২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১০:০৭

অতি উচ্চঝুঁকিতে শিশুরা

তাপপ্রবাহে ইউনিসেফের সতর্কতা : বিভিন্ন স্থানে ডায়রিয়া

দেশে মাসজুড়ে চলা তাপপ্রবাহের কারণে স্বাস্থ্যগত অতি উচ্চঝুঁকিতে আছে শিশুরা। গতকাল এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট। একইসাথে বর্তমান পরিস্থিতিতে সন্তানদের পানিশূন্যতা থেকে রক্ষা ও নিরাপদ রাখার জন্য বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের জন্য অভিভাবকদের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চলমান এই তাপপ্রবাহসহ জলবায়ু পরিবর্তনের আরো ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শিশুদের রক্ষা করার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার এখনই সময়। অস্বাভাবিকভাবে তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় আমাদের আগে শিশু ও সবচেয়ে অসহায় জনগোষ্ঠীকে নিরাপদে রাখার প্রতি নজর দিতে হবে।

ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ‘অতি উচ্চঝুঁকিতে’ রয়েছে শিশুরা। অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে শিশুদের জন্য। বিশেষ করে নবজাতক, সদ্যোজাত ও অল্পবয়সী শিশুদের জন্য। হিটস্ট্রোক ও পানিশূন্যতাজনিত ডায়রিয়ার মতো, উচ্চতাপমাত্রার প্রভাবে সৃষ্ট অসুস্থতায় শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে।

প্রসঙ্গত, চলতি মাসের শুরু থেকেই দেশব্যাপী বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। শুরুতে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ থাকলেও ক্রমে তা তীব্র থেকে অতি তীব্র হয়ে উঠেছে। এমনিতে এপ্রিল বছরের উষ্ণতম মাস; তবে অন্যান্য যেকোনো বছরের চেয়ে অনেক বেশি উত্তাপ ছড়াচ্ছে এবারের মাসটি। অসহনীয় গরমে এক পশলা বৃষ্টির জন্য হাঁসফাঁস করছে জনজীবন।

মাসের এখনো বাকি সপ্তাহখানেক, এরই মধ্যে কয়েক দফায় হিট অ্যালার্ট জারি হয়েছে দেশে। মাসের মাঝামাঝি এসে প্রতিদিন মরুর দেশগুলোর তাপমাত্রাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে দেশের কোনো কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা।

টানা এই তাপপ্রবাহকে অস্বাভাবিক বলছেন আবহাওয়াবিদরা। আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক বলেছেন, গত এক দশক থেকেই এপ্রিল মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি থাকছে তাপমাত্রা। এপ্রিল মাসের গড় স্বাভাবিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৩.২। তবে এবার এপ্রিলে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। অধিকাংশ জায়গায় তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রির ওপরে থাকছে।

এমন পরিস্থিতিতে শিশুদের ওপর অসহনীয় গরমের নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে সারা দেশে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। জলবায়ুর ক্রমবর্ধমান বিরূপ পরিবর্তনে শিশুদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউনিসেফও।

তাপপ্রবাহ থেকে শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সুরক্ষার জন্য সম্মুখসারির কর্মী, বাবা-মা, পরিবার, পরিচর্যাকারী ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রতি বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে ইউনিসেফের পক্ষ থেকে।

বলা হয়েছে, শিশুরা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের বসা ও খেলার জন্য ঠাণ্ডা জায়গার ব্যবস্থা করুন। তপ্ত দুপুর ও বিকেলের কয়েক ঘণ্টা তাদের বাড়ির বাইরে বেরোনো থেকে বিরত রাখুন। শিশুরা যেন হালকা ও বাতাস চলাচলের উপযোগী পোশাক পরে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে সারা দিন তারা যেন প্রচুর পানি পান করে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। যদি কোনো শিশু বা অন্তঃসত্ত্বা নারীর মধ্যে ‘হিট স্ট্রেস’ বা তাপমাত্রাজনিত সমস্যার উপসর্গ দেখা দেয় (যেমন, মাথা ঘোরা, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, বমি বমি ভাব, হালকা জ্বর, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, মাংসপেশিতে টান, ডায়াপার পরার জায়গাগুলোতে ফুসকুড়ি) তাহলে তাকে একটি ঠাণ্ডা জায়গায় নিয়ে যান, যেখানে ছায়া এবং পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের সুযোগ আছে। এরপর ভেজা তোয়ালে দিয়ে তার শরীর মুছিয়ে দিন বা গায়ে ঠাণ্ডা পানি দিন। তাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি বা খাবার স্যালাইন পান করতে দিন। হিট স্ট্রেসের (তাপমাত্রাজনিত অসুস্থতার) উপসর্গ তীব্র হলে (যেমন কোনো কিছুতে সাড়া না দিলে, অজ্ঞান হয়ে পড়লে, তীব্র জ্বর, হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলে, খিঁচুনি দেখা দিলে এবং অচেতন হয়ে পড়লে) তাৎক্ষণিক হাসপাতালে নিতে হবে।

