২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, শনিবার, ১১:৫১

নিয়ন্ত্রণহীন চালের বাজারে আবারো অস্থিরতার শঙ্কা ॥ দিশেহারা ক্রেতা

এইচ এম আকতার: চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। চালের প্রতি বস্তায় দাম ও জাত লেখা বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। ফলে হঠাৎ করেই কেউ চালের দাম বাড়াতে পারবে না। এদিকে সেদ্ধ চাল রপ্তানিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে করে দেশের চালের বাজারে আবারও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দেশের বাজারে সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত বছরের আগস্টে চাল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। ওই সময় বলা হয়েছিল, চলতি বছরের অর্থাৎ মার্চ মাসের ৩১ তারিখ পর্যন্ত এই শুল্ক জারি থাকবে। কিন্তু গত বুধবার জানানো হয়, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত এই শুল্ক জারি থাকবে।

গত দুই বছর ধরে ভারতের মানুষও উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে রয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে ভারতের খুচরা মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ১ শতাংশে নামলেও খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৩ শতাংশ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, চলতি বছর লোকসভা নির্বাচনের আগে ভারতের ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদি সরকার বেশ কিছু ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও তাদের অস্বস্তির জায়গা একটি। সেটা হলো বাজারে পণ্যের দাম। সে জন্য পেঁয়াজের পাশাপাশি বাসমতী ভিন্ন অন্যান্য সাদা চালের রপ্তানিতে শুল্ক আরোপ করেছে সরকার। খোলাবাজারে বিক্রির জন্য সরকারি গুদামে শস্যের মজুতও বাড়ানো হচ্ছে।

চাল রপ্তানিতে শুল্ক আরোপ করা হলেও চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল মোদি সরকার। গত মঙ্গলবার তারা আবার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, সেই সময় এগিয়ে আনার প্রশ্ন নেই, বরং নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরও বাড়ানো হতে পারে। তবে জি টু জি পেঁয়াজ রফতানি করতে পারবে।

ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর, ভারতের বাজারে সম্প্রতি এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে যে পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হচ্ছে। এর জেরে ভারতের বৃহত্তম পেঁয়াজ বাজার মহারাষ্ট্রের লাসালগাঁওয়ের পাইকারি বাজারে মাত্র দুই দিনের মধ্যে পেঁয়াজের দাম ৪০ শতাংশের বেশি বেড়ে যায়। ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রতি কুইন্টাল পেঁয়াজের দাম ছিল ১ হাজার ২৮০ রুপি; ১৯ ফেব্রুয়ারি তা ১ হাজার ৮০০ রুপিতে উঠে যায়।

পাইকারি ব্যবসায়ীদের দাবি, নাসিক থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি শুরু হলে ভবিষ্যতে পেঁয়াজের পাইকারি ও খুচরা দাম বাড়তে পারে। এ ধরনের গুজব যাতে আর বাজারে ছড়াতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে কোমর বেঁধে নেমেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রীয় ক্রেতা সুরক্ষা সচিব রোহিত কুমার সিংহ ভারতের গণমাধ্যমকে বলেছেন, পেঁয়াজের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়নি এবং সেই ব্যবস্থায় পরিবর্তনও আনা হয়নি।

সামগ্রিকভাবে পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বাংলাদেশসহ ছয় দেশে সীমিত পরিমাণে পেঁয়াজ রপ্তানি করবে বলে জানিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, এসব দেশে সরকারি পর্যায়ে (জিটুজি) পেঁয়াজ রপ্তানি করা হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে দেশটির কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সংবাদে বলা হয়েছে। তবে কী পরিমাণে পেঁয়াজ রপ্তানি হবে, কিংবা কবে থেকে রপ্তানি হবে, সে ব্যাপারে ভারতীয় গণমাধ্যম কিছু জানাতে পারেনি। যেসব দেশে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি করবে সেই দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মরিশাস, বাহরাইন, ভুটান ও নেপাল।

এদিকে পর্যাপ্ত সরবরাহের পরও চালের বাজারে অস্থিরতা কাটছে না। আমন মৌসুমেও বেড়েছে চালের দাম। গত এক মাসের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) চালের দাম বেড়েছে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিলার ও মৌসুমি ধান ব্যবসায়ীদের কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর এই বাড়তি দর পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা সমন্বয় করছেন। ফলে চাল কিনতে বেশি টাকা খরচ হওয়ায় ক্রেতাসাধারণ দিশেহারা হয়ে পড়ছে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক বাজার পণ্য মূল্য তালিকায় এই দর লক্ষ্য করা গেছে। এখন রাজধানীর খুচরা বাজারে একজন ক্রেতাকে প্রতিকেজি চাল (মোটা জাতের) কিনতে ৫০ টাকা গুনতে হচ্ছে। টিসিবি বলছে, মাসের ব্যবধানে প্রতিকেজি মোটা চাল ২ দশমিক ১৫ শতাংশ বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর গত বছর একই সময়ের তুলনায় বিক্রি হচ্ছে ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি দরে। পাশাপাশি মাঝারি আকারের প্রতিকেজি চাল মাসের ব্যবধানে ৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ ও গত বছর একই সময়ের তুলনায় ১ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর সরু চাল মাসের ব্যবধানে ১ দশমিক ৫৯ ও গত বছর একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।

জানতে চাইলে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, গত বছর থেকেই চালের দাম বাড়তি। সবার ধারণা ছিল আমন মৌসুমে দাম স্বাভাবিক হবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে চাল। তাই ক্রেতা তথা নিম্ন আয়ের মানুষের আরও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। চাল কিনতে অতিরিক্ত এই ব্যয়ের প্রভাব অন্যান্য চাহিদার ওপর পড়ছে। তাই চালের দাম কমাতে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। তদারকি জোরদার করতে হবে। অনিয়ম পেলে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

