২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৬:৩৩

অবকাঠামো ঘাটতি পানি সঙ্কট

আশা জাগানো বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে নানামুখী অবকাঠামোগত সমস্যা-সঙ্কট ও ঘাটতি কাটেনি এখনো। এর ফলে সেই আশা অনেকটা ফিকে। গত পাঁচ বছরেও পূর্ণত লাভ করেনি দেশের সর্ববৃহৎ এই শিল্পজোন। অবকাঠামো সুবিধা কবে সম্পন্ন হবে তা অনিশ্চিত। দেশে চলমান দীর্ঘমেয়াদি ডলার সঙ্কটের প্রবল ধাক্কা পড়েছে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের অবকাঠামো নির্মাণকাজে। এরপরই জ¦ালানি সঙ্কটের আরেক ধকল। পদে পদে ব্যাহত হচ্ছে অবকাঠামো বাস্তবায়ন। শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তারা বলছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে গ্যাস, বিদ্যুৎসহ জ¦ালানি, পানির সঙ্কট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। মৌলিক এসব অবকাঠামো সুবিধা পেতে যত বিপত্তি! পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানিসহ নিরবচ্ছিন্ন ইউটিলিটি সার্ভিসের নিশ্চয়তা ও পরিকল্পিত অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা চান শিল্প-কারখানা মালিক বিনিয়োগকারীরা। অন্যদিকে শিল্পনগরের দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে এ যাবৎ স্থাপিত শিল্প-কারখানাগুলোতে স্থানীয় শ্রমিক ও কর্মীরা নিজেদের কর্মস্থলে নির্বিঘেœ আসতে পারছেন না। কেননা শ্রমিক যানবাহনের ব্যবস্থা নেই। শ্রমিকদের নিজ নিজ খরচে অনেক কষ্টে দুর-দুরান্ত থেকে আসা-যাওয়া করতে হয়। এতে ব্যয় ও সময়ের অপচয় হচ্ছে বেশি। তাছাড়া শ্রমিক-কর্মীদের জন্য আবাসনের সংস্থানও রাখা হয়নি। শ্রমিকদের জন্য নিজস্ব যানবাহন পরিবহন ও আবাসনের ব্যবস্থা না থাকায় তাদের সুষ্ঠুভাবে কাজে বেগ পেতে হচ্ছে প্রতিনিয়তই। শিল্পনগরে শিল্প, কল-কারখানা স্থাপন, পরিচালনা ও শ্রম-বান্ধব বিভিন্ন অবকাঠামো সুবিধা এখনো অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। এরমধ্যে রয়েছে শিল্পপ্লট পুরোপুরি তৈরি, সংযোগ সড়ক, চাহিদা মাফিক গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সরবরাহ, ড্রেনেজ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন ধরনের ইউটিলিটি সার্ভিস। এসব অবকাঠামো সম্পন্নের কাজে চলছে ধীরগতি এবং সময়ক্ষেপণ। সবকিছু মিলিয়ে শিল্পনগরে পরিকল্পিত সব রেডি শিল্প-প্লট, জ্বালানি, পানি, শ্রমিক যানবাহন, আবাসন, শ্রমবান্ধব পরিবেশসহ অবাকাঠামোগত পরিপূর্ণতা বিলম্বিত হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে একুশে পদকপ্রাপ্ত দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, দেশের সর্ববৃহৎ শিল্পজোন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে’ শিল্প স্থাপনে অপরিহার্য অবকাঠামো বাস্তবায়ন কাজ পিছিয়ে রয়েছে। খুবই ধীরগতিতে হচ্ছে। বিশেষ করে পানির সঙ্কটের কারণে শিল্প স্থাপন, পরিচালনা ও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গভীর নলকূপ দিয়ে পানি উত্তোলন করে তো শিল্প পরিচালনা করা যায় না। চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহসহ অবকাঠামো বাস্তবায়ন দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর সংলগ্ন সাগরের তীর ঘেঁষে অবিলম্বে মেরিন ড্রাইভওয়ে নির্মাণকাজ শুরু করে তা বঙ্গবন্ধু টানেল হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত সম্প্রসারিত হলে এখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে শিল্পাঞ্চলের কেন্দ্রস্থল বা শিল্প-হাব গড়ে উঠবে। বিকশিত হবে পর্যটন শিল্পও।

