২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৬:০৯

সন্দেহজনক লেনদেন বাড়ছে, ব্যবস্থা নেই

সাম্প্রতিক সময়ে আশঙ্কাজনকভাবে সন্দেহজনক লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে। একই সঙ্গে অর্থ পাচার এবং সন্দেহজনক ঋণও বেড়েছে। এক অর্থবছরে ৫২০টি সন্দেহজনক ঋণের তথ্য পেয়েছে দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বড় অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমেও ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের ঘটনা ঘটছে। বিএফআইইউ’র বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক সন্দেহজনক নগদ লেনদেন ও ঋণ, হুন্ডি, অর্থ পাচার সবই বুঝতে পারছে টাকা কোথায় যাচ্ছে। অর্থাৎ সিস্টেমে ধরা পড়ছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তাদের মতে, সুশাসন বাস্তবায়ন করা না হলে অর্থ পাচার, হুন্ডি বেনামে ঋণ এসব বাড়তেই থাকবে।

প্রতিবেদনে ব্যাংক ঋণে ৬ ধরনের জালিয়াতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বহু ঋণের অর্থ নির্ধারিত সময়ের আগে পরিশোধের ঘটনাকে সন্দেহজনক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

কারণ, এসব ঋণের আড়ালে কালোটাকা লেনদেন হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এছাড়া ভুয়া নথি ও ভুয়া জামানতের মাধ্যমে ঋণ অনুমোদন ও বিতরণের তথ্য উঠে এসেছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির কারণে ব্যাংক খাতে তীব্র তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এ ধরনের খেলাপিরা হঠাৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে উধাও হয়ে যাচ্ছে, এরপর দেশান্তরী হচ্ছে বলে বিএফআইইউ-এর প্রতিবেদনে উঠে আসে।
অন্যদিকে শর্ত ভঙ্গ করে বেনামি ঋণের বিপরীতে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়। ওই অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যবহার বা পাচার করা হয়েছে। এর বাইরে অর্থ পাচারের বিভিন্ন ধরনের কলাকৌশল শনাক্ত করেছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাটি।

প্রথমবারের মতো ঋণ-সংক্রান্ত সন্দেহজনক রিপোর্টের তথ্য প্রকাশ করেছে বিএফআইইউ। গত অর্থবছর ৫২০টি সন্দেহজনক ঋণের তথ্য বিএফআইইউ’র কাছে এসেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সন্দেহজনক ঋণের রিপোর্টিং হয়েছিল ৩৪১টি। এর আগে কোনো এক অর্থবছরে সন্দেহজনক রিপোর্টের সংখ্যা ১০০ ছাড়ায়নি। ২০২০-২১ অর্থবছরে ঋণসংক্রান্ত সন্দেহজনক রিপোর্ট হয়েছিল ৯৮টি। তার আগের অর্থবছর ছিল ৯৪টি এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৫৯টি।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ব্যাংক ঋণে জালিয়াতির ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময়ে বিএফআইইউ-এর অনুসন্ধানে ১ হাজার ১১২টি সন্দেহজনক লেনদেন ধরা পড়ে। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন অর্থাৎ ২০২০-২০২১ অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত সন্দেহজনক লেনদেনের ঘটনা সহনীয় পর্যায়ে ছিল বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তবে ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন সময়ে মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যায় জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেয়ার ঘটনা। এ দুই বছরে ৮৬১টি সন্দেহজনক ঋণ বিতরণ ও সমন্বয়ের ঘটনা ঘটে। আর পাচারের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ব্যবসায়িক চ্যানেল। অর্থ পাচারের মোট ঘটনার ৮০ শতাংশ বাণিজ্যিক চ্যানেল (ট্রেড বেইজড) ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যাংক মালিকদের সহায়তায় এসব ঘটনা ঘটেছে বলে বিএফআইইউ-এর প্রধান কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তারা ব্যাংক ঋণের শ্রেণিকরণের ক্ষেত্রেও জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে। এমন প্রবণতার কারণে অর্থ পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না।

