১৬ মার্চ ২০২৪, শনিবার, ১:০৬

ক্ষত নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে গ্রিন কোজি কটেজ

বেইলি রোড। যেন এক মৃত্যুপুরি। ৪৬ জনের তরতাজা প্রাণ। অনেক আশা। অনেক স্বপ্ন। প্রিয়জনকে না বলা অনেক কথা। শত স্বজনের চোখের পানি। সবকিছু পুড়িয়ে নিজেও পোড়া কঙ্কাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ। ভেতরে ঘোর অন্ধকার। পোড়া চেয়ার-টেবিলের স্তূপ।

প্রবেশ পথে ভাঙা কাঁচের টুকরো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পোড়া কয়লা। গ্যাস সিলিন্ডার। আশপাশে সুনসান নীরবতা। লোকজন কম। সামনে ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি নেই। দু-একটা রিকশা চলছে। তাও পুলিশের বাধা। যেন আগুনের ক্ষত এখনো সারেনি। প্রতিদিনকার চিরচেনা আড্ডা আর হই-হুল্লোড় কিছুই নেই সেখানে। গতকাল দুপুরে বেইলি রোডের সড়ক জুড়ে সেই ক্ষতই চোখে পড়েছে। ভয়ঙ্কর সেই রাতের পর ১৫ দিন পেরিয়ে গেছে। এখনো বেইলি রোড তার চেনা জৌলুসে ফিরতে পারেনি। কবে স্বাভাবিক হবে বেইলি রোড। কবে বিচার হবে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের। ঘটনাস্থলে আগতদের কেউ কেউ সেই প্রশ্ন রাখছেন। গ্রিন কোজি কটেজের সামনে এখনো পুলিশি ব্যারিকেড আছে। ক্রাইম সিন ফিতা দিয়ে ঘিরে রাখা আছে ভবনটি। ভবনটির নিচে পাহারায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য। সবাই সজাগ। কড়াকড়ি ব্যবস্থা। ভবনের সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে অনেক মানুষ। কেউ আসেন নিছক কৌতূহল থেকে। কেউ আসছেন পোড়া ভবনে একান্ত আপনজনের স্মৃতির খোঁজে। তবে কাউকেই পরিত্যক্ত ভবনে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।

সরজমিন দেখা যায়, শান্তিনগর মোড় থেকে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ পর্যন্ত রাস্তা একদম ফাঁকা।মাঝেমধ্যে পুলিশের গাড়ি যাচ্ছে। ভবনের সামনের দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা দাঁড়িয়ে ওই গাড়িকে সেলুট দিচ্ছেন। রাস্তায় তেমন মানুষের আনাগোনা নেই। গাড়ির চাপও লক্ষ্য করা যায়নি। অথচ অন্য বছরগুলোতে রোজার শুরুর দিন দুপুরের পর থেকেই এই রাস্তায় মানুষ ও গাড়ির ভিড় লেগে থাকে। বসে হরেক রকম ইফতারি বিক্রির মেলা। এ বছরের পরিস্থিতিটা একদম ভিন্ন। ভবনের ফটকে নিহতদের স্মরণে লাগানো আছে ২০ থেকে ৩০টি ব্যানার। ব্যানারে নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে নানা বাণী লেখা আছে। ছয়তলা ওই ভবনটিতে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট ছাড়াও, স্যামসাংয়ের শোরুম, গ্যাজেট অ্যান্ড গিয়ার, ইলিন, খানাস ও পিৎজা ইন ছিল।

ভবনের সামনে দায়িত্বরত পুলিশ কনস্টেবল রাসেল মিয়া বলেন, স্বজনরা অনেকে এসে আবেগি হয়ে ভবনে ঢুকতে চায়। এখানে ঢুকে কী কোনো লাভ আছে। তবে স্যারদের আদেশ আছে, কাউকেই এই ভবনে ঢুকতে দেয়া যাবে না। কেউ যদি পারমিশন নিয়ে আসতে পারে তাকে ঢুকতে দিবো।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন আগুনে নিহত স্বজনদের কেউ না কেউ আসেন। তারা এসে ভবনের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ আবার ভবনের সামনে এসে প্রিজনের জন্য অশ্রু ফেলেন। আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। গতকাল দুপুর ১টার দিকে পোড়া ভবনের সামনে দেখা গেল আগুনে নিহত শুল্ক গোয়েন্দা তদন্ত অধিদপ্তরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শাহজালাল উদ্দিনের বাবা আবুল কাশেমকে। তিনি ছেলের জন্য বিলাপ করছেন। পরিবারের লোকজন তাকে ধরে রেখেছেন। ভবনে ঢোকার চেষ্টা করছেন। আবুল কাশেম বলেন, আমি কোথাও শান্তি পাচ্ছি না। বাসায় থাকতে পারছি না। পরাণ অস্থির লাগে। ছোট ছেলেকে বললাম আমাকে বেইলি রোডে নিয়ে যাও। এখানে এসে ভেতরে ঢুকতে চাইছিলাম। পুলিশ ঢুকতে দিলো না। এখন এত নিরাপত্তা কেন। আগে যদি এই নিরাপত্তা থাকতো, তাহলে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটতো না। আর এত মানুষও মারা যেতো না। ঘটনার আগের দিন আমার ছেলের সঙ্গে কথা হয়। তারপর আর কোনো কথা হয়নি। জীবনে আর কথা হবে না, এটা মনে পড়লে চোখ বেয়ে পানি চলে আসে। দুুপুরে হাবিবুর নামের এক ব্যক্তি এসে তার বন্ধুর স্মৃতিচারণ করছেন। ২৯শে ফেব্রুয়ারি আগুনে নিহত ভোলা সদর উপজেলার উত্তর দিঘলদী ইউনিয়নের চরকুমারিয়া গ্রামের মো. নয়ন হোসেন তার বন্ধু। বন্ধুর অকাল প্রয়াণে ভবনের মালিকদের প্রতি ক্ষোভ ঝাড়ছেন তিনি। বলছেন, এই বিল্ডিংয়ে চায়না রেস্টুরেন্টে কাজ করতো নয়ন। পরিবারের হাল ধরতে প্রথমবার ঢাকায় এসেই আগুনে পুড়ে মারা যান নয়ন। নয়নের মৃত্যুর পর তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ভবন মালিককে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান হাবিবুর।

উল্লেখ্য, গত ২৯শে ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে আগুনের ঘটনা ঘটে যেখানে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে অনুমোদন নিলেও সেখানে রেস্তরাঁ করার অনুমতি ছিল না। কিন্তু আট তলা ওই ভবনে ব্যবসা করছিল ১৪টি রেস্তরাঁ ও খাবারের দোকান। ভবনটিতে ছিল না কোনো অগ্নিনির্গমন পথ। একমাত্র সিঁড়িতে রাখা ছিল গ্যাস সিলিন্ডারসহ রেস্তরাঁর মালামাল। কাঁচে ঘেরা ভবনের উপরের ফ্লোরগুলো থেকে নামতে না পেরে ধোঁয়ার বিষক্রিয়ায় এ বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় রমনা থানায় একটি মামলা হয়েছে। পুলিশ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠিয়েছে। মামলাটি প্রথমে ডিবি তদন্ত করলেও পরে সিআইডিকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে কি জন্য আগুন লেগেছে সেই বিষয়টি এখনো অজানা রয়ে গেছে।

https://mzamin.com/news.php?news=101919