২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৫:৫৫

হাসপাতালে বার বার মর্মান্তিক মৃত্যু দায় কার?

ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুন্নতে খৎনা করাতে গিয়ে শিশু আয়ানের মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতেই একই ধরনের ঘটনায় রাজধানীতে মারা গেল আরেক শিশু। এই দু’টি ফুটফুটে শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যুতে বাব-মা ও সাধারণ মানুষের মাঝে একধরণের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এরই মাঝে রাজধানীর ল্যাব-এইড হাসপাতালে এন্ডোসকপি করাতে গিয়ে চিকিৎসকের অবহেলায় রাহিদ রেজা (৩১) নামে এক রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। রোগীর পরিবারের দাবি, চিকিৎসক রোগীর সব রিপোর্ট না দেখেই জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করেছেন। এতে রোগীর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট অবস্থায় রোগীকে পেয়েছে। যথাসাধ্য চেষ্টা করার পরেও রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে- বেসরকারি হাসপাতালে বার বার কেন এমন মর্মান্তিক মৃত্যু হচ্ছে? প্রতিটি ঘটনার পর একটি করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও রহস্য উম্মোচন হচ্ছে না ঘটনার। ঘটনার পর কয়েকজন চিকিৎসককে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। কিন্তু সন্তষজনক কোনো সমাধান হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে একেকটি জবাবও আসছে। বাড্ডার সাতারকুলে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খৎনা করাতে গিয়ে ৭ দিন ধরে লাইফ সাপোর্টে থাকার পর মারা যাওয়ার ঘটনায় যথাযথ তদন্ত ও এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়। আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে কেন ৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। কিন্তু হাসপাতাল কিছু দিন পরপরই এমন ঘটনা ঘটলেও এসব ঘটনার দায় কার?

ডাক্তারি খৎনায় রাজধানীতে দুই শিশুর মৃত্যুতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে অভিভাবকদের মধ্যে। তারা তাদের সন্তানদের খৎনা করাতে ভয় পাচ্ছেন। অভিভাবকদের অভিযোগ, শিশুর মৃত্যুর পরেও চিকিৎসকরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন না। ভুল চিকিৎসায় শিশুদের মৃত্যু হচ্ছে। অন্যদিকে চিকিৎসকরা এটিকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে দাবি করছেন। তারা জানিয়েছেন, এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নিরাপত্তার কথা ভেবেই অভিভাবকরা এখন হাজামের পরিবর্তে চিকিৎসক দিয়ে খৎনা করান। এক সময় গ্রামাঞ্চলে হাজাম দিয়ে খৎনা করার প্রচলন থাকলেও এখন তার সংখ্যা কমেছে। আর শহরের অভিভাবকরা পুরোপুরি ডাক্তারদের ওপর নির্ভরশীল। তবে সম্প্রতি রাজধানীতে খৎনার সময় দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। অভিভাবকদের দাবি, ডাক্তার ও নার্সদের অবহেলার কারণে এমনটি ঘটছে। তারা নরমাল অ্যানেস্থেসিয়ার জায়গায় ফুল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার কারণে শিশুদের মৃত্যু হচ্ছে। এ ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িতদের বিচার হলে সমস্যাগুলোর সমাধান হবে।

ওটি থেকে ছেলেটি আর ফিরে এলো না: মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আহনাফ তাহমিদ আয়হামের মৃত্যুর ঘটনায় মুষড়ে পড়েছেন তারা বাবা-মা ও স্বজনরা। গতকাল বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গের সামনে আয়হামের বাবা বলেন, ছেলেকে তো ওটিতে ঢুকিয়ে দিলাম। ও বলছিল একটু ভয় লাগছিল। আমি বলেছিলাম, বাবা কোনো সমস্যা নেই, আল্লাহ ভরসা। এরপর ওটিতে ঢুকল, আর সব শেষ। শিশুটির বাবা বলেন-আমার ছেলে খুব উৎফুল্ল মনে ওটিতে ঢুকেছিল, খুব উৎফুল্লভাবে। তার খৎনা করানো হবে, এতে সে খুব খুশি ছিল। তিনি বলেন, আমাকে বলেছে ১১টার সময় ছেলের লাশ দিয়ে দেবে। এখন ডাক্তার বলছে পাঁচটা-ছয়টা বাজবে। আমি চাইনি মামলা করার জন্য, মামলার দরকার নেই। আমার ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার আমাকে ফোন দিয়েছেন, ফোন দিয়ে বলেছেন মামলা করতে হবে, তারা পদক্ষেপ নেবেন। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন উল্লেখ করে ফখরুল আলম বলেন, এ জন্যই আমি মামলা করতে চাইনি।

