২২ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ১২:২৯

চোরাই পথে অবাধে দেশে ঢুকছে ভারতীয় নিম্নমানের চিনি

দেশে ঢুকছে ভারতীয় নিম্নমানের চিনি। সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে আসছে এসব চিনি। এস আলম ও ইগলু ব্র্যান্ডের চিনিসহ দেশের বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির ব্যান্ডের নামে এসব চিনি বাজারজাত করা হচ্ছে। অধিক মুনাফা লাভের আশায় চট্টগ্রাম নগরীর চাক্তাই-খাতুন গঞ্জ এলাকার অসাধু ব্যবসায়ীরা এ চিনি নিয়ে আসছেন। ওই দেশ থেকে শুল্ক ফাঁকি মাধ্যমে আনা হচ্ছে এ চিনি। সাধারণ ভোক্তা ছাড়াও বিভিন্ন, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও ছোট-বড় বেকারিতে বিক্রি করা হচ্ছে ভারতের নিম্নমানের এই চিনি।

দোকানিদের কাছে পাইকারিতে বিক্রি করা হয় এ চিনি। দরে-দামে মিলে গেলে দোকানের ঠিকানায় ট্রাক ও কাভার ভ্যানে এ চিনি পাঠানো হয়। দোকানিরদের পছন্দ অনুয়ায়ী এ চিনি পাঠানো হয় দেশীয় ব্র্যান্ডের কোম্পানির বস্তায় করে। আবার কোনো ব্র্যান্ড ছাড়া সাদা-কালো বস্তায়ও এসব দোকানিদের কাছে পাঠানো হয়। দোকানিরা জানেন ভারত থেকে এসব চিনি আনা হয়েছে। তবে কিভাবে ভারত থেকে আনা হয়েছে, কোন গুদামে রাখা হয়েছে, কিভাবে বস্তা পরিবর্তন করা হয়েছে- এসব বিষয় অন্ধকারে থাকে দোকানিরা।

চাক্তাই-খাতুন গঞ্জের পাশে নগরীর রাজাখালী এলাকায় ন্যাশনাল ময়দার মিলের গোদামে ১০ থেকে ১২ ট্রাক ভারতীয় চিনি মজুদ করা হয়েছে সপ্তাহ খানেক আগে। শনিবার চাক্তাই মকবুল আলী রোডে এক ট্রাক ভারতীয় দেখা দেখা গেছে। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে চাক্তাই, আসাদগঞ্জ, খাতুন গঞ্জ ও বাকলিয়ার এলাকার বিভিন্ন গোদামে এসব চিনি মজুদ করা হচ্ছে।

গতকাল রোববার দেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে দেশীয় চিনি পাইকারিতে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৫০০টাকা। ভারতের চিনি ব্রিক্রি হয় ৫ হাজার ৯০০টাকায়। দেশে উৎপাদিত চিনি থেকে পাইকারিতে প্রতি বস্তায় ৫শ’ থেকে ৭শ’ টাকা কমে বিক্রি করা হয় ভারতের এ চিনি।

এতে পাইকারি ও খুচরা ব্যবাসায়ী লাভবান হলেও প্রতিনিয়ত ঠকছেন ক্রেতা সাধারণ। দেশের ভালোমানের চিনির দামে ভোক্তাদের দেওয়া হচ্ছে নিম্নমানের ভারতের এ চিনি। দেশীয় চিনির তুলনায় ভারতের এ চিনি কালো ও মোটা দানা। নিম্নমানের এ চিনি বাসা-বাড়ি নিয়ে গেলে ঘেমে নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া ভালভাবে পরিশোধন না হওয়ায় দেখতে কালো লাগে এ চিনি।

র‌্যাব জানায়, দীর্ঘদিন যাবৎ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ভারতীয় চিনি আমদানি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তারা অবৈধভাবে মজুদ রেখে অধিক মূল্যে বিক্রয় করে আসছে। এ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রামে অবৈধ পন্থায় আমদানিকৃত ৫০০ বস্তা (২৫ মেট্রিকটন) ভারতীয় চিনিসহ মো. বোরহান আলমদার (২৭) একজন অসাধু ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। ২০ এপ্রিল রাত আনুমানকি ০৩২০ ঘটিকায় নগরীর বাকলিয়া থানাধীন মধ্যম চাক্তাই চালপট্টি এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার বোরহান পটিয়া থানাধীন আলমদার পাড়ার মো. আমিন শরীফের ছেলে। উদ্ধারকৃত ভারতীয় চিনির আনুমানিক মূল্য সাড়ে ৩৭ লাখ এসময় চিনি পরিবহনে ব্যবহৃত লরি জব্দ করা হয়।

র‌্যাব-৭ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মো. নূরুল আবছার জানান, চাক্তাই চালপট্টি এলাকায় শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ভারতীয় চিনি আমদানি করে বিক্রি করার তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে বোরহান আলমদারকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে ৫০০ বস্তা (২৫ মেট্রিকটন) চিনিসহ একটি লরি জব্দ করা হয়। উদ্ধার করা চিনির আনুমানিক মূল্য সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা।

