৪ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৪:৪১

আর্থিক খাত বন্ধ্যাত্বের পথে

দেশে স্বপ্নের পদ্মা সেতু, চোখ ধাঁধানো মেট্রোরেল, কর্ণফুলী ট্যানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ রাজধানী ঢাকায় অসংখ্য ফ্লাইওভার দেখা গেলেও অর্থনীতি চলে গেছে একেবারে তলানিতে। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। রিজার্ভ তলানিতে, রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ায় ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে, মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষ, দেশি-বিদেশি সংস্থার গবেষণায় আর্থিক সঙ্কটে পড়ে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত একবেলা খাবার কমিয়ে দিয়েছে; পুষ্টিহীনতায় ভুগছে বিপুল সংখ্যক মানুষ, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে বিদেশি বিনিয়োগ তলানিতে ঠেকেছে; শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। প্রায় দুই বছর ধরে ডলার সঙ্কটের সুরাহা হয়নি, কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে গেছে, জাহাজ না আসায় বন্দরগুলো বন্ধের পথে, প্রচণ্ড দাবদাহে বিদ্যুৎ সঙ্কট, বিদ্যুৎ সঙ্কটে শিল্প কারখানায় উৎপাদন কমে গেছে। শেয়ারবাজারের অবস্থা শোচনীয়। বিদেশিরা ইতোমধ্যে তাদের বিনিয়োগে তুলে নিয়েছে। রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) কমছে, মিশ্র রফতানি প্রবৃদ্ধি, খেলাপি ঋণ বাড়ছে, বিদেশি ঋণ এবং ঋণের সুদ বাড়ছে এবং ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ার মধ্যেই রাজস্ব আয় কয়ে যাওয়ায় আর্থিক খাতের সব সূচকই নিম্নমুখী। ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দেশীয় সামষ্টিক অর্থনীতিতে চলমান সঙ্কটের নেতিবাচক প্রভাব আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। আর্থিক খাতের লেজেগোবরে অবস্থা দেখে গত জাতীয় নির্বাচনের আগেই অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবং আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, অর্থনীতিকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসাটাই হবে নতুন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, চলতি অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি কম হবে। মূলত বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এছাড়া এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেটাও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যেমন: সরকার আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ চলমান রয়েছে। ব্যাংক ঋণে সুদহার বাড়ানো হয়েছে। ফলে উচ্চ সুদে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ায় আগ্রহ থাকছে না। আবার মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল প্রভৃতি আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে বিনিয়োগ ও উৎপাদন কমে যাচ্ছে। প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডের অর্থনীতির প্রফেসর ড. বিরূপাক্ষ পাল এক নিবন্ধে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সাবেক কর্মকর্তা ঝানু অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে তার অনেক গবেষণাধর্মী লেখা রয়েছে। সম্প্রতি তিনি তার এক নিবন্ধে বলেছেন, দেশ এখন শতকরা ৮-৯ শতাংশ জাতীয় প্রবৃদ্ধি নিয়ে নীতিমালা সাজানোর কথা। অথচ দেশ এখন মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে ধন্য। তিনি বলেছেন, অর্থনীতিতে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল আমদানি কমানো। বিশেষত মূলধনী সামগ্রীর আমদানির গলা টিপে ধরে অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা কমানো হয়েছে।

