বসংবদ শিক্ষককুল সমর্থনে এগিয়ে আসে-তা ন্যায় বা অন্যায় হোক না কেন। এভাবে তারা যে বিবেককে বিক্রি করছেন এজন্য তাদের মধ্যে তেমন কোন অহমবোধ লক্ষ করিনি। বরং নিজের নামটি বিবৃতিতে ছাপা হলো কিনা তা নিয়ে গর্বের উল্লাশ রেখেছি। প্রতি সাম্প্রতিক প্রকাশিত অনুসন্ধিতসু প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পদ নীল দলের কবজায়। প্রতিবেদন ছাড়াই বলা যায় যে অন্য সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের একই অবস্থা। জুতো সেলাই থেকে পবিত্র সবই তারা করবেন। বিরোধী তো দুরের কথা। নিরপেক্ষ লোকদেরও কোনো যায়গা নেই কোথাও।

গত ৩০ এপ্রিল দৈনিক প্রথম আলোতে একটি খবর ছাপা হয়েছে। এতে শিরোনাম ছিলো এররকম-‘বুয়েটে পর্দার আড়ালের অপ রাজনীতি বন্ধ চান ছাত্রলীগ সমমনার ষোলজন’। এত বলা হয় গত বছর টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মী সন্দেহে গ্রেফতার বুয়েট শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে চলমান মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্য়ন্ত তাদের সাময়িক বহিস্কার করতে হবে। একই সঙ্গে তারা বুয়েটে ‘পর্দার আড়ালের অপরাজনীতি’ বন্ধ করারও দাবী তুলেছেন। শাসক ছাত্রলীদের তরফ থেকে এ বিবৃতির আয়োজন করা হয়। স্মরন করা যেতে পারে যে টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে শিবির সন্দেহে গ্রেফতার ব্যক্তিদের নামে সরকারের বিরুদ্ধে ‘গোপন ষড়যন্ত্র ও জননিরাপত্তপ বিঘিœত করার আশংকায়’ সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা করেছিলো পুলিশ। বর্তমানে দেশের সর্বত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিবির চিহ্নিত করে প্রতিপক্ষ দমনের অসংখ্য উদাহরনের সৃষ্টি হয়েছে। ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে গোষ্ঠীগত স্বার্থ সর্বত্রই এই অপকৌশল গ্রহন করা হয়। একটি আনন্দময় ভ্রমনকে কিভাবে নিরানন্দে রুপান্তরিত করা হয় টাঙ্গুয়ার হাওরের ঘটনা তার একটি নিকৃষ্ট উদাহরন। সম্প্রতি বুয়েটে ছাত্রলীগের দখলদারিত্ব যায়েজ করার জন্য সেখানে সন্ত্রাস ও বেআইনী রাজনীতি আবিষ্কারের চেষ্টা হয়েছে। সেখানে সরকারের উচ্চ পর্য়ায়ের ব্যক্তিগনও অংগ্রহন করেছে। মিথ্যাকে সত্যে পরিনত করার প্রয়াসে তাদের কোন চেষ্টার ঘাটতি নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদাধিকারী হলেন ভাইস চ্যাঞ্চেলর। তাদের কু-কীর্তির যে নমুনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তাতে বলতে লজ্জা করে যে আমিও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই পদে দায়িত্ব পালন করেছি। ভিসিরা আচরন করছেন আওয়ামী লীগের নেতার মতো। একজন ভাইস চ্যাঞ্চেলর তো বলেই ফেললেন যে, তিনি এই পদের চেয়ে যুবলীগের সভাপতি হওয়াকে শ্রেয় মনে করেন। আরেকজন ভাইস চ্যাঞ্চেলর লজ্জা শরমের বালাই না রেখে প্রকাশ্যেই বললেন, চাকুরীতে ছাত্রলীগের অগ্রাধিকার রয়েছে। নিয়োগ কেলেঙ্কারি, স্বজনপ্রীতি, দূর্নীতি ও সেচ্ছাচারে এসব ভাইস চ্যাঞ্চেলররা নতুন রেকর্ড করেছে। আবারও একই কথা কির্তীমানদের কৃতি প্রকাশ করতে কাগজ ফুরিয়ে যাবে। একটি সর্বশেষ উদাহরন দিয়ে শেষ করতে চাই। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় অসহযোগ আন্দোলনে রয়েছেন শিক্ষক সমিতি। ৩০ এপ্রিল প্রকাশিত প্রতিবেদনের একটি অংশ এরকম-এ ঘটনায় উপাচার্য়, কোষাদ্যক্ষ, প্রক্টর ও ছাত্রলীগের সাবেক ১৭ জন নেতাসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে কুমিল্লার সদর দক্ষিন মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ করেছি শিক্ষক সমিতি। এতে অভিযোগ করা হয়, উপাচার্য় আবদুল মইন প্রতœতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোঃ মোরশেদ রায়হানের পেটে ঘুষি মারেন এবং পিছন দিক দিক থেকে কনুই দিয়ে আঘাত করেন। এরপর উপচার্য়ের সঙ্গে থাকা সন্ত্রাসীরা উপুর্য়পুরি মোরশেদ রায়হানের পেটে ঘুষি মেরে প্রশাসনিক ভবনে প্রবেশ করেন। অন্তত ২০ জন শিক্ষক সেখানে হামলার শিকার হন। এর চেয়ে উৎকৃষ্টঃ উদাহরন আর কি হতে পারে?

দেশের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি বা বেসরকারি সর্বত্রই একই ঘটনার অবতারনা ঘটছে। পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় দখল থেকে হেন অন্যায় অপকর্ম নেই যে এই সরকার করছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্রলীগের অন্যায় অপকর্ম ও ধর্ষনের চারনভুমিতে পরিনত হয়েছে। শিক্ষকরা শক্তভাবে কুমিল্লার মতো অবস্থান নিতে পারছে না। সর্বত্রই বন্দনা, প্রশস্তি ও প্রসংশা প্রতিযোগিতা। জ্ঞানী লোকেরা বলে থাকেন মাছের পচন ধরে মাথা থেকে। এদের পচন ধরেছে তাও মাথা থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য় ও শিক্ষকদের সরকার বন্দনা অনেক সময় ফেরীওয়ালাদের লজ্জা দেয়। সত্যিকার বিবেকের বন্ধনে আবদ্ধ বুদ্ধিজীবীদের এধরণের বন্দনার প্রতিবাদ করতে হবে। সেই বহুল উচ্চারিত পদ্য দিয়ে শেষ করি ‘রিপুর তারনে যখনি মোদের বিবেক পায় গো লয়, আত্ম গ্লানির নরক অনলে তখনি পুড়িতে হয়’।

https://www.dailysangram.info/post/555058