২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, শনিবার, ১১:৩৭

বাজারে অস্থিরতা ও জনদুর্ভোগ

-ইবনে নূরুল হুদা

বাজারে অস্থিরতা কোনভাবেই থামছে না বরং যতই দিন যাচ্ছে ততই সার্বিক পরিস্থিতির অবনতিই হচ্ছে। এতে জনদুর্ভোগ বাড়লেও সংশ্লিষ্টদের কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা অনেক লম্বা-চওড়া কথা শোনালেও তা অনেকটা ‘বজ্র অঁাঁটুনি, ফস্কা গেরো’র মতই শোনাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাজারে রীতিমত শনির আছর পড়েছে। নিত্যপণ্যের মূল্য লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে থাকলে তা কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না বা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে না। বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এ বিষয়ে নির্লিপ্ততা ও উদাসীনতা পুরো পরিস্থিতিকে জটিল ও অস্থির করে তুলেছে। বস্তুত, বাজারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই বরং বাজার চলছে মোটামুটি স্বশাসনে। দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি জনমনে এক নতুন আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে কোন সদুত্তর মিলছে না।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, বাজারে আলু, পেঁয়াজ ও রসুনের দাম কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ নানা পদক্ষেপের গালগল্প শোনানোর পরও লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে এসব নিত্যপণ্যের দাম। শেষ পর্যন্ত দাম নিয়ন্ত্রণে ভারত থেকে আলু আমদানি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। ফলে রাজধানী পাইকারী ও খুচরা বাজারে আলুর দাম কেজিতে ১০ থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত কমেছে। অন্যদিকে পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে দাম না কমে উল্টো বাড়ছে। খুচরা পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম শতক পেরিয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ২০ রুপির বেশি নয়। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খুচরা পর্যায়ে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা কেজিতে। দাম নিয়ন্ত্রণে রোজার আগেই ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। রসুনের দাম করোনা মহামারির সময় থেকেই বেড়েছে। যে রসুন ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতো সেই রসুনের দাম করোনার সময় অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে গেছে। রসুন এখন ২০০ টাকা থেকে ২১০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। রসুন আমদানির জন্য আমরা চীনের উপর নির্ভরশীল। তাই করোনার সময় যে দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে ডলার সঙ্কটের কারণে আমদানি বিঘ্ন ঘটায় এ পণ্যের দাম কমছে না বলে ব্যবসায়ীরা জানান। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে আমদানি নয় বরং বাজার তদারকি এবং উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে দরকার। কিন্তু কে শোনে কার কথা। মূলত, সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় বাজার পরিস্থিতিতে মারাত্মক অবনতি ঘটিয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুয়ায়ী, গত অর্থ বছরে দেশের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ আলু উৎপাদিত হয়েছে। পেঁয়াজ-রসুনের উৎপাদনও হয়েছে বেশ ভাল। এ বছর কৃষকরা রেকর্ড ১ কোটি ৪ লাখ টন আলু উৎপাদন করেছেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। দেশে আলুর চাহিদা ১ কোটি টন। সে ক্ষেত্রে আলু আমদানি করতে হয় কেন? এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর মিলছে না কারো কাছেই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, দেশের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ আলু উৎপাদিত হয়েছে। বর্তমানে দেশে আলুর কোন ঘাটতি নেই। আলুর এই বাড়তি দামের জন্য তারা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে দায়ী করেন। তারা বলছেন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের (ডিএনসিআরপি) মতো দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর বাজার পর্যবেক্ষণের অভাবে পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যাচ্ছে। পেঁয়াজ এবং রসুনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। উৎপাদন পর্যাপ্ত হওয়ার পরও এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী কারসাজি করে এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করছেন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যথাযথভাবে বাজার মনিটরিং হলে আমদানি না করেও আলু-পেঁয়াজের দাম ভোক্তাদের নাগালে রাখা সম্ভব। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধার মত কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের হিসাব অনুযায়ী আলুর উৎপাদন চাহিদার চেয়ে বেশি। তাহলে এটা আমদানি করতে হবে কেন? আসলে বাজার ব্যবস্থাপনা যথাযথ না হওয়ায় এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ইচ্ছে মত দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। মূলত, বাজারে চলছে সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতা। ফলে জনদুর্ভোগ কোনভাবেই পিছু ছাড়ছে না।