গত মঙ্গলবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে। একই সঙ্গে চলতি বছর মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। অবশ্য বিশ্বব্যাংক গত জানুয়ারিতেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই পূর্বাভাস দিয়েছিল। এছাড়া বাণিজ্য ঘাটতি, আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও সঙ্কটে ফেলছে। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ গত কয়েক দশক ধরে যে গতিতে এগোচ্ছিল তাতে বর্তমানে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ন্যূনতম দুই অঙ্কে থাকার কথা। অথচ গত কয়েক বছর ডলার সঙ্কট নিরসনে আমদানি কমিয়ে দেয়া হয়েছে। বিশেষত মূলধনী সামগ্রীর আমদানি কমিয়ে অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা কমানো হয়েছে। একই সঙ্গে শিল্পে কাঁচামাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি বন্ধ করায় নতুন শিল্প কারখানা গড়ে তো উঠেইনি বরং কাঁচামাল সঙ্কটে অন্যান্য উৎপদনশীল খাতও বন্ধের পথে। এতে স্বল্প মেয়াদে প্রবৃদ্ধি কমার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে এতে স্বল্প মেয়াদে প্রবৃদ্ধি কমার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতিকে সঙ্কটের মুখে ফেলে দিয়েছে। এদিকে ব্যাংক ঋণের সুদহার হু হু করে বৃদ্ধি পেয়ে মাথাব্যতার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের মধ্যে। সুদহার নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন একটি নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করছে। এর ফলে ঋণের সুদ এখন প্রতি মাসেই বাড়ছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকে ঋণের সর্বোচ্চ সুদ ছিল ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। মার্চে তা বেড়ে হয় ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ। আর এপ্রিলে বেড়ে দাড়াবে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশে। সরল ক্রমবৃদ্ধি পদ্ধতিতে এই হার এখনই দাড়াবে ১৭ শতাংশে। যা ব্যাংকিংখাতের জন্য অশনিসঙ্কেত বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ এই সুদে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে পারবেনা গ্রাহক। তাই আবারও সেই ২০১৩-১৪ সালের ঋণের মতো সব খেলাপি হয়ে পড়ার শঙ্কা আছে। দেশের ব্যাংকিংখাত এখনো সেই ২০১৩-১৪ সালের ১২-১৩ শতাংশ ঋণের বোঝা বহন করছে। এর আগে ঋণের ওপর সর্বোচ্চ সুদের হার নির্ধারিত ছিল ৯ শতাংশ। বেঁধে দেওয়ার ওই পদ্ধতি থেকে সম্প্রতি সরে আসে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করার ফলে এখন প্রতি মাসেই ঋণের সুদ বাড়বে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এতে বিপাকে পড়বেন ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তাসহ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতারা। কারণ, নতুন করে ব্যাংকঋণ নিতে গেলেই গুনতে হবে অতিরিক্ত সুদ। এমনতিতেই কাঁচামাল, গ্রাস-বিদ্যুসহ অন্যান্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে ব্যবসার খরচও বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ সঙ্কট চরমে। অপরদিকে তীব্র তাপদাহ শুরু হয়েছে দেশে। আবহাওয়া অদিদফতর ইতোমধ্যে সতর্ক করেছে এ বছর তীব্র তাপদাহ পড়ার। আর তাই বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। তাই আগামী দিনে শিল্পে বিদ্যৎ সরবরাহও কঠিন হয়ে পড়বে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যেও এক ধরণের স্থিতিবস্থা তৈরি হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম পারভেজ তমাল ইনকিলাবকে বলেন, ঋণের সুদহার বাড়ায় ব্যবসায়ী-ব্যাংকার সবাই বিপাকে। কারণ এই সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীকে তা ফেরত দিতে হবে। যা আসলে এক কথায় ব্যবসায়ীদের জন্য অসম্ভব। এতে ব্যাংকগুলোও ঋণ দেয়া কমিয়ে দিবে। আর যারা বিভিন্ন চাপে ঋণ পাবে তাদের জন্য ব্যবসা করে সুদসহ আসল পরিশোধ করা কঠিন হবে। এতে আগামীতে খেলাপি আরও বাড়বে বলে মত দেন তিনি। একই সঙ্গে ঋণের সুদহার বাড়ায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এখন আমানতের ওপর সুদের হারও বাড়িয়েছে। তারল্য সঙ্কটে থাকা ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহে এক অর্থে প্রতিযোগীতায় নেমেছে। যাও ব্যাংকিং খাতের জন্য অশনিসঙ্কেত বলে মনে করেন তিনি।