নওগাঁ ও কুষ্টিয়ার মিল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিল পর্যায়ে প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৩০০০ টাকা, যা এক মাস আগেও ২৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া বিআর-২৮ চাল প্রতিবস্তা বিক্রি হচ্ছে ২৫৫০-২৬০০ টাকা, যা এক মাস আগে ২২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ বস্তায় এই জাতের চালের দাম ৪০০ টাকা বেড়েছে। রাজধানীর কাওরান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক ও পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, মিলারদের কারসাজিতে পুরো বছর ধরে চালের দাম বাড়তি। নানা অজুহাতে তারা দাম বাড়িয়েছে। কখনো সরবরাহ সংকট, আবার কখনো ধানের দাম বেশি বলে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ আমন মৌসুমে সংকটের কথা বলে আবারও চালের দাম বস্তায় সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে বেশি দামে কিনে পাইকারি পর্যায়ে বেশি টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। তিনি জানান, যে মিনিকেট চালের বস্তা এক মাস আগে ২৮০০ টাকায় বিক্রি করতাম, তা এখন ৩১০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। পাশাপাশি বিআর-২৮ চাল পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি করতাম ২২০০ টাকা, যা এখন ২৪০০-২৪৫০ টাকায় বিক্রি করছি। ফলে খুচরা বাজারে চালের দাম বেড়েছে।

তিনি আরও জানান, এতদিন শুধু মিলারদের কারণে চালের দাম বেড়েছে। এবার যুক্ত হয়েছে মৌসুমি ধান বিক্রেতা। তারা করোনাকালে অন্যান্য ব্যবসায় ধরা খেয়ে ধান ব্যবসায় ঝুঁকেছে। কৃষকের কাছে কম দামে ধান কিনে বাসাবাড়িতে এমনকি গোপনে গোডাউন ভাড়া নিয়ে ধান মজুদ করে রেখেছে। কারণ চাল মজুদ করা যায় না। নষ্ট হয়ে যায়। আর ধান নষ্ট না হওয়ায় মজুদ করে রাখা যায়। যে কারণে মজুদকৃত ধান বিক্রি করছে বাড়তি দরে। ফলে এই বাড়তি দরের প্রভাব চালের বাজারে গিয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশ মেজর ও অটো মেজর হাসকিং মিল মালিক সমিতির সহ-সভাপতি ও মিল মালিক শহীদুর রহমান পাটোয়ারী মোহন জানান, চালের দাম বাড়লেই আমাদের দোষ হয়। কিন্তু এখন ধানের দাম বাড়তি থাকায় চাল প্রসেসিংয়ে বেশি টাকা খরচ হচ্ছে। যে কারণে মিল পর্যায় থেকে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। তিনি জানান, কৃষকদের পাশাপাশি ধানের মৌসুমি ব্যবসায়ী এখন ধান মজুদ করছে। দাম বেশি না হলে তারা বাজারে ছাড়ছেন না। এ কারণে বাজারে ধানের দাম বেড়েছে। তার প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে।

রাজধানীর খুচরা বাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিকেজি সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকা। বিআর-২৮ চাল প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকা। মোটা জাতের মধ্যে স্বর্ণা চাল প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা। রাজধানীর কাওরান বাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা হাবিবুল্লাহ বলেন, চালের দাম বাড়ায় অন্যান্য তরিতরকারি কিনতে টানাটানি পড়ছে। কিন্তু বাজারে কোনো ধরনের চালের সংকট নেই। দোকানগুলোতে থরে থরে সাজানো চালের বস্তা। কিন্তু কিনতে হচ্ছে বাড়তি দরে। জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, মিল থেকে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে তদারকি হচ্ছে। কোনো অনিয়ম পেলে কঠোর আইনের আওতায় আনা হবে।

এদিকে চালের প্রতি বস্তায় দাম ও জাত লেখা বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। আগামী ১৪ই এপ্রিল থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক এ বিষয়ে পরিপত্র জারি করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে- চালের প্রতিবস্তা সরবরাহের আগে উৎপাদনকারী মিলের নাম, জেলা ও উপজেলার নাম, উৎপাদনের তারিখ, মিল গেট মূল্য এবং চালের জাত উল্লেখ করতে হবে। এই তথ্যগুলো ছক মোতাবেক লিখতে মিলারদের নির্দেশনা দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই নির্দেশনা দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে মিল গেট দামের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান চাইলে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য উল্লেখ করতে পারবে। সকল জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকসহ খাদ্য পরিদর্শকরা এটি নিশ্চিত করতে পরিপত্রে নির্দেশনা দেয়া হয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে ‘খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ, বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন-২০২৩’ এর ধারা ৬ ও ৭ মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তারা নিতে পারবেন। আগামী ১৪ই এপ্রিল থেকে এই নির্দেশনা অবশ্যিকভাবে পালন করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

পরিপত্রে আরও বলা হয়েছে, খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে চাল উৎপাদনকারী কয়েকটি জেলা পরিদর্শন করে নিশ্চিত হওয়া গেছে- বাজারে একই জাতের ধান থেকে উৎপাদিত চাল ভিন্ন ভিন্ন নামে ও দামে বিক্রি হচ্ছে। চালের দাম অযৌক্তিক পর্যায়ে গেলে বা অকস্মাৎ বৃদ্ধি পেলে মিলার, পাইকারি বিক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা একে-অপরকে দোষারোপ করছেন। এতে ভোক্তারা ন্যায্যমূল্যে পছন্দমতো জাতের ধান, চাল কিনতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এমন অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে চালের বাজারমূল্য সহনশীল ও যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে ধানের নামেই চাল বাজারজাতকরণের কথা উল্লেখ করা হয়।

https://www.dailysangram.info/post/549662