২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, শুক্রবার, ৯:১১

রোজায় বাড়ছে বিদ্যুতের দাম

দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আগে সরকারি দলের নেতারা প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলো বিদ্যুতের ‘দাম বাড়বে না’। হয়তো সমন্বয় করা হবে। নির্বাচন শেষ, সরকার গঠন করা হয়ে গেছে। নতুন সরকারের ক্ষমতায় আসার দুই মাসের মধ্যে ঘোষণা করা হলো গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়নো হবে। সরকারের তিন মাস যেতে না যেতেই আবার বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে শিগগিরই প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে বিদ্যুৎ বিভাগ। আগামী মাস (মার্চ) থেকেই এটা কার্যকর হতে পারে। ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ব্যবহার বুঝে নির্ধারিত হয়। মাসে ১০০ ইউনিট পর্যন্ত, ১০১ থেকে ২০০ ইউনিট, ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত এভাবে বিভিন্ন শ্রেণির জন্য আলাদা আলাদা দর থাকে। কম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের জন্য প্রতি ইউনিটে ২৫ থেকে ৩০ পয়সা বাড়তে পারে। তবে যাঁরা সর্বোচ্চ ব্যবহারকারী অর্থাৎ মাসে ৬০০ ইউনিটের বেশি ব্যবহার করেন, তাদের জন্য প্রতি ইউনিটে ৭০ থেকে ৮০ পয়সা বাড়তে পারে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম বলেন, এ সময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হবে। দাম না বাড়িয়ে বরং দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমানোয় সরকারের নজর দেওয়া উচিত। দাম বাড়লে কৃষি, শিল্প, কলকারখানা গভীর সংকটে পড়বে। মধ্যম ও নি¤œ আয়ের মানুষরা এমনিতেই কঠিন কষ্টের মধ্যে দিনযাপন করছে। অনাহারে-অর্ধাহারে কোনোরকম জীবন কাটাচ্ছে। সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করে জনগণকে বিপদের মুখে ঠেলে দেবে।

গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হবে। এর সঙ্গে ভোক্তা পর্যায়েও কিছুটা সমন্বয় হবে। তবে ভোক্তাদের ওপর খুব বেশি প্রভাব যাতে না পড়ে, সেভাবেই বাড়ানো হবে। যারা বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন, তাঁদেরটা বেশি বাড়বে। তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম গ্রাহক পর্যায়ে বাড়লেও গ্যাসের দাম শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনেই বাড়বে। দ্রæত সময়ের মধ্যে আমরা জ্বালানির দাম সমন্বয় করতে চাই। বিদ্যুতের গ্রাহক পর্যায়ে দাম সামান্য পরিমাণে বাড়তে পারে। যারা বড় গ্রাহক তাদের দাম তুলনামূলক বেশি বাড়তে পারে। আমরা স্বাবলম্বী গ্রাহকদের ভর্তুকি দিতে চাই না। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়ে গেছে ডলারের রেট। আগে ডলার ৭৮ টাকায় পাওয়া যেতো, এখন প্রায় ১২০ টাকার মতো হয়ে গেছে। এক ডলারে প্রায় ৪০ টাকার মতো বেশি খরচ হচ্ছে। এতে বিশাল ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

জানা গেছে, গত বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রতি মাসে ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ করে বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। এর মধ্যে গত বছরের ফেব্রæয়ারি থেকে এক দফায় বাড়ে পাইকারি বিদ্যুতের দাম। এ নিয়ে গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও ভোক্তা পর্যায়ে ১৩ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে।

নির্বাহী আদেশে সর্বশেষ ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রæয়ারি খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়, যা ওই বছরের মার্চ থেকে কার্যকর হয়। গ্রীষ্ম মৌসুম সামনে রেখে সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। জ্বালানি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলার ও টাকার ঘাটতিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিলও বকেয়া রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। গত বছরের ১৮ জানুয়ারি শিল্পসহ অন্যান্য খাতে গ্যাসের দাম গড়ে ৮০ শতাংশ বাড়ানো হয়। এ সময় সবচেয়ে বেশি ১৭৮ শতাংশ বাড়ানো হয় বিদ্যুৎ খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম। এখন নতুন করে আবার শুধু বিদ্যুৎ খাতের জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানো হতে পারে বলে জানা গেছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতের জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১৪ টাকা। প্রতি ইউনিট গ্যাসের পেছনে সরকারের এখন খরচ হচ্ছে গড়ে ২৪ টাকা।