বিএফআইইউ’র বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, দেশের সীমান্তবর্তী ২১ জেলায় বড় অংকের নগদ অর্থ লেনদেন বেড়েছে। গত অর্থবছরে এসব জেলার ব্যাংকগুলোয় ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৬৭ কোটি টাকা নগদ লেনদেন হয়েছে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে এ জেলাগুলোয় নগদ লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ২৩ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় নগদ লেনদেন বেড়েছে ১৯.৯২ শতাংশ। যেখানে সারা দেশে সামগ্রিকভাবে নগদ লেনদেন বেড়েছে ৮.২৬ শতাংশ।
কোনো নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাবে দিনে ১০ লাখ টাকা বা এর বেশি নগদ জমা অথবা উত্তোলন হলে সেটিকে ক্যাশ ট্রানজেকশন (সিটিআর) বা নগদ লেনদেন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ব্যাংকগুলোর এ ধরনের লেনদেনের তথ্য বিএফআইইউয়ে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাটির সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন ও অপরাধ শনাক্ত করার ক্ষেত্রে অন্যতম বড় টুল বা মাধ্যম হলো সিটিআর।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, কুমিল্লা, যশোর, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ জেলায় এ ধরনের লেনদেন হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ তালিকায় সীমান্তবর্তী অন্যান্য জেলার মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, হবিগঞ্জ, শেরপুর, নওগাঁ, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা ও চুয়াডাঙ্গা।

বিএফআইইউ’র প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, দেশের ব্যাংক খাত অর্থ পাচারের (মানি লন্ডারিং) প্রধান চ্যানেল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বিশেষ করে ব্যাংকগুলোয় ডিজিটাল লেনদেন হওয়ায় ব্যবসায়ীরা পাচারের সুযোগ নিচ্ছেন।

বিএফআইইউ’র প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত অর্থবছরে সামগ্রিকভাবে দেশে নগদ লেনদেন বেড়েছে ৮.২৬ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে নগদ লেনদেন হয়েছিল ২১ লাখ ১১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে ২২ লাখ ৮৫ হাজার ৯১৬ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। নগদ লেনদেন বাড়ার পাশাপাশি গত অর্থবছরে দেশের আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেনের প্রতিবেদন (এসটিআর) ও সন্দেহজনক কার্যক্রমের প্রতিবেদনও (এসএআর) ৬৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিএফআইইউতে এ ধরনের প্রতিবেদন জমা পড়েছে ১৪ হাজার ১০৬টি। এর মধ্যে ৯ হাজার ৭৬৯টি ছিল এসটিআর। একই সময়ে ৪ হাজার ৩৩৭টি এসএআর জমা পড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দুই ধরনের প্রতিবেদন জমা পড়েছিল ৮ হাজার ৫৭১টি।

বিএফআইইউ’র প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ১৩৩টি আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থার কাছে পাঠানো হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ ধরনের প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছিল ৮৪টি। সে হিসেবে গত অর্থবছরে বিএফআইইউ’র পাঠানো প্রতিবেদনের সংখ্যা ৫৮.৩৩ শতাংশ বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি ৮৫টি আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে সিআইডি’র কাছে। এছাড়া ৩৩টি প্রতিবেদন দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক), ১০টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) এবং পাঁচটি প্রতিবেদন অন্যান্য সংস্থার কাছে পাঠানো হয়েছে। গত অর্থবছরে বিএফআইইউ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকারি অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে ১ হাজার ৭১টি তথ্য বিনিময় করেছে।

এক প্রশ্নের উত্তরে মাসুদ বিশ্বাস জানান, বিএফআইইউ’র তথ্যের ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত অর্থ পাচারের ৫৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে দুদক মামলা করেছে ৪৭টি, সিআইডি ১০টি এবং এন‌বিআর’র বিশেষ সেল দু’টি। এসব মামলা এখনো নিষ্পত্তি হয়‌নি।

পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা প্রসঙ্গে বিএফআইইউ প্রধান বলেন, দেশ থেকে একবার টাকা পাচার হয়ে গেলে তা ফেরত আনা খুব কঠিন। ফেরত আনতে অনেকগুলো পক্ষের সঙ্গে কাজ করতে হয়। আমরা অর্থ পাচার বন্ধে বেশি জোর দিচ্ছি।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এখন সরকারকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে কীভাবে পাচারের টাকা উদ্ধার করা যায়। এ রিপোর্টের ভিত্তিতে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া না হলে আরও দ্বিগুণ উৎসাহে পাচার কার্যক্রম চালিয়ে যাবে জালিয়াত চক্র।

https://mzamin.com/news.php?news=98745