তথ্য মতে, ব্যাংকগুলো বর্তমানে তারল্য-সংকটে ভুগছে আর তাই কলমানির সুদের হার ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। কল মানিতে এক দিনের জন্য টাকা কর্জ বা ধার দেওয়ার ক্ষেত্রে গড় সুদের হার প্রায় ১০ শতাংশে উঠেছে। ২০১২ সালের পর কল মানির সর্বোচ্চ সুদহার চলছে। ওই বছর ১২ দশমিক ৮২ শতাংশে উঠেছিল সুদহার। এদিকে বর্তমান সময়ে রফতানি প্রবৃদ্ধিকেই ধরা হচ্ছে একমাত্র আশার আলো। সমাপ্ত মার্চ মাসে দেশে পণ্য রফতানি থেকে আয় এসেছে ৫ হাজার ১০২ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যদিও মার্চ মাসে পূরণ হয়নি রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা। এ মাসে বাংলাদেশের রফতানি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ১৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বলা হচ্ছে পোশাক খাতের রফতানিতেও প্রবৃদ্ধি। অথচ রফতানি আয়ের প্রধান এই খাতটির সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দিতে পারছেনা কারখানাগুলো। ইতোমধ্যে অনেকে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। অনেকগুলো বন্ধের পথে। আবার অনেকে বলছে, অর্ডার বন্ধ তাই কাজ নেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। এছাড়া পোশাক রফতানির প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্রে কমেছে রফতানি। এমনকি পোশাকখাত শ্রম আইনসহ নানাবিধ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নিষেধাজ্ঞার শঙ্কায় রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্টরা অনেকেই বলছেন, তাহলে রফতানিতে প্রবৃদ্ধি, এই প্রবৃদ্ধি কোথায় গেলো। এমনকি রফতানি আয়ের তথ্য নিয়ে প্রশ্ন রাখেন।

ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের নৈতিক মানদন্ডে বর্তমান সরকারকে দুর্বল সরকার বলে নতুন সরকারকে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে উত্তরণে বেশ কিছু ক্ষেত্রে শক্ত চ্যালেঞ্জের কথা আর্থিকখাতের বিশ্লেষকরা বার বার তুলে ধরেছেন। চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেছিলেন। যা নিতে পারলে দেশের রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, রাজস্ব ও ব্যাংক খাত নিয়ে বর্তমানের এই ভয়াবহ উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হতো না।

অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, নির্বাচনের পর দ্রব্যমূল্য, মুদ্রা বিনিময় হার ও ব্যাংক ঋণের সুদের হারে মনোযোগ দিতে হবে। আর খেয়াল রাখতে হবে ব্যাংক বা কোন খাতে যেন কাঠামোগত সঙ্কট না হয়। আবার বৈদেশিক দায় দেনা পরিশোধের ক্ষেত্রেও যেন কোন সমস্যা তৈরি না হয়। অথচ নতুন সরকারের কয়েক মাস যেতে না যেতে ব্যাংক খাত সঙ্কটে পড়েছে। রিজার্ভ কমে যাচ্ছে, ঈদের মাসেও রেমিট্যান্স কমেছে, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক পিছিয়ে, বৈদেশিক দায় দেনা পরিশোধ চাপে ন্যুজ্ব হয়ে পড়ছে সরকার। দ্রব্যমূল্যের অতিরিক্ত চাপে মানুষ্ট পিষ্ট হচ্ছে। খাবার এক বেলা কমিয়ে দিচ্ছে। খাদ্য তালিকা থেকে পুষ্টিকর খাবার বাদ দিয়েছে অনেক মানুষ। আর তাই দেশের অর্থনীতির সব সূচকেই বন্ধ্যাত্বের মত অবস্থা হয়েছে। আর্থিকখাতের অন্যতম নির্ধারক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড় হিসাবে এখনও নিম্নমুখী রয়েছে। বড় কোনো দেনা পরিশোধ করলেই রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। সবসময় ঈদের সময় রেমিট্যান্স বাড়লেও এবার ঈদের মাসে রেমিট্যান্স কমেছে। এদিকে চলতি বছরের মার্চ মাসেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী নিট বা প্রকৃত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখতে পারেনি বাংলাদেশ। আইএমএফ বাংলাদেশকে যে ঋণ দিয়েছে, তার শর্ত অনুযায়ী মার্চের শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রকৃত রিজার্ভ থাকার কথা চিল ১ হাজার ৯২৬ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু প্রকৃত রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের কম। আইএমএফের এসডিআর খাত, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে রাখা ডলার ও এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিলের জন্য জমা থাকা ডলার বাদ দিয়ে যে হিসাব হয়, সেটিই প্রকৃত রিজার্ভ। এর বাইরে রিজার্ভের আরও দুটি হিসাব রয়েছে। তার একটি হলো, মোট রিজার্ভ। আরেকটি আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রক্ষিত রিজার্ভ।