এ বছর দেশে রেকর্ড ১ কোটি ৪ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জ্ঞাত হওয়া গেছে। দেশে আলুর চাহিদা ১ কোটি টন। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হলেও বাজারে আলুর দাম কমছে না। ফলে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। তবে ভারত খেকে আমদানির ফলে আলুর দাম এখন কেজিতে ১০ টাকা কমে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসায়ী ও কৃষকরা শীতে বিক্রির জন্য হিমাগারে আলু মজুদ রাখেন। তারা ধীরে ধীরে তাদের মজুদ থেকে আলু বাজারে ছাড়েন। সেপ্টেম্বরে আলু রোপণের পর তা সংগ্রহ করতে ৯০ দিন সময় লাগে। জানুয়ারিতে ফসল তোলার পর পরবর্তী কয়েক মাস বাজারে আলুর সরবরাহ নিশ্চিত থাকে। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, জুনের মধ্যে হিমাগারে মজুদ আলু ছেড়ে দেওয়া হয়। যাতে পরবর্তী মৌসুমের আলু তোলা পর্যন্ত বাজারে পুরনো আলু থাকে। বছরের এই সময় অন্যান্য সবজির দাম বেশি থাকায় আলুর চাহিদা বেড়ে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বার্ষিক উৎপাদন পরিসংখ্যান বলছে, আগের বছরের তুলনায় দেশে আলুর উৎপাদন ২ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেশি। বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১ কোটি টন।

তবে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএসএ) সরকারের এ তথ্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেছে, এবার আলুর উৎপাদন ৮০ লাখ টনের বেশি হবে না। বিসিএসএ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘আমরা সরকারি তথ্যের সঙ্গে একমত নই। কোল্ড স্টোরেজ ধারণ ক্ষমতার প্রায় ২০ শতাংশ খালি পড়ে আছে। তারা আরো বলছেন, যদি আলুর উৎপাদন বেশি হয়, তাহলে এই বাড়তি আলু কেথায়? ব্যবসায়ীরা আলুর মজুদ ছেড়ে দিচ্ছেন। তারা জানেন কৃষকের মজুদ শেষ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বড় ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে ভরা মৌসুমেও এবার আলু দাম বেড়েছে। এছাড়া অন্যান্য সবজির দাম বেশি হওয়ায় অনেকে আলু কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে দেশে আলুর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায়ও দামে প্রভাব পড়েছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সংশ্লিষ্টরা এ জন্য বাজার পর্যবেক্ষণের অভাব ও ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফার মানসিকতাকে দায়ী করেছেন। তারা বলছেন, যখন আলুর উৎপাদন বেশি, তখন এর বাড়তি দাম গ্রহণযোগ্য নয়।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোন কারণ ছাড়াই অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ৪০ টাকা পর্যন্ত। পণ্যটির এই ভরা মৌসুমেও দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীদের অজুহাত সরবরাহ সঙ্কট। বিষয়টিকে কেউই যৌক্তিক মনে করছেন না। কিন্তু তারপরও এই অজুহাতে গত জানুয়ারির শেষ দিকে এক দফা বাড়ানো হয়েছিল পেঁয়াজের দাম। এর আগে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলে প্রতিকেজি দেশি পুরোনো পেঁয়াজের দাম উঠেছিল ২৪০ টাকা পর্যন্ত। অপরিণত মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রি হয় ১৭০ টাকায়। কয়েক বছর ধরে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে বাড়া নিয়মিত ঘটনা হলেও ডিসেম্বর-জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে মূল্যবৃদ্ধি বিরল ঘটনা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাবি করছে, মুড়িকাটা পেঁয়াজ উৎপাদনের তথ্য পেলে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে। ভারত থেকে শিগগির পেঁয়াজ আমদানি হবে। তবে ক্রেতারা বলছেন, এবার পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য হয় না। কারণ, ডিসেম্বরে বাজারে আগাম জাতের মুড়িকাটা পেঁয়াজ উঠেছে। এই পেঁয়াজ বাজারে উদ্বৃত্ত থাকতে থাকতেই মূল পেঁয়াজ অর্থাৎ হালি পেঁয়াজ বাজারে আসবে। যাতে আগামী কয়েক মাসেও দেশে পেঁয়াজের সংকট হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। তাই এবারের দাম বাড়ার মূল কারণ ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার লোভ।

রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতিকেজি মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকায়। গত এক সপ্তাহ আগে দাম উঠেছিল ১৩০-১৪০ টাকা। তারও এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয় ৯০-১০০ টাকা। জানুয়ারি শেষে ঘন কুয়াশায় জমি থেকে পেঁয়াজ তুলতে না পারার কারণে সরবরাহ সঙ্কটের অজুহাতে দাম উঠেছিল ১২০-১২৫ টাকায়। জানুয়ারির প্রথমার্ধে ছিল ৮০-৯০ টাকা। ডিসেম্বরের শুরুতে পুরোনো দেশি পেঁয়াজ ২৪০ টাকা এবং দাম বেশি থাকায় অপরিণত মুড়িকাটা পেঁয়াজ ১৭০ টাকায় বিক্রি হয়। পরে মুড়িকাটা পুরোদমে বাজারে এলে দাম কমে ৬০-৭০ টাকা হয়েছিল।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, ডিসেম্বরে বাজারে ওঠে আগাম জাতের মুড়িকাটা পেঁয়াজ। এবার এই পিঁয়াজের উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ টনের বেশি। তুরস্ক ও মিসর থেকেও পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে দেশে প্রতি মাসে পেঁয়াজের চাহিদা দুই লাখ টনের সামান্য বেশি। এই হিসাবে দেশে এখন পেঁয়াজের যথেষ্ট মজুত আছে। চলতি মাসের শেষে ও আগামী মাসে উঠবে হালি পেঁয়াজ। এটির উৎপাদন আরও বেশি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ লাখ টন। চাহিদার ৮৫ শতাংশই দেশে উৎপাদিত হয়। গত বছর জুন পর্যন্ত দেশে ১০ লাখ ৯২ হাজার টন পেঁয়াজ মজুত ছিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সূত্র জানায়, এবার ৬৩ হাজার হেক্টর জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আবাদ হয় ৬৬ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে। হেক্টরপ্রতি সর্বনিম্ন ১৪ দশমিক ৭৯ টন পেঁয়াজ উৎপাদনের তথ্য এসেছে। কোনো কোনে জেলা হেক্টরপ্রতি প্রতি ২৫ টন হয়েছে। তবে গড়ে ধরা হচ্ছে ২০ টন। বিভিন্ন জেলার মোকাম, পাইকারি ও খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোথাও পিঁয়াজের সংকট নেই। পাবনা ও ফরিদপুরে পেঁয়াজ আছে।
দাম বাড়ায় পেঁয়াজ কেনার পরিমাণ কমিয়েছেন ভোক্তারা। এজন্য সাধারণ ভোক্তাদের অনেককেই খেদোক্তি প্রকাশ করতে দেখা গেছে। আমদানিকারকরা বলছেন, সরবরাহ সঙ্কটে দাম কিছু বেড়েছিল। শিগগির ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হবে। তিন-চার দিনের মধ্যে দাম কমে আসবে। কিন্তু কেন আমদানী করতে হবে আর দেশের পেঁয়াজের অভ্যন্তরীণ বাজার কেন এতো অস্থির তার কোন ব্যাখ্যা কারো কাছেই পাওয়া যাচ্ছে না।

