২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৬:৫৮

রোহিঙ্গা সংকটে কূটনৈতিক ব্যর্থতা

-আশিকুল হামিদ

প্রতিবেশি মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত ও বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়ার এবং সে দেশের সরকার ও সেনাবাহিনীর গণহত্যা প্রতিহত করাসহ সামগ্রিকভাবে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে লীগ সরকার চরম কূটনৈতিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে বলে অভিযোগ করেছেন বিশিষ্টজনেরা। তারা মনে করেন, ২০১৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বিশ্বের সকল দেশ যখন তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যা ও নির্মূল অভিযানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল, এমনকি জাতিসংঘও যখন মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল, তেমন এক কঠিন সময়েও আওয়ামী লীগ সরকার কেবলই আশ্রয় ও তথাকথিত মানবিক সহায়তা দেয়ার মধ্যে সকল তৎপরতা সীমাবদ্ধ রেখেছিল। একটি উদাহরণ হিসেবে ২০১৭ সালের সেটেম্বরে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের স্ত্রী এবং দেশটির ফার্স্ট লেডি এমিনো এরদোগানের বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখার উদ্দেশ্যে কক্সবাজার সফরের কথা উল্লেখ করে বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, পৃথকভাবে তো বটেই, এমনকি তুরস্কের ফার্স্ট লেডির সঙ্গেও সরকারের কোনো মন্ত্রী ওই এলাকায় যাননি। অথচ আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সৌজন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা ছিল অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। সেবার মিসেস এরদোগানের প্রায় এক সপ্তাহ পর ১২ সেপ্টম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো কক্সবাজার সফরে যাওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন।

বিশিষ্টজনদের বক্তব্যে প্রসঙ্গক্রমে সরকারের পররাষ্ট্রনীতি প্রাধান্যে এসেছে। তারা বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকটে আরো একবার প্রমাণিত হয়েছে, এই সরকারের আসলে কোনো বন্ধু নেই। এজন্যই বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত বিশেষ দেশও খোলামেলাভাবেই গণহত্যার প্রশ্নে মিয়ানমারের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছিল। আরেক কথিত বন্ধুরাষ্ট্র গণচীনও প্রকাশ্যেই মিয়ানমারকে সমর্থন জানিয়ে চলেছে। একই অবস্থান নিয়েছে রাশিয়াও। দেশ দুটির বাধা ও বিরাধিতার কারণে জাতিসংঘ পর্যন্ত পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশ দুটি নিরাপত্তা পরিষদের সম্ভাব্য প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দেয়ারও হুমকি দিয়ে রেখেছে। অথচ এই চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের দহরম-মহরমের কোনো শেষ নেই!

কথা শুধু এটুকুই নয়। সরকার একদিকে চীন, রাশিয়া ও ভারতের সমর্থন পাওয়ার কোনো চেষ্টা চালানোর ব্যাপারে কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি, অন্যদিকে তুরস্কসহ যেসব দেশ বাংলাদেশের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে সেসব দেশের সঙ্গেও সরকার কূটনৈতিক রীতি-নীতি বিরোধী অসম্মানজনক আচরণ করেছে বলে অনস্বীকার্য অভিযোগ উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এই অভিযোগের কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ সরকার কোনো জবাব দিতে পারেনি। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে তুরস্কের ফার্স্ট লেডি মিসেস এরদোগানের সাম্প্রতিক সফরের সময়। মূলত এ ধরনের নীতি, মনোভাব ও কার্যক্রমের কারণেও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিশ্বে একেবারে বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। অবস্থা এখন এতটাই শোচনীয় যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকেও রোহিঙ্গাদের দেখতে যাওয়ার আগে কোনো এক বন্ধুরাষ্ট্রের ‘অনুমতি’ নিতে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌত’হল ও ব্যঙ্গ-তামাশা করা হলেও বিষয়টিকে পর্যবেক্ষকরা অত্যন্ত গুরুতর না মনে করে পারেননি। এমন অবস্থার কারণ সম্পর্কেও ২০১৭ সালের সেপ্টম্বরে অনুষ্ঠিত একাধিক সমাবেশে জানিয়েছিলেন বিশিষ্টজনেরা। তারা বলেছিলেন এবং বিভিন্ন সময়ে এ কথার সত্যতাও প্রমাণিত হয়েছে যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের নামে আয়োজিত এমন এক কর্মকান্ডের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতার দখল নিয়েছিল, যার কোনো পর্যায়েই জনগণের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। সেবার জনগণকে ভোটই দিতে দেয়া হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও একদিকে ১৫৪ জন ‘নির্বাচিত’ এমপি হিসেবে ঘোষিত হয়েছিলেন, অন্যদিকে শুধু একটি সংসদ ও সরকারই গঠন করা হয়নি, ওই সংসদকে সামনে রেখে সরকার বিরোধী দলগুলোর ওপর ফ্যাসিস্ট কায়দায় দমন-নির্যাতনও চালিয়েছে। সরকারের এই দমন-নির্যাতনের এখনও সমাপ্তি ঘটেনি। স্মরণ করা দরকার, একমাত্র ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারত ছাড়া বিশ্বের অন্য কোনো দেশই ৫ জানুয়ারি নির্বাচন নামের ওই কর্মকান্ডের প্রতি সমর্থন জানায়নি বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ সকল রাষ্ট্র সংসদ ও সরকার গঠনের কর্মকান্ডের বিরোধিতা করেছিল। বহুদিন পর্যন্ত দেশগুলোর সে অবস্থানে পরিবর্তন ঘটেনি।