বিশাল ব্যাপ্তিতে শিল্পায়ন বিনিয়োগের লক্ষ্য সামনে রেখে গড়ে উঠেছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর’। দেশের বৃহত্তম শিল্পজোন প্রতিষ্ঠার স্বপ্নময় বাস্তব রূপায়ন ঘটতে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের মীরসরাই ও সীতাকু-, ফেনী জেলার সোনাগাজী মিলিয়ে একত্রে প্রায় ৩৩ হাজার একর বিস্তীর্ণ জায়গায় গড়ে উঠেছে সর্ববৃহৎ এই অর্থনৈতিক জোন। এখানে অন্তত ১৫ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের টার্গেট রয়েছে। যা এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ এবং বিশে^র ‘মডেল ইকোনমিক জোন’ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পথে আশা জাগাচ্ছে। পরিকল্পনা মাফিক বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের সাথে লাগোয়া মীরসরাই সমুদ্র উপকূলে একটি কন্টেইনার বন্দর স্থাপিত হবে। মীরসরাই-সীতাকু--চট্টগ্রাম হয়ে দক্ষিণে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভওয়েতে যুক্ত হবে শিল্পনগর। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জোন কর্তৃপক্ষ (বেজা) বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের অবকাঠামো সুবিধাদি নির্মাণ করছে। এর পাশাপাশি চলছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে শিল্প-কারখানা স্থাপন এবং উৎপাদনের প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ।
শুরু থেকেই পানির সঙ্কট : শুরু থেকেই শিল্প স্থাপন, পরিচালনা ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে পানির সঙ্কটে ধুঁকছে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর। শিল্প নগরে ৫টি প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব উদ্যোগে স্থাপিত গভীর নলকূপের সাহায্যে পানি উত্তোলন করছে। তবে এভাবে বিকল্প জোড়াতালি দিয়ে পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন উদ্যোক্তারা। বেজা সূত্র মতে, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে পানির চাহিদা দৈনিক ১০৩ কোটি লিটার। তবে তার বিপরীতে ৪০ শতাংশ পানিও মিলছে না। শিল্প নগরে বর্তমানে উৎপাদনরত কোম্পানিগুলোর মধ্যে জাপানের নিপ্পন স্টিল, ম্যারিকো বাংলাদেশ, এশিয়ান পেইন্টস বাংলাদেশ, ম্যাকডোনাল্ড স্টিল, সমুদা কনস্ট্রাকশন এবং টি কে গ্রুপ পানির চাহিদার বিপরীতে সিংহভাগ ঘাটতি এবং গভীর নলকূপের সাহায্যে পানি উত্তোলন করে চাহিদা মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। তাছাড়া আগামী মার্চ মাসে আরও ২১টি শিল্প প্রতিষ্ঠান যখন উৎপাদন শুরু করবে তখন পানির সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠবে।

শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, চুক্তি অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের অভ্যন্তরে সবধরনের ইউটিলিটি সার্ভিস প্রদান নিশ্চিত করার দায়িত্ব বেজা’র। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বেজা হিমশিম খাচ্ছে। সবচেয়ে অবাক বিষয়টি হলো বেজা পানি সরবরাহ না করেও পানির বিল পরিশোধের দাবি করছে, তাগাদা দিচ্ছে। অথচ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা তাদের প্রয়োজন মেটাতে আপাতত বা সাময়িক উপায় হিসেবে পানি সরবরাহের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন করেছে। অথচ নিজেদের প্রচেষ্টায় যে পানি ব্যবহার করা হচ্ছে এর জন্য কেন বেজাকে বিল দিতে হচ্ছে তা বোধগম্য নয়।
শিল্পনগরে টিকে গ্রুপের উদ্যোগে বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগে স্থাপিত ফাইবার প্ল্যান্টের কর্মকর্তারা জানান, তাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানে পানির চাহিদা মেটাতে গভীর নলকূপ স্থাপন করেছেন। যা প্রতি মাসে ৯০ হাজার ঘনমিটার পানি উত্তোলনের ক্ষমতাসম্পন্ন। অথচ তাদেরকে প্রতি মাসে প্রায় ২৮ লাখ টাকা পানির বিল দিতে হয় বেজাকে। বাধ্য হয়ে গভীর নলকূপ স্থাপন করে পানির বিকল্প ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। যেহেতু বেজা পানি সরবরাহ করতে পারছে না। তা সত্ত্বেও কেন বেজাকে পানির বিল দিতে হবে? এক সমস্যার পিঠে এটি আরেক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেজা যেখানে এক ফোঁটা পানি দিতে সক্ষম নয়, অথচ সেখানে প্রতি ঘনমিটারে ৩২ টাকা হানে বিল ও ভ্যাট আদায় করে নিচ্ছে। বেজা পানি সরবরাহ না করেও বিল আদায় করছে।