জানা গেছে, মালিবাগের জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে অর্থোপেডিক ও ট্রমা সার্জন ডা. এস এম মুক্তাদিরের তত্ত্বাবধানে মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাতে সন্তানকে সুন্নতে খৎনা করাতে আসেন শিশু আয়হামের বাবা ফখরুল আলম ও মা খায়কুন নাহার চুমকি। রাত আটটার দিকে খৎনা করানোর জন্য অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার পর আর ঘুম ভাঙেনি আহনাফের। এর ঘণ্টাখানেক পর হাসপাতালটির পক্ষ থেকে শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করা হয়। স্বজনদের অভিযোগ, লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার কথা থাকলেও ফুল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হয় আহনাফকে। যে কারণে তার আর জ্ঞান ফেরেনি।

শিশু আয়ানের মৃত্যু: সুন্নাতে খৎনা করাতে গিয়ে ঢাকার বাড্ডা সাঁতারকুলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায় শিশু আয়ান। সম্প্রতি ঘটনাটি সারাদেশে আলোড়ন তুললে নড়েচড়ে বসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ হাসপাতালের কোনো নিবন্ধন নেই বলেও জানা যায়। সবশেষ নিবন্ধন না থাকায় ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বন্ধের নির্দেশ দিলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. আবু হোসেন মোহাম্মদ মইনুল আহসান সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ নির্দেশ দেওয়া হয়। উল্লেখিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ৫ বছরের শিশু আয়ানের মৃত্যুতে তার বাবার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালকের (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) নেতৃত্বে ১০ জানুয়ারি ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনকালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়। এরপর অত্র দপ্তরের অনলাইন ডাটাবেজ পর্যালোচনা এবং পরিদর্শনকালে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দেখা যায় যে, ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইউনাইটেড সিটি, সাতারকুল, বাড্ডা, ঢাকা নামে কোনো প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিকট নিবন্ধন বা লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করে নাই। প্রতিষ্ঠানটি কোনো প্রকার আইনি নিবন্ধন বা লাইসেন্স ছাড়াই চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে, যা সরকারের প্রচলিত আইনের পরিপন্থি। গত ৩১ ডিসেম্বর ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু আয়ানকে ভর্তি করায় পরিবার। সেখানে তাকে অস্ত্রোপচার পূর্ববর্তী এনেসথেসিয়া দেওয়ার পর টানা তিনদিন জ্ঞান ফেরেনি শিশুটির। পরে তাকে গুলশান-২ এর ইউনাইটেড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় (৭ জানুয়ারি) রাত ১টার দিকে মারা যায় শিশুটি। এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে নানান গণমাধ্যমে বেশ ফলাও করে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।

এন্ডোসকপি করাতে গিয়ে রোগীর মৃত্যু: রাজধানীর ল্যাব-এইড হাসপাতালে এন্ডোসকপি করাতে গিয়ে চিকিৎসকের অবহেলায় রাহিদ রেজা (৩১) নামে এক রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠে। রোগীর পরিবারের দাবি, চিকিৎসক রোগীর সব রিপোর্ট না দেখেই জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করেছেন। এতে রোগীর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট অবস্থায় রোগীকে পেয়েছে। যথাসাধ্য চেষ্টা করার পরেও রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। জানা যায়, রোগী রাহিদ রেজা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হেপাটোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। তার অধীনেই রোগী এন্ডোসকপি করা হয়। পরে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে তাকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাত আড়াইটার দিকে ল্যাব-এইডের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯ ফেব্রুয়ারি সকালে তার মৃত্যু হয়। রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, রাহিদ রেজা অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়াসহ নানা রোগে ভুগছিলেন। তারা কোনো রিপোর্টই স্বাভাবিক ছিল না। অধ্যাপক স্বপ্নীল তার রিপোর্ট ভালোভাবে না দেখেই তাকে এন্ডোসকপি করাতে বলেন। সেখানে তাকে জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হয়। এন্ডোসকপি করার পর তাকে পর্যাপ্ত সময় অবজারভেশনে না রেখেই বেডে দিয়ে দেওয়া হয়। পরে তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়।

https://www.dailysangram.info/post/549487