এমন অবস্থার কারণে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারেও সরকার আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর পাশাপাশি অন্য একটি বিশেষ কারণকেও সামনে এনেছেন পর্যবেক্ষকরা। মিয়ানমারের যে জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা ও নির্মূলের ভয়ংকর অভিযান চালানো হচ্ছে তারা মুসলিম। আর দেশটির সরকার ও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিমদের সশস্ত্র ইসলামী জঙ্গি হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী একেই তার সমর্থন দেয়ার কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। চীনের মতো কিছু রাষ্ট্র এমন এক অসত্য প্রচারণারও আড়াল নিয়েছে যে, রোহিঙ্গা মুসলিমরা নাকি আইএস-এর সঙ্গে জড়িত এবং তারা নাকি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে বলেই তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে! বাংলাদেশ সরকারও নাকি তথাকথিত ইসলামী জঙ্গি বিরোধী একই নীতির কারণে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সুফলপ্রসূ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না!

বলার অপেক্ষা রাখে না, অন্তরালে যা কিছুই ঘটে থাকুক বা ঘটতে থাকুক না কেন, ঘটনাপ্রবাহের বর্তমান পর্যায়ে এই অভিযোগ অনস্বীকার্য হয়ে উঠেছে যে, আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রনীতি ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। ক্ষতিকর বিভিন্ন নীতি ও কর্মকান্ডের কারণে তো বটেই, কূটনীতির মতো জরুরি ও অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়েও সরকার দলবাজি করেছে বলেই বাংলাদেশকে বন্ধুহীন অবস্থায় পড়তে হয়েছে। একই কারণে মিয়ানমার শুধু রোহিঙ্গাদেরকেই ঠেলে পাঠাচ্ছে না, দেশটির সামরিক হেলিকপ্টার যখন-তখন বাংলাদেশের আকাশ সীমা লংঘন করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এমনকি বাংলাদেশের দু’চার কিলোমিটার পর্যন্ত ভেতরেও ঢুকে পড়ছে। বলাবাহুল্য, এসবই সম্ভব হচ্ছে সরকারের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার কারণে। বিশিষ্টজনেরা বলেছেন এবং আমরাও মনে করি, সময় এসেছে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার। যুদ্ধ নয় বরং জোর কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান করতে হবে। তাদের এমন নিরাপত্তার সঙ্গে দেশে ফেরৎ পাঠাতে হবে, তারা যাতে মিয়ানমারের বৈধ নাগরিক হিসেবে শান্তিতে বসবাস করতে পারে। এ উদ্দেশ্যে সরকারকে জাতিসংঘ, ওআইসি এবং জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনসহ সকল আন্তর্জাতিক ফোরামে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য অবিলম্বে তৎপর হতে হবে।

https://www.dailysangram.info/post/549541