২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, শুক্রবার, ৮:১১

দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ চিনির দাম বাংলাদেশে

শুল্কছাড়ের পরও কেজিতে মূল্য বাড়ল ২০ টাকা

চিনির দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে শুল্ক কমানোর ঘোষণা দিতে না দিতেই সরকারি চিনি কলগুলো কেজিপ্রতি দাম বাড়াল ২০ টাকা। এখন প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনি কিনতে হবে ১৬০ টাকায়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশী মুদ্রামানে চিনির দাম কলকাতায় ৬২.৫৭ টাকা (ভারতীয় ৪৮ রুপি), দিল্লিতে ৬৭.৫৪ টাকা (ভারতীয় ৫১ রুপি), করাচিতে ৫১ টাকা (পাকিস্তানি ১৩০ রুপি), কলম্বোতে ৯৯ টাকা (শ্রীলঙ্কার ২৮০ রুপি) এবং কাঠমান্ডুতে ৮২.৭৬ টাকা (নেপালি ১০০ রুপি)। দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান প্রধান শহরগুলোর এই মূল্য গতকাল ইন্টারনেট সূত্র থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

গত আগস্টে বেসরকারি চিনিকল মালিকদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাজারে প্রতি কেজি খোলা চিনি ১৩০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। কিন্তু বাজারে সরকারি চিনি মোট চাহিদার এক শতাংশের কম হলেও গতকাল সরকারি চিনির দাম বাড়ানোর খবরে অস্থির হয়ে উঠে সামগ্রিক চিনির বাজার। গতকাল চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে সকাল ও দুপুরের বাজারের ব্যবধান বেড়ে যায় কেজিতে ২ টাকা পর্যন্ত। খাতুনগঞ্জের একাধিক বৃহৎ পাইকারি ব্যবসায়ী জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে প্রতি মণ ৪ হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি হলেও বিকেল নাগাদ তা ৪ হাজার ৯৭৫ টাকা দরে বিক্রি হয়। খুচরা দোকানিদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, কষ্টিংসহ প্রতি কেজি চিনি গতকাল ১৩৭ টাকায় কিনতে হয়েছে।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি এনবিআরের জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে প্রতি টনে আমদানি শুল্ক কমিয়ে এক হাজার টাকা করা হয়েছে, আগে যা ছিল দেড় হাজার টাকা। এ ছাড়া টন প্রতি নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি)-৩০%, ভ্যাট-১৫% এবং অগ্রিম আয়কর(এআইটি)-২% প্রযোজ্য হয়। আর পরিশোধিত চিনি আমদানিতে টনপ্রতি শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে দুই হাজার টাকা, যা আগে ছিল তিন হাজার টাকা। এ ছাড়া পরিশোধিত চিনির ক্ষেত্রে টনপ্রতি নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি)-৩০%, ভ্যাট-১৫%, অগ্রিম আয়কর (এআইটি)-২% এবং অগ্রিম কর (এটি)-৫% প্রযোজ্য হয়। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী এ সুবিধা মিলবে ৩১ মার্চ পর্যন্ত।

বর্তমানে প্রতি টন চিনি ৬০০-৬৪০ মার্কিন ডলারে শুল্কায়ন করা হচ্ছে জানা গেছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের গত জানুয়ারির শুল্কায়নের হিসাবে প্রতি কেজি চিনিতে আমদানিকারকেরা গড়ে শুল্ককর দিয়েছেন ৪০ টাকা ৩৫ পয়সা। এখন শুল্ক-করে ছাড় দেয়া হয়েছে কেজিতে ৭৫ পয়সা। বাংলাদেশে মূলত অপরিশোধিত চিনি প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাত করা হয়। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয় ১৮ লাখ ৪৮ হাজার টন। ভোগ্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয় চিনি থেকে। তাই সরকারি রাজস্ব আহরণে যাতে বড় ধরনের প্রভাব না পড়ে সেজন্য শুল্ক কমানো হয়েছে নামমাত্র।

এ দিকে খাতুনগঞ্জের এক পাইকারি ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এবার দাম বাড়িয়েছে সরকার, যা এনবিআরের প্রজ্ঞাপনের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। এতে মনস্তাত্ত্বিক কারণেই বাজার যে অস্থির হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটা এই সময় কোনো প্রয়োজন ছিল না মন্তব্য করে ওই ব্যবসায়ী বলেন, এক বেলাতেই কেজিতে দুই টাকা বেড়েছে শুধুমাত্র মনস্তাত্ত্বিক কারণে। তিনি এই সিদ্ধান্তকে আগুনে ঘি ঢালার মতো বলেও মন্তব্য করেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের সচিব চৌধুরী রুহুল আমিন কায়সারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, দাম বাড়ানোর প্রস্তাব গিয়েছিল এক মাস আগে। আমি শুনেছি মন্ত্রণালয় থেকে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অ্যাপ্রুভ হয়েছে, কিন্তু অফিস থেকে বের হওয়া পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোনো কাগজ আমার হাতে পৌঁছেনি।

এ দিকে সর্বশেষ মূল্যবৃদ্ধির আগে টিসিবির হিসাব অনুসারে চিনির প্রতি কেজি মূল্য ছিল ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা। বর্ধিত মূল্য কার্যকর হওয়ার পর এ মূল্য খুচরাপর্যায়ে ২০ টাকা বাড়তে পারে। এক বছর আগে চিনি বিক্রি হতো ১১০ থেকে ১২০ টাকা প্রতি কেজি। এ সময়ে চিনির দাম ২৮.২৬ শতাংশ বেড়েছে বলে টিসিবির প্রতিবেদনে দেখা যায়। নতুন বৃদ্ধি হিসাব করা হলে এক বছরে চিনির মূল্য বৃদ্ধির হার ৪০ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।

বিবেচ্য এক বছরে বাংলাদেশে কেন এভাবে চিনির দাম বাড়ছে সেটি এক রহস্যের বিষয় হয়ে গেছে। চিনি শিল্প সংস্থার বক্তব্যে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয়ের কথা বলা হলেও বাস্তবে তেমন কিছু দেখা যায় না। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে চিনির দামে বিবেচ্য এক বছরে তেমন হেরফের হয়নি। বাংলাদেশে কেন নির্বাচনের আগে এভাবে দাম বাড়ল তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

রোজায় পণ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার ব্যাপারে সরকারিভাবে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলা হলেও চিনির পাশাপাশি অন্যান্য নিত্যপণ্যের দামও বাড়ছে। টিসিবির ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখের বাজার দর অনুসারে এক বছর ব্যবধানে সরু চালের দাম ৬ শতাংশ, মোটা চাল ২ শতাংশ, সয়াবিন তেল সাড়ে ৭ শতাংশ, মসুর ডাল ১২ শতাংশ পর্যন্ত, পেঁয়াজ ২৬৯ শতাংশ, রসুন ৪৫ শতাংশ, শুকনা মরিচ ১০ শতাংশ, হলুদ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত, জিরা ৩৩ শতাংশ, এলাচ ৫৮ শতাংশ, দারুচিনি সাড়ে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে বিভিন্ন সবজির দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে আলুর দাম বেড়েছে ৩৬ শতাংশের বেশি।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/816210