গ্রেফতারকৃত আসামিকে দীর্ঘদিন যাবৎ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ভারতীয় চিনি আমদানি করতঃ অবৈধভাবে মজুদ রেখে অধিক মূল্যে বিক্রয় করে আসছে বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে গ্রেফতার ওই ব্যবসায়ীকে নগরীর বাকলিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানান এই র‌্যাব কর্মকর্তা।

এছাড়া একমাস আগে চলতি বছরের ২৩ মার্চ ভোরে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা পৌর এলাকা থেকে ২২ বস্তা ভারতীয় চিনিসহ দুই যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা গ্রেফতারকৃতরা হলেন উপজেলার তবলছড়ি ইউপির সিংহপাড়ার মাসুম রানা (২১) ও আল আমিন (১৯) । একই সঙ্গে চিনি বহনকারী একটি পিকআপ গাড়ি ও একটি টোল আদায়ের রশিদ জব্দ করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেন খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মুক্তা ধর জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মাটিরাঙ্গা পৌরসভার পূর্বধলিয়া এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে ২২ বস্তা চিনিসহ দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের করে বিধি মোতাবেক আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ।
এ বছরের ১৮ মার্চ রাতে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা ইসলামপুরে ৩ লাখ টাকার ৪৫ বস্তা চিনিসহ দুই চোরাচালানকারিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন-রামগড় গর্জন টিলার মীর হোসেনের ছেলে মোশারফ হোসেন (২৫) ও পানছড়ি-টিএন্ডটি এলাকার মশিউর রহমানের ছেলে মোমিনুল ইসলাম (১৮)। যার বর্তমান বাজার মুল্য ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা। একই সাথে চিনি বহন কারি একটি ট্রাক (ঢাকা মেট্রো ট ২২-৬৩৬২) জব্দ করা হয়। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে পুলিশ সুপার মুক্তা ধর জানান, গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়েছে। বিধি মোতাবেক যথা সময়ে তাদের বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হয়।

২০২৩ সালের ২৬ মার্চ খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে ৭ হাজার কেজি ভারতীয় চিনিসহ দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গোপন সংবাদে শনিবার গভীর রাতে ১৪০টি বস্তা ভরতি চিনিসহ একটি ট্রাক এবং বাবুধন চাকমা ও জিয়া মিয়া নামের দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয় বলে খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. নাঈমুল হক জানান। এসপি জানান, ভারতের মিজোরাম রাজ্যের উদয়পুর সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে চিনি আনার দায়ে ওই দুজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

একই বছরের ১৮ মে খাগড়াছড়িতে চোরাইপথে আসা ৬০০ কেজি চিনিসহ ওসমান গণি নামে একজন চোরাকাবারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পানছড়ি উপজেলার হাছান নগর এলাকার বাসিন্দা তিনি। পুলিশ জানায়, ১৮ মে দিনগত রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জেলা শহরের স্বনির্ভর বাজার এলাকায় অভিযান চালানো হয়। এ সময় শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ভারতীয় অবৈধ চিনি আনা ও বহন করার দায়ে ওসমান গনিকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে সদর থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে চোরচালানের সঙ্গে জড়িত থাকা কথা স্বীকার করেন। এ ঘটনায় রাতেই সদর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করা হলে সেই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে আদালতে পাঠানো হয়।
ওই বছরের ২ জুন রাতে খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার দুদুকছড়া এলাকা থেকে ৬৫ বস্তা ভারতীয় চিনিসহ একটি ট্রাক্টর জব্দ করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এ সময় চারজনকে আটক করা হয়। আটকরা হলেন- ট্রাক্টরচালক পানছড়ির দমদম গ্রামের আবুল খায়ের ৪৫), মোল্লাপাড়া গ্রামের শহিদ দেওয়ানের ছেলে জসিম (৩০) ও বাবুল মিয়া (৪০) এবং মধ্যনগর গ্রামের আব্দুল কাদেরের ছেলে মো.রাকিব (২২)। জানা যায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শুক্রবার দিবাগত রাতে লোগাং বিওপির ক্যাম্প কমান্ডার নায়েব সুবেদার ধনঞ্জয় কুমারের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়। এ সময় ট্রাক্টরসহ ৬৫ বস্তা ভারতীয় চিনি, চালক, হেলপারসহ চারজনকে আটক করে। পানছড়ি থানার ওসি মো. হারুন রশিদ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, আটকদের মামলার মাধ্যমে খাগড়াছড়ি আদালতে পাঠানো হয়।
এভাবে প্রতিদিন অবৈধভাবে দেশে ঢুকছে ভারতীয় নি¤œমানের চিনি। কোনো কোনো চালান আটক হচ্ছে। আবার বেশিরভাগ চালান প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে দেশে ঢুকে যাচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা। এসব চিনি ব্রিক্রি করে হঠাৎ বড় লোক হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। প্রতিনিয়ত ঠকছেন ভোক্তা সাধারণ। নি¤œমানের চিনি খেয়ে শরীরে বিভিন্ন রোগ-বালাই সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

https://www.dailysangram.info/post/554217