২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৬:৪৭

বাংলা ভাষা বিকৃতির যেন মহোৎসব

হ্যালো লিসেনার, এখন বিকেল সাড়ে ৫টা! আমি আছি আপনাদের সাথে। আমার মনে হয়, আমার বন্ধুরা আমার জন্যেই অপেক্ষা করছে, কখন শুরু হবে তার প্লে লিস্ট! এবার হবে গল্প আর শোনাব ড্যাশিং ডুসিং ফাটাফাটি গান। এবারের গানটির জন্য রিকোয়েস্ট করেছেন দামাম সৌদি আরব থেকে..., কলাপাড়া পটুয়াখালী থেকে...।

শুনুন তাহলে নতুন ভ্যারিয়েশনে প্রতীক হাসানের সেই গানটি, ‘বিয়াইন সাব আপনার জন্য ঢাকা থাইক্কা ডিজে আনছি, প্রাণ খুইলে নাচেন আপনি, হেব্বি বিটে গান ছাড়ছি।’

সম্প্রতি একটি জনপ্রিয় এফএম রেডিওর অনুষ্ঠানে আরজে (কথাবন্ধু) ভাষা বিকৃত করে এভাবেই অনুরোধের (!) গান শোনান। অতি আধুনিকতার নামে অদ্ভুত উচ্চারণে বাংলা-ইংরেজি মিশ্রিত ‘জগাখিচুড়ি’ বাংলা রেডিওতে শোনা যায় ২৪ ঘণ্টাই। নির্দিষ্ট একটি বা দুটি নয়; প্রায় সব রেডিওর একই অবস্থা। এসব গান আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হয়। একইভাবে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অঞ্চলভিত্তিক নাটক-সিনেমাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিনোদনের অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বাংলা ভাষার বিকৃতি। কমেডি ধাঁচের এসব অনুষ্ঠান খুব গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয় বিভিন্ন টেলিভিশনে।

ইদানীং খুব কম নাটকেই দেখা মেলে সঠিক বাংলা ভাষার ব্যবহার। নাটকের নামকরণও যাচ্ছেতাই। ইন্টারন্যাশনাল ত্যাড়া জলিল, চাচারে ধরো, গার্লফ্রেন্ডের ক্যারেক্টার ঢিলা, হাবুর স্কলারশিপ, চ্যাতা কাশেম, ডাবল ডোজ, মিচকা শয়তান, লোকাল জামাই, তাফালিং, শীতের বউ, বউ পিটামু ইত্যাদি নামকরণ দেখা যায় নাটকে হরহামেশা। এর পাশাপাশি ভাষার বিকৃতি হচ্ছে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে।

ভাষার বিকৃতি যেন সেখানে লিখিত দলিল। ফলে বিকৃত উচ্চারণ, ভুল শব্দচয়ন ও বিদেশি ভাষার সুরে বাংলা ভাষার বিকৃতি ছড়িয়েছে সর্বত্র। অথচ বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটি ৯ দফা সুপারিশ দিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।

ওই কমিটির সদস্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘সুপারিশগুলোর কী হয়েছে, জানা নেই। তবে এটা বলা যায়, বাংলা ভাষার অবস্থা মোটেও ভালো নয়। একটা সময় বাংলা ভাষায় হিন্দির প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গও (ভারত) বিপদে ছিল। এখন আর সেটি নেই। এপার-ওপার দুই বাংলায় ইংরেজি ঢুকে গেছে। ইংরেজির ব্যবহার বাড়ছে উচ্চবিত্তের মধ্যে। তাতে বড় সমস্যা হলো, বাংলা ভাষার ব্যবহার ঠিকমতো হচ্ছে না। শিক্ষিতরাও শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারছে না। অনেকে লিখতে ও বলতেও পারে না। আমাদের শিক্ষার হার বেড়েছে– সেটা মূলত অক্ষরজ্ঞানসম্পন্নদের হিসাব করে। প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত শ্রেণি বাড়েনি। সে জন্য বাংলা ভাষা ব্যবহারের দুর্বলতা রয়েই গেছে।’

টেলিভিশন ও রেডিওর ভাষা বিকৃতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এসব মাধ্যমে নাটক, সিনেমা, গান ইত্যাদি যেগুলো হয়, তা দেশের বৃহৎ অংশ দেখে এবং শুনে শিখছে। অথচ এতে প্রায়ই যেসব ভাষা ব্যবহার হয়, তা মোটেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে ভাষার চর্চাও জরুরি। পাড়া-মহল্লায় নাটক-গান হওয়ার কথা। কিন্তু এখন আর কিছুই হয় না। সংস্কৃতি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেছে। এতে বাংলা ভাষাই এখন বিপদে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাষার চর্চা নেই। ছাত্র সংসদ থাকার কথা, সেটা নেই। থাকলেও তাতে সংস্কৃতির চর্চা হয় না। পাঠাগারগুলোরও একই অবস্থা। এর কারণ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় অর্থই মুখ্য। সেখানে সংস্কৃতি, ভাষা, শিক্ষা সবকিছুই উপেক্ষিত।’