তবে বেজা কর্তৃপক্ষ সূত্র পানি সরবরাহ না করেই বিল আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তারা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে পানি সরবরাহ করে আসছে। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের অভ্যন্তরে ৫০টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। ২০২৭ সালে মেঘনা নদী থেকে পানি সরবরাহ লাইন স্থাপন কাজ শেষ হলে প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ পাওয়া যাবে। তবে শিল্পনগরে বর্তমানে বেজা কী পরিমান পানি সরবরাহ করছে তা সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে পারেনি।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে পানির চাহিদা মাফিক সরবরাহ নিশ্চিত করতে চট্টগ্রাম ওয়াসা একটি মেগাপ্রকল্প গ্রহণ করেছে। এর জন্য কারিগরি দিক ও ভূমি অধিগ্রহণসহ ২২ হাজার ৬৯ কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) ভিত্তিতে এই মেগা প্রকল্পে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান ১৩ হাজার ২শ’ কোটি টাকা এবং বাদ বাকি ৮ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা সরকার অর্থায়ন করবে। চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ জানান, মেগা প্রকল্পের প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে পানির চাহিদা নিরূপণ ও সম্ভাব্য মূল্য নির্ধারণের কাজ চলছে। আশা করা হচ্ছে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শুরু এবং ২০২৭ সালের শেষে প্রথম পর্যায়ে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করা যাবে। তিন ধাপে মেগা প্রকল্পটি সম্পন্ন হবে ২০২৮ এবং ২০৩০ সালে।

শ্রমবান্ধব পরিবেশ : যানবাহন, আবাসন কবে? : শ্রমবান্ধব পরিবেশের প্রধান শর্ত হিসেবে শ্রমিকদের জন্য যানবাহন এবং আবাসন সংস্থান এখনও করা হয়নি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে। এর ফলে স্থানীয় শ্রমিক সঙ্কটে পড়েছে উৎপাদনরত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। শ্রমিকদেরও নানামুখী দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের দূরত্ব বেশি হওয়ায় শ্রমিকরা গণপরিবহনে বেশি খরচে কারখানায় যেতে আগ্রহী হচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপÑ শিল্পনগরে সম্প্রতি উৎপাদনের যাওয়া চীনা পোশাক কারখানা ‘খাইশি লিনজেরি বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড’ শ্রমিক সঙ্কটে পড়েছে। অবশ্য শ্রমিক পরিবহন সঙ্কট নিরসনে বিআরটিসি বাস সার্ভিস চালু করার প্রস্তাব দিয়েছে বেজা। বেজা গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পরিবহন মালিকদের সাথে মতবিনিময় সভায় উক্ত প্রস্তাব দিয়েছে। সভায় শিল্পনগর এলাকায় কর্মরত শ্রমিকদের চলাচলের সুবিধার জন্য বড়তাকিয়া বাজার থেকে শিল্পনগরের জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত বিআরটিসি বাস সার্ভিস চালুর বিষয়ে পরিবহন মালিক, বেজা, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে আলোচনা হয়।
এখানে চীনা বিনিয়োগে স্থাপিত শতভাগ রফতানিমুখী অন্যতম বৃহৎ বিদেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘খাইশি লিনজেরি বাংলাদেশ লিমিটেড’ শিল্পনগরে ১১টি প্লট বরাদ্দ পায়। তৈরিপোশাক, পোশাক তৈরির কাঁচামাল, ফেব্রিকস ও ফোম উৎপাদন করছে এসব প্রতিষ্ঠান। বছরে ৩০ মিলিয়ন পিস পোশাক তৈরির টার্গেট থাকলেও দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক সঙ্কটের কারণে এখনো পুরোদমে কারখানা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে চালু হওয়া একটি কারখানায় ৭ হাজার শ্রমিক নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলেও মিলেছে মাত্র ৭শ’ জন। শ্রমিক সঙ্কটে উৎপাদন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। খাইশি লিনজেরি শিল্পনগরে ১১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে। চীনা কোম্পানির ১১টি প্লটের সবক’টিতে উৎপাদন শুরু হলে ১১ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

একই হিমশিম অবস্থা অন্যান্য দেশি-বিদেশি বিনিয়োগপুষ্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানে। শিল্পনগরের আশপাশে আবাসন, প্রয়োজনীয় গণপরিবহণ, মানসম্মত খাবারের দোকান রেস্তোঁরা না থাকায় শ্রমিকরা কাজে অনীহা প্রকাশ করছে।

https://dailyinqilab.com/national/article/640435