২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ৩:০৩

চালের দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক

চালের দাম কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের বৈঠক, ভোক্তা অধিদফতরের অভিযানসহ নানা উদ্যোগেও কমছে না চালের দাম। গত জানুয়ারিতে আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। তখন চালের দাম বাড়তে বাড়তে কেজি প্রতি ৬ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এতে সংসার চালাতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। তখন চালের এই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সর্বত্র সমালোচনা শুরু হয়। জানুয়ারিতে নির্বাচনের পর নতুন সরকার এসে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। এর ফলে কেজি প্রতি চালের দাম ১ থেকে ২ টাকা কমেছে। গত বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরে বাজারে যে মোটা চাল ৪২ থেকে ৪৫ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে সেই চাল জানুয়ারিতে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি বিক্রি হয়। বর্তমানে এর দাম কিছুটা কমে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া বাজারে এখন সরু (মিনিকেট) চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭০ টাকায়, যা জানুয়ারিতে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা ছিল। মাঝারি (বিআর-২৮, পায়জাম) চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা। ভরা মৌসুমে চালের এমন মূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসাবে কেউ সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন, আবার কেউবা বিশ্বে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কথা বলছেন। বিশেষজ্ঞরা উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির জন্য চালের দাম বৃদ্ধি যৌক্তিক বলে মনে করছেন। আবার অনেকে বাজার ব্যবস্থাপনা ও তদারকির দুর্বলতার কথা বলছেন। অন্যদিকে আমনের বাম্পার ফলনের পরও চালের দাম না কমার কারণ হিসাবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলছেন বাংলাদেশে এক যুগ ধরে মোটা চালের উৎপাদন কমছে। আর মাঝারি চালের উৎপাদন বাড়ছে। মাঝারি মানের চালের চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং মোটা চালের চাহিদা কমে যাওয়াকে কারণ হিসেবে মনে করছেন তাঁরা। আর বাংলাদেশে খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করা মানুষজন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পুষ্টিকর খাবারের পেছনে ব্যয় কমিয়েছে। আর ভাতের জন্য ব্যয় বাড়িয়েছে। চালের দাম বৃদ্ধিতে এর প্রভাবও কিছুটা রয়েছে। তবে প্রকৃত কারণ কি তা এখনও নির্ণয় করে চালের দাম এখনো কমাতে পারছে না সরকার।

আমনের বাম্পার ফলনের পরও বাজারে পাইকারী থেকে খুচরা সব পর্যায়েই চালের দাম এখনও কেজিতে ৪ থেকে ৬ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, চালের দাম বাড়িয়েছে মিল মালিক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বাবুবাজার, ঠাটারিবাজারসহ সব বাজারের খুচরা ও পাইকারী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সব ধরনের চালের দামই বেড়েছে। কারণ হিসেবে তারা দায