সংস্কৃতি অঙ্গনে ভাষার বিকৃতি প্রসঙ্গে বরেণ্য নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ সমকালকে বলেন, ‘শিক্ষার বড় অভাব। যে কেউ যখন-তখন নাটক-সিনেমায় চলে আসছে। অধিকাংশ পরিচালক, নাট্যকার, নায়ক-নায়িকা, শিল্পী বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশ সাহিত্য, উচ্চারণ– এসব কিছুই জানে না। জানার চেষ্টাও করে না। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। প্রমিত বাংলা-আঞ্চলিকতা গুলিয়ে নাটক লেখা হয়। শিল্পীরাও তাদের মতো বলেন, যার উচ্চারণও সঠিকভাবে হয় না। অথচ ইংরেজি ভাষায় উচ্চারণে ভুল হলে চারদিকে ছি ছি পড়ে যায়। এর অর্থ, আমরা নিজেরাও বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহারে উদাসীন।’ তিনি আরও বলেন, ‘হাইকোর্ট একবার আদেশে বলছিলেন, ভাষা বিকৃতি দণ্ডনীয় অপরাধ। এটা কত লজ্জাজনক! তবুও কারও টনক নড়েনি। আর সরকারের সংশ্লিষ্টদের কথা কী বা বলব! এখনকার আমলাদের অনেকেই আঞ্চলিকতা থেকে বের হতে পারেন না। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে দেখেন– তাদের শিল্পীরা, আমলারা কত শিক্ষিত! তারা ভাষার ব্যাপারে খুবই সচেতন। আমাদেরও এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া দরকার। নয়তো বাংলা ভাষার মৌলিকত্ব হারিয়ে যাবে।’
রেডিও সুন্দরবনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তরুণ কুমার সাহা সমকালকে বলেন, ‘বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধে আমরা নিজেরাই যথাসম্ভব পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। এ ক্ষেত্রে সরকারিভাবে সমন্বিত লিখিত রূপরেখা বা নির্দেশনা থাকলে ভালো হয়।’

কমিটির সুপারিশে যা ছিল
বাংলা ভাষার পবিত্রতা রক্ষা; রেডিও-টেলিভিশনে ‘বিকৃত উচ্চারণ’ ও ‘ভাষা ব্যঙ্গ’ করে কোনো ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার না করতে ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর (আপিল বিভাগ থেকে অবসরপ্রাপ্ত) নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই আদেশ দেন। আদেশে আদালত বাংলা ভাষার দূষণ, বিকৃত উচ্চারণ, ভিন্ন ভাষার সুরে বাংলা উচ্চারণ, সঠিক শব্দচয়ন না করা এবং বাংলা ভাষার অবক্ষয় রোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে (২০২০ সালে প্রয়াত) প্রধান করে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করারও নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে ওই বছরের ২৮ মার্চ অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে ১৪ সদস্যের কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর পর কমিটির সুপারিশ ওই বছরের ১২ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হয়।

সুপারিশে বলা হয়, ভাষাদূষণ রোধে আইন তৈরি করে বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেল এবং দেশীয় বেতার ও টেলিভিশন নিয়ন্ত্রণ করা; বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলকভাবে প্রমিত বাংলা ভাষার একটি কোর্স চালু এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পঠন-পাঠন প্রবর্তনের উদ্যোগ; বেতার ও টেলিভিশনে প্রমিত বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং ভাষায় বিদেশি শব্দের অকারণ মিশ্রণ দূর করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ; সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাষার বিকার ও দূষণ রোধে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স রেগুলেটরি কমিশনের ব্যবস্থা গ্রহণ; বেতার ও টেলিভিশনে ভাষাদূষণ রোধ এবং প্রমিত বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়কে একটি স্থায়ী কমিটি গঠন করতে হবে। ওই কমিটি বেতার ও টেলিভিশনে প্রচারিত অনুষ্ঠান পরিবীক্ষণ করে মতামত, উপদেশ ও নির্দেশ প্রদান করবে; মুদ্রণ ও অনলাইন মাধ্যমের ক্ষেত্রেও প্রমিত বাংলা ব্যবহারে সচেতনতা সৃষ্টি এবং ভাষাদূষণ রোধে তথ্য মন্ত্রণালয় অনুরূপ একটি কমিটি গঠন করতে পারে; বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডকে চলচ্চিত্রে ভাষাদূষণ রোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া মোবাইল ফোনের কলার-টিউনে বাংলা ব্যতীত অন্য ভাষার ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাইকোর্টের আদেশের কিছুদিন পর ওই বেঞ্চটি বিলুপ্ত হয় এবং বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী আপিল বিভাগে নিয়োগ পান। এ কারণে কমিটির সুপারিশ আলোর মুখ দেখেনি।

জানতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘যদি কোনো আদালত বা আইনজীবী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ বিষয়ে শুনানির উদ্যোগ নেন তাহলে কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের সুযোগ রয়েছে।’ তিনি অবিলম্বে এ বিষয়ে পদক্ষেপ প্রত্যাশা করেন।
বরেণ্য কথাসাহিত্যিক বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন বলেন, ‘ভাষার বিকৃতি রোধে প্রমিত বাংলার পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আঞ্চলিক ভাষার নাম করে বিচ্ছিন্ন শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে ভাষাকে বিকৃত করা চলবে না। কারণ মনে রাখতে হবে, একটি বিশেষ অঞ্চলের ব্যবহৃত ভাষাই সে অঞ্চলের মাতৃভাষা এবং প্রমিত ভাষা। তাই আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলা ও ইংরেজির মিশেল ঘটিয়ে যেভাবে বাক্য গঠন করা হচ্ছে, এই কাজগুলো আমাদের ভাষার প্রবল বিকৃতি ঘটাচ্ছে। এতে না হচ্ছে মাতৃভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন, না হচ্ছে ইংরেজি ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন। তাই মাতৃভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রমিত ভাষাই ব্যবহার করা উচিত। ইংরেজি ভাষা ব্যবহারেও ভাষার মর্যাদা রক্ষা করে শুদ্ধ ইংরেজি ব্যবহার করা উচিত।’

https://samakal.com/bangladesh/article/224157