২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৬:৪৩

হাসপাতাল থেকেও ছড়াচ্ছে রোগ

কোনো রোগে আক্রান্ত হলে নিরাময় পেতে হাসপাতালে ছুটে যায় রোগীরা। অথচ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যথাযথ সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকায় দিন দিন হাসপাতালই হয়ে উঠছে রোগ বিস্তারের কেন্দ্র। এতে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা নতুন করে সংক্রমিত হচ্ছে অন্য জীবাণুতে। অর্থাৎ একটি রোগ থেকে মুক্তি পেতে হাসপাতালে এসে রোগীরা অন্য রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে।

ভর্তি রোগীদের সুস্থ হতে সময় লাগছে অনেক বেশি। একই সঙ্গে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে কয়েক গুণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণের সম্ভাব্য জায়গাগুলোর মধ্যে হাসপাতাল অন্যতম। বিশ্বে প্রতিবছর এক কোটি ৩৭ লাখ মানুষ মারা যায় সংক্রমণজনিত কারণে।

এর বড় অংশই হাসপাতালে সংক্রমিত। পশ্চিমা দেশগুলোতে সংক্রমণের হার ৩ থেকে ৫ শতাংশ হলেও এশিয়ান দেশগুলোতে এই হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ (আইপিসি) সাপোর্ট প্রগ্রামগুলো বেশি জরুরি। কারণ এসব দেশে স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ ও মেডিক্যাল হাইজিন স্ট্যান্ডার্ডগুলো সেকেন্ডারি সংক্রমণের মাধ্যমে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হতে পারে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২৪ শতাংশ হাসপাতালে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত।

হাসপাতালগুলোর মধ্যে ৪১ শতাংশের রয়েছে প্রাথমিক ব্যবস্থা, ১৯ শতাংশের মাঝারি ধরনের ও ১৬ শতাংশের উন্নত সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে। হাসপাতালের আইপিসি ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত ও প্রাথমিক হলে এটিকে দুর্বল হিসেবে গণ্য করা হয়। সে হিসাবে ৬৫ শতাংশ হাসপাতালে আইপিসি ব্যবস্থা দুর্বল। সরকারি হাসপাতাল ও জাতীয় ইনস্টিটিউটে এই হার ৮২ শতাংশ।

বেসরকারি হাসপাতালে ৫৫ শতাংশ। তবে নন-টিচিং প্রাইভেট হাসপাতালগুলো এই হার শূন্য শতাংশে নামিয়ে এনেছে।
২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত হাসপাতালের সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে এই গবেষণা চালান রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১৬ সদস্যের একদল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। গবেষণায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের মানদণ্ডের ভিত্তিতে সরকারি ১১টি মেডিক্যাল কলেজ, ১১টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, ১১টি জাতীয় ইনস্টিটিউট ও চারটি করপোরেট হাসপাতালের তথ্য সংগ্রহ করেন গবেষকরা। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন অধ্যাপক ডা. রুবিনা ইয়াসমিন ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. মঞ্জুরুল হক।

গবেষণায় মোট আটটি বিষয় জানার চেষ্টা করেন গবেষকরা; এর মধ্যে রয়েছে সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রগ্রাম, গাইডলাইন, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, সার্ভেইল্যান্স, মূল্যায়ন, হাসপাতালের পরিবেশ, পরিচ্ছন্নতায় ব্যবহৃত পদার্থ, শয্যার দূরত্ব, লোকবল ইত্যাদি। প্রতিটি বিষয়ে স্কোর ধরা হয় ১০০ করে মোট ৮০০।

গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে হাসপাতালের গড় আইপিসি ২৫২.৫, সর্বনিম্ন ১৩০, সর্বোচ্চ ৭৮৫। সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গড় আইপিসি ২৪৭.৫, জাতীয় ইনস্টিটিউটের গড় আইপিসি ২৩২.৫, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গড় আইপিসি ২৯০.০, অন্য টারশিয়ারি লেভেল নন-টিচিং প্রাইভেট হাসপাতালের গড় আইপিসি ৬৬২.৫।

আইপিসি কমিটি আছে ৭২.৭২ শতাংশ সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, ৫৪.৫৪ শতাংশ জাতীয় ইনস্টিটিউটে, ৬৩.৬৩ শতাংশ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং ১০০ শতাংশ নন-টিচিং প্রাইভেট হাসপাতালে। ৯.০৯ শতাংশ সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সার্বক্ষণিক আইপিসি প্রফেশনাল আছে, জাতীয় ইনস্টিটিউটে কোনো আইপিসি প্রফেশনাল নেই; ১৮.১৮ শতাংশ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ও ৭৫ শতাংশ নন-টিচিং প্রাইভেট হাসপাতালে সার্বক্ষণিক আইপিসি প্রফেশনাল আছে।

গবেষকদলের একজন সদস্য জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. রাহনুমা পারভীন কালের কণ্ঠকে বলেন, নন-টিচিং প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে উন্নত সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকলেও জাতীয় ইনস্টিটিউট ও সরকারি হাসপাতালে প্রতিরোধব্যবস্থা খারাপ পর্যায়ে রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা দেখার দায়িত্ব হলো আইপিসি পেশায় যুক্ত একটি দল ও কমিটির। আমাদের কমিটি রয়েছে, কিন্তু আইপিসি পেশাদার লোকবল অপ্রতুল। এ ছাড়া আমাদের সংক্রামক রোগের বিশেষজ্ঞ নেই। সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী ব্যবস্থাপনায় আইপিসি গাইডলাইন অনেক জায়গায় নেই বা মানা হচ্ছে না। আইপিসির বিষয়ে অনেকের প্রয়োজনীয় শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার হলেও নতুন স্টাফদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা রয়েছে। আইপিসি প্রগ্রাম সঠিকভাবে চলছে কি না এর তদারকি ও মূল্যায়নের ব্যবস্থা কোথাও নেই।’