ঋণের শর্ত হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে ভর্তুকিমুক্ত করার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ রয়েছে। এ পটভ‚মিতেই বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। সঙ্গে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় দাম সমন্বয় পদ্ধতি চালু হচ্ছে। সরকার আগামী তিন বছরের মধ্যে বিদ্যুতের ভর্তুকি থেকে পুরো বেরিয়ে আসতে চাইছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বলছে, ভর্তুকি তুলে দিলে বিদ্যুতের দাম ৭৮ শতাংশ বাড়তে পারে।

জানা গেছে, ২০০ ইউনিটের ওপর বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের দাম বাড়তে পারে। বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খুচরা দাম ২০১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত ৬ টাকা ৯৫ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ পর্যন্ত ইউনিট ৭ টাকা ৩৪ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ পর্যন্ত ইউনিট ১১ টাকা ৫১ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের ওপরে ১৩ টাকা ২৬ পয়সা। সেচে ৪ টাকা ৮২ পয়সা এবং শিল্পে লোড অনুসারে ৮ টাকা থেকে ১৩ টাকা। বিদ্যুতের দাম বাড়লেও মানুষের জীবনের ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, যারা বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে তাদের দাম বাড়ানো হবে, যাতে যাদের সক্ষমতা কম তারা ভর্তুকি দরে বিদ্যুৎ পায়।

শিল্পে নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র বা ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্ট, সব ধরনের শিল্প (বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র) গ্রাহকদের জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম এখন ৩০ টাকা। সার উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিট ১৬ টাকা। সিএনজিতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৪৩ টাকা। আর রান্নার গ্যাসের জন্য দুই চুলার (ডাবল বার্নার) মাসিক বিল ১ হাজার ৮০ টাকা এবং এক চুলার মাসিক বিল ৯৯০ টাকা, যা ২০২২ সালের ৫ জুন বাড়ানো হয়। ঋণের শর্ত হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে ভর্তুকিমুক্ত করতে বলছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সরকারও এ খাতে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে দীর্ঘদিন ধরে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ লক্ষ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড একটি পর্যালোচনা করেছে। এতে ভর্তুকি তুলে নিলে বিদ্যুতের দাম ৭৮ শতাংশ বাড়তে পারে। সংস্থাটির সুপারিশ হচ্ছে, ধাপে ধাপে দাম সমন্বয় করলে জনগণের জন্য সহনীয় হবে। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বলা হয়,লোকসান কমাতে মূল্য কীভাবে সমন্বয় করা যায়, সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জ্বালানির মূল্য অপরিবর্তিত থাকলে দু-তিন বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) লোকসানের ধারা থেকে বেরিয়ে আসবে।

গত ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। সে সময় বিদ্যুতের খুচরা দাম ছিল প্রতি ইউনিট ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ২৯ হাজার ১৭৪ মেগাওয়াট। প্রতি ইউনিটের খুচরা দাম বেড়ে হয়েছে ৮ টাকা ২৫ পয়সা। শুধু ২০২৩ সালে তিন দফায় বিদ্যুতের দাম ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। বিদ্যুতের বর্তমান গড় খুচরা দাম ৮ টাকা ২৫ পয়সা। পাইকারি পর্যায়ে প্রতি ইউনিটের দাম ৬ টাকা ৭০ পয়সা। ভর্তুকি শূন্য করতে হলে পাইকারি দাম বাড়িয়ে ১২ টাকা ১১ পয়সা করতে হবে। তখন গ্রাহক পর্যায়ে দাম বেড়ে হবে ১৪ টাকা ৬৮ পয়সা।

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ইনকিলাবকে বলেন, বিদ্যুতের ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভোক্তাকে কেবল অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিলই দিতে হবে তা নয়, বরং বিভিন্নভাবে তার দৈনন্দিন খরচ বেড়ে যাবে।

https://dailyinqilab.com/national/news/640682