২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ৩:০৬

আধিপত্যের সংঘাত চলছেই

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাত চলছেই। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কিছুদিন পর পর সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন সংগঠনটির দুই পক্ষের নেতাকর্মীরা। গত বৃহস্পতিবার থেকে রবিবার পর্যন্ত চার দিনে পাঁচবার সংঘর্ষ হয়েছে দুই পক্ষের আওতাধীন বিভিন্ন গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে। এতে অন্তত ৫০ জন আহত হন।

এসব ঘটনায় ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীরা উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন।
সংঘর্ষের ঘটনায় সংগঠনটির পক্ষগুলো পরস্পরকে দায়ী করছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

সাড়ে চার মাস আগে বিভিন্ন ইস্যুতে ক্যাম্পাসে দফায় দফায় নিজেদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনার এক পর্যায়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রলীগের ৪২৫ সদস্যের কমিটি বিলুপ্ত করে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সংসদ। এর পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠনের কমিটি না থাকলেও সংঘাত থেমে নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের কয়েকজন সাবেক নেতা ও নতুন কমিটিতে পদপ্রত্যাশী একাধিক নেতা জানান, গত ২৪ সেপ্টেম্বর কমিটি বিলুপ্তির পর অক্টোবরে নতুন কমিটিতে পদপ্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্ত (সিভি) আহ্বান করা হয়। এরপর কেন্দ্রে জমা দেওয়া হয় সিভি।

বিবদমান দুই পক্ষের দেড় শতাধিক সিভি জমা হয়েছে কেন্দ্রে। যেকোনো সময় কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হতে পারে। ক্যাম্পাসে বিবদমান প্রধান দুটি পক্ষের ১১টি বগিভিত্তিক সংগঠনের (ছাত্রলীগের নেতাকর্মী) অনেকে নেতৃত্বে আসতে চান। এখানে কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নন। নতুন কমিটির আগে পদপ্রত্যাশীরা নিজেদের অবস্থান জানান দিতে সংঘাতে জড়াচ্ছেন।

এতে সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হলেও সংঘাত অবসানে এখনো কোনো উদ্যোগ নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ভরযোগ্য একাধিক কর্মকর্তা জানান, ক্যাম্পাস ও এর আশপাশে বিভিন্ন ব্যবস্যপ্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি, নিয়োগ ও শিক্ষার্থী ভর্তির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নানা সুযোগ-সুবিধা আদায় করছেন ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতাকর্মী। ঠিকাদারি কাজ নিয়ে টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডেও জড়াচ্ছেন তাঁরা। বর্তমানে কমিটি না থাকায় সংগঠনের বেশ কয়েকটি পক্ষ-উপপক্ষের প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি এখন চরমে।

তাঁদের ভাষ্য, ২০১০-১১ সেশন থেকে ২০১৪-১৫ সেশন পর্যন্ত যেসব নেতা বর্তমানে ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাঁদের একজনের নিয়মিত ছাত্রত্ব নেই। গত এক বছরের মধ্যে তিন দফায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব সাবেক শিক্ষার্থীকে হল ও ক্যাম্পাস ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু সাবেক নেতারা তা মানছেন না।

গত বৃহস্পতিবার থেকে রবিবার পর্যন্ত চার দিনে পাঁচ দফায় সংঘর্ষের ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত থানায় কোনো অভিযোগ দেওয়া হয়নি।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় এখনো থানায় কোনো অভিযোগ দেওয়া হয়নি। তারা (বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ) বলেছে তদন্ত চলছে। তদন্তের পর আইনগত পদক্ষেপ নেবে।’

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কে এম নুর আহমদ গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। মামলার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে প্রতিবেদন পাওয়ার পর এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’

বারবার কেন সংঘাতের ঘটনা ঘটছে, এমন প্রশ্নের জবাবে কে এম নুর আহমদ বলেন, এগুলো যারা করছে তারা জানে।
তদন্ত কমিটির প্রধান চবির মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবুল মনছুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল ও সোহরাওয়ার্দী হলে ছাত্রদের দুই পক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনাটি আমরা আজকে (গতকাল) তদন্ত শুরু করেছি। বিবদমান দুই পক্ষের সহযোগিতা পেলে নির্ধারিত সময় পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ দীর্ঘদিন ধরে বিভক্ত। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের দুই নেতার অনুসারী হিসেবে পরিচিত নেতাকর্মীরা কিছুদিন পর পর সংঘাতে জড়াচ্ছেন। প্রধান দুটি পক্ষের মধ্যে একটি পক্ষের অধীনে চবি শাটল ট্রেনের ১১টি বগিভিত্তিক ৯টি গ্রুপ রয়েছে। আরেক পক্ষের রয়েছে দুটি। সিক্সটিনাইন, ভিএক্স, বাংলার মুখসহ ৯টি গ্রুপের আবার একাধিক অধীন গ্রুপ রয়েছে। অন্য পক্ষের দুটি গ্রুপ বিজয় ও সিএফসির অধীনেও রয়েছে কয়েটি গ্রুপ।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর কেন্দ্র থেকে চবি শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্তির পর অক্টোবরে আবার সংঘাতে জড়ায় এসব বগিভিত্তিক গ্রুপ। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নভেম্বর-ডিসেম্বরে কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও ক্যাস্পাস জানুয়ারি থেকে আবার নিজেদের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে বিভিন্ন বিভাগে প্ল্যানিং কমিটির সিদ্ধান্ত না মেনে শিক্ষক নিয়োগসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষক সমিতির একাংশ আন্দোলন করছে। আবার এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে রয়েছে শিক্ষক সমিতির আরেকটি অংশ। উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের ইস্যুতে শিক্ষকদের দলাদলির মধ্যে গত বৃহস্পতিবার থেকে ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক গ্রুপগুলোর মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে প্রায় অর্ধশত নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। সংঘর্ষ চলাকালে রামদা, লাঠিসোঁটাসহ বিভিন্ন অস্ত্রের মহড়ায় ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

জানতে চাইলে ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি শিক্ষকদের দলাদলিটাও ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলার কারণ হতে পারে। এই সংঘাত স্থায়ীভাবে বন্ধ করা প্রয়োজন।

সিক্সটিনাইন গ্রুপের নেতা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইদুল ইসলাম সাঈদ গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ছাত্রদের মধ্যে সংঘাত বন্ধে চবি প্রশাসনের ভূমিকা যেভাবে রাখা উচিত, তারা সেভাবে রাখছে না। এতে সংঘাত বেড়েই চলেছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2024/02/21/1365466