গবেষণার সঙ্গে যুক্ত সহযোগী অধ্যাপক ডা. মঞ্জুরুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, হাসপাতালের সংক্রমণ সব সময় মারাত্মক ধরনের হয়ে থাকে এবং এর জীবাণু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকপ্রতিরোধী। সব হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিধি থাকলেও বেশির ভাগ হাসপাতালে এর ব্যবহার নেই।

তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একটি শয্যায় একজন রোগী থাকবে। সরকারি হাসপাতালে শতভাগ ক্ষেত্রে এটি প্রতিপালন করা সম্ভব হচ্ছে না। যত শয্যা আছে তার চেয়ে অনেক বেশি রোগী থাকছে। গাদাগাদি করে বিছানায়, এমনকি মেঝেতেও অসংখ্য রোগী রাখা হয়। দর্শকের সমাগম এত বেশি থাকে যে ওয়ার্ডগুলোতে হাঁটা পর্যন্ত যায় না। ওয়ার্ড বয় যাঁরা আছেন তাঁরা আইপিসির বিষয়গুলো জানেন না।

গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৫ শতাংশ সরকারি মেডিক্যাল হাসপাতালে সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত। ৩৬ শতাংশ হাসপাতালে প্রাথমিক ব্যবস্থা রয়েছে, ৯ শতাংশ হাসপাতালে মাঝারি ও উন্নত ধরনের প্রতিরোধব্যবস্থা রয়েছে। ২৭ শতাংশ জাতীয় ইনস্টিটিউটে সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত। ৫৪ শতাংশের রয়েছে প্রাথমিক ব্যবস্থা, ১৮ শতাংশের মাঝারি ধরনের প্রতিরোধব্যবস্থা রয়েছে, একটিরও উন্নত প্রতিরোধব্যবস্থা নেই। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে একটিরও অপর্যাপ্ত সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা পাওয়া যায়নি। ৫৪ শতাংশের রয়েছে প্রাথমিক ব্যবস্থা, ৩৬ শতাংশের মাঝারি ধরনের ব্যবস্থা এবং ৯ শতাংশের রয়েছে উন্নত প্রতিরোধব্যবস্থা। তবে নন-টিচিং প্রাইভেট হাসপাতালে শতভাগ উন্নত সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (সংক্রামক) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ (আইপিসি) একটি বাস্তব, প্রমাণভিত্তিক পদ্ধতি। রোগীর নিরাপত্তা ও সেবার মানের ক্ষেত্রে আইপিসি একটি অনন্য ব্যবস্থা। যথাযথ আইপিসি ব্যবস্থাপনার অভাবে সেবা প্রদানকারী হাসপাতালগুলোই হতে পারে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য অনেক বড় ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়।

বে-নজির আহমেদ বলেন, সহজভাবে বললে—কোনো এক সংক্রমণ থেকে বাঁচতে রোগী হাসপাতালে আসছে, কিন্তু সে নতুন করে অন্য সংক্রমণ নিয়ে বাড়ি ফিরছে, যে সংক্রমণ তার আগে ছিল না। সাধারণত এ সংক্রমণগুলো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয় ও রোগীদের দীর্ঘ সময় হাসপাতালে থাকতে হয়। এতে স্বাভাবিকভাবেই চিকিৎসা ব্যয় কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

তিনি বলেন, হাসপাতালে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশিতে যেমন রোগ ছড়ায়, তেমনি মশা-মাছির মাধ্যমেও অনেক রোগ ছড়ায়। আবার রোগীর ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মাধ্যমেও অনেক রোগের জীবাণু ছড়াতে পারে। রোগীদের দেখতে নিয়মিত বাইরে থেকে লোকজন আসা-যাওয়া করে। এ অবস্থায় দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। পর্যাপ্ত সংরক্ষণব্যবস্থা না থাকায় রোগীদের খাবারগুলো প্রায়ই খোলা পড়ে থাকতে দেখা যায়। এতে খাবারে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে এবং তা খেয়ে রোগী আক্রান্ত হয়। এসব কারণে হাসপাতালে শুধু যে রোগীই নতুন করে আক্রান্ত হয় তা নয়, হাসপাতালে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীরাও নানা রকম সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. ফজলে রাব্বি চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, কমিউনিটিতে বিরল কিছু সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে অ্যাসিনেটোব্যাকটর নামের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। এটি সাধারণ হাসপাতালের আইসিইউতে হওয়ার কথা। অর্থাৎ আইসিইউর সংক্রমণ কমিউনিটিতে পাওয়া যাচ্ছে।

ডা. মো. ফজলে রাব্বি বলেন, ২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বিএসএমএমইউতে ভর্তি রোগীর ৭২ হাজার ৬৭০টি নমুনা পরীক্ষায় দেখা গেছে, কালচার পজিটিভ ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা ১৫ হাজার ৭৫১ বা ২১.৬৭ শতাংশ। এসব ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসে অ্যান্টিবায়োটিক আগে ভালো কাজ করলেও বর্তমানে অ্যামোক্সাসিলিন ও সিপ্রোফ্লক্সাসিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত কাজ করছে না। সেফিক্সিম, সেফট্রিয়াক্সনের মতো জাদুকরী অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে মাত্র ১০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালকেন্দ্রিক সংক্রমণ কমাতে হবে। পশুপাখির ফার্মের ক্ষেত্রে প্রচুর অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। এগুলোর অযাচিত ব্যবহার কমাতে হবে। হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না হওয়ায় এ থেকে অনেক অ্যান্টিবায়োটিক কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়ছে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2024/02/22/1365710