তাপপ্রবাহ চলাকালে অসহায় পরিবার, প্রতিবন্ধী শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও প্রবীণ ব্যক্তিরাই সবার আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন, এমনকি মৃত্যুর উচ্চঝুঁকিতেও তারাই বেশি থাকেন। আপনার প্রতিবেশী, বিশেষ করে যারা একা থাকেন, তাদের খোঁজ নিন ও খেয়াল রাখুন।

বরগুনায় হাসপাতাল মেঝেতে শতাধিক ডায়রিয়া রোগী
বরগুনা প্রতিনিধি জানান, উপকূলে তীব্র তাপপ্রবাহের বাড়ার সাথে সাথে বরগুনায় ডায়রিয়ার প্রকোপও বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শতাধিক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী বরগুনা সদর হাসপাতালসহ জেলার পাঁচ উপজেলার বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেগুলোতে ভর্তি হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা সিভিল সার্জন প্রদীপ চন্দ্র মণ্ডল।

বরগুনা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে ৫২ জন, আমতলীতে ১৭ জন, তালতলীতে ছয়জন, পাথরঘাটায় সাতজন, বামনায় পাঁচজন, বেতাগীতে আটজন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। গত এক সপ্তাহে জেলায় ৭৬২ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।

বরগুনা সদর হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ শিশু ও বয়স্ক মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শয্যাসঙ্কটের কারণে হাসপাতালের মেঝে ও করিডোরে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছে।

চৌগাছায় হাসপাতালে তিন গুণ বেশি রোগী
চৌগাছা (যশোর) সংবাদদাতা জানান, যশোরের চৌগাছা হাসপাতালে নেই ডায়রিয়া ওয়ার্ড তীব্র গরমে ধারণক্ষমতার তিন গুণ রোগী ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু হাসপাতালে ধারণক্ষমতার তিন গুণ রোগী থাকায় ভ্যাপসা গরমে রোগীরা আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সিট না পাওয়ায় দুর্ভোগ আরো বেড়েছে।

বুধবার (২৪ এপ্রিল) সরেজমিন হাসপাতালে গিয়ে জানা যায়, চৌগাছা ৫০ শয্যার এ হাসপাতালে মহিলা ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩৮, পুুরুষ ওয়ার্ডে ২৩ ও শিশু ওয়ার্ডে ২৪ জন, মোট ৮৫ জন। এর মধ্যে ঠাণ্ডা-গরমজনিত সর্দিজ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগী রয়েছেন। মোট রোগী রয়েছে ৮৫ জন। তীব্র তাপপ্রবাহে শিশু ও বৃদ্ধরা বেশি অসুস্থ হচ্ছেন।

হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) ডা: আল ইমরান বলেন, মূলত গরমের তীব্রতা বাড়ায় এখন ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিচ্ছে। সাথে সর্দি-জ্বরসহ তাপপ্রবাহজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে রোগীরা ভর্তি হচ্ছেন।

হাসপাতালের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: লুৎফুন্নাহার বলেন, মূলত গরমের তীব্রতা বাড়ায় এখন ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিচ্ছে। সঙ্গে সর্দিজ্বরসহ তাপপ্রবাহজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে রোগীরা ভর্তি রোগীর চাপ বাড়লেও আমাদের লোকবল কম।

কাউখালীতে জ্বর ও ডায়রিয়ার প্রকোপ
কাউখালী (পিরোজপুর) সংবাদদাতা জানান, পিরোজপুরের কাউখালীতে তীব্র তাপপ্রবাহে ভাইরালজনিত জ্বর, ডায়রিয়া, আমাশয়সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুসহ নানা বয়সের মানুষ। লাগাতার তাপ প্রবাহে চরম দুর্ভোগে জনজীবন। বেশি বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। এ অবস্থায় বেড়েছে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিন ডায়রিয়া, পেট ব্যথা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে সকল শ্রেণিপেশার মানুষ। বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তি ও শিশুরা এসব রোগে আক্রান্ত বেশি হচ্ছে। ২৪ এপ্রিল বুধবার দুপুরে কাউখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় পাঁচজন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়েছে। গড়ে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচজন করে ডায়রিয়া রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। প্রচণ্ড গরমের কারণে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন ভবন না থাকার কারণে ডাক্তাররা চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে ডায়রিয়ার রোগীদের আলাদা কোনো কক্ষ নেই।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/830385