দেশে গত এক দশকের ব্যবধানে রসুনের চাহিদা তিনগুণ বেড়েছে বলে ব্যবসায়ীরা দাবি করেছন। বিপরীতে উৎপাদন কিছুটা বাড়লেও সেটা চাহিদার তুলনায় কম। এতে বাড়ছে রসুনের আমদানি নির্ভরতা। ডলার সঙ্কটে বাড়ছে আমদানি খরচ। ভোক্তার পকেট থেকেও যাচ্ছে বাড়তি টাকা। ট্যারিফ কমিশনের সবশেষ তথ্য বলছে, দেশে বছরে ছয় লাখ টন রসুনের চাহিদা রয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি, বর্তমানে দেশে রসুনের চাহিদা প্রায় ৯ লাখ টন, যা এক দশক আগের তুলনায় তিনগুণ ছাড়িয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব বলছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে সাড়ে তিন লাখ টন রসুন উৎপাদন হয়। এক দশক বাদে এখন উৎপাদন ঠেকেছে ৫ লাখ ১৬ হাজার টনে। ঠিক একই সময়ের ব্যবধানে চাহিদা বেড়েছে তিনগুণের বেশি। কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নত জাতের অভাব, দীর্ঘমেয়াদি জীবনকাল ও উঁচু জমির ফসল বলে এ ফসলে খুব বেশি আগ্রহী নয় চাষিরা। আবার অনেক সময় উৎপাদন খরচের চেয়ে বাজারদর কম হওয়াও বড় কারণ।

আমাদের দেশে আমদানির ৯৬ ভাগ রসুন চীন থেকে আসে। চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর রসুনের আমদানি ভাটির টানের দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। আর বর্তমানে ডলার সঙ্কট আমদানির উপর বিরাট প্রভাব ফেলছে। ফলে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে রসুনের চাহিদা, আমদানির পরিমাণ ও উৎস দেশ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পাশাপাশি কোন দেশ থেকে এসব পণ্য আমদানি করা যায়, তার সুপারিশ করা হয়েছে।

ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বছরে রসুনের চাহিদা প্রায় ৬ লাখ টন। গত অর্থবছরে রসুন উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ৭ লাখ টন। সেখান থেকে পচে যাওয়া রসুনের হিসাব বাদ দিয়ে প্রকৃত উৎপাদন ধরা হয়েছে ৬ লাখ ২০ হাজার টন। রসুনের চাহিদার ১৩ থেকে ২০ শতাংশ আমদানি করতে হয় বলে মনে করে ট্যারিফ কমিশন। ট্যারিফ কমিশন হিসাব করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উৎপাদন পরিসংখ্যান ধরে। অবশ্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) যে হিসাব দেয়, তার সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বড় ফারাক দেখা যায়। যেমন বিবিএসের হিসাবে গত অর্থবছরে রসুনের উৎপাদন ৫ লাখ ৬০ হাজার টন, যা কৃষি মন্ত্রণালয়ের মূল উৎপাদনের হিসাবের চেয়ে ১ লাখ ৪০ হাজার টন কম।

ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে রসুনের মৌসুম ফেব্রুয়ারি মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত। টিসিবির হিসাবে, এক বছর আগের তুলনায় এখন রসুনের দাম ১৭৭ শতাংশ বেশি। তবে সবার চেয়ে এগিয়ে পেঁয়াজ। এক বছর আগের তুলনায় পেঁয়াজের দাম বেশি ৩২২ শতাংশ।

শুধু আলু, পেঁয়াজ বা রসুন নয় বরং পুরো বাজার পরিস্থিতিই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। দেশের আলুর উৎপাদন পর্যাপ্ত হলেও বাজারে অগ্নিমূল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পেঁয়াজ তো রীতিমত শোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। করোনাকালীন রসুনের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়লেও তা আর কমানো সম্ভব হয়নি। দেশে অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির বিষয়ে সরকার ও ব্যবসায়ী মহল যেসব যুক্তি ও কারণ প্রদর্শন করেন তা অনেকাংশেই সত্য নয়; বরং বাজারে সুশাসনের অভাব বাজার সিন্ডিকেটই মূলত এজন্য দায়ী।

এমতাবস্থায় দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা দরকার। একই সাথে বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। অন্যথায় জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা কোনভাবেই সম্ভব হবে না।

https://www.dailysangram.info/post/549613