সূত্র মতে, সরকারি ও বেসরকারি ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। কিন্তু মাথা ব্যাথার কারন হিসেবে দেখা দিয়েছে ঋণের সুদ পরিশোধ। সুদ আগে ১-২ শতাংশ থাকলেও তা ৮-৯ শতাংশ পর্যন্ত ছুঁয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে আরো কয়েকটি ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু করতে হবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম আট মাসে সরকার সুদ ও আসলসহ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ২০৩ কোটি ডলার। এর মধ্যে সুদ ৮০ দশমিক ৫৯ মার্কিন ডলার এবং আসল ১২২ দশমিক ৪০ কোটি ডলার। অথচ গত বছরের একই সময় অর্থাৎ প্রথম আট মাসে বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণ পরিশাধ করেছিল ১৪২ দশমিক ৪১ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ৮ মাসে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে ৬১ কোটি ডলার। এদিকে ব্যাংক ঋণের সুদহার হু হু করে বৃদ্ধির মধ্যে অর্থনীতির আরেক সূচক বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধিও কমে আবার ১০ শতাংশের নিচে নেমেছে। আগের বছরের একই মাসের তুলনায় গত জানুয়ারি শেষে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। আর গত বছরের জানুয়ারিতে ছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। যা দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসঙ্কেত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
অবশ্য বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে চার ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। এগুলো হলো- উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক খাতের ঝুঁকি। বৈশ্বিক এই প্রতিষ্ঠান সে কারণে পূর্বাভাস দিয়েছে যে চলতি বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। সংস্থাটির মতে, এ বছর প্রবৃদ্ধি কমে হতে পারে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে সরকার চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সাড়ে ৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, এক বছর ধরেই সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে আছে। যদিও এই হিসাব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। বাস্তবে সার্বিক মূল্যস্ফিতী অনেক আগেই দুই অঙ্কের ঘরে। অবশ্য আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও মূল্যস্ফীতির হিসাব পদ্ধতিতে গরমিল আছে বলে উল্লেখ করেছে। ফলে সংশ্লিষ্টদের মতে, জিডিপি ও মূল্যস্ফীতির যে তথ্য প্রকাশ হচ্ছে, সেগুলোয়ও বাস্তব চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে না। হিসাব পদ্ধতির ত্রুটির কারণে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বেশি দেখানো হচ্ছে। একই কারণে মূল্যস্ফীতির হার দেখানো হচ্ছে কম। বিভিন্ন সময়ের অর্থনীতির প্রধান এ দুটি সূচকেরই হিসাব পদ্ধতিতে ব্যাপক সংস্কার আনার প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি। এদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ চাপে আছে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়নে, তিন কারণে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। কারণগুলো হলো টাকার অবমূল্যায়ন, ডলার-সঙ্কটে আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং জ্বালানিসঙ্কট ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেছেন, একদিকে আমদানি কমে এসেছে, অন্যদিকে রপ্তানি আয় বেড়েছে। এ কারণে ডলারের দাম কিছুটা কমেছে। তবে আবার বাড়তে শুরু করেছে। সামনে বোঝা যাবে বাজার কোনদিকে যায়। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় টাকার জোগান দিচ্ছে। এতে টাকার সরবরাহ কিছুটা বাড়লেও স্বাভাবিকতা ফিরেনি।

https://dailyinqilab.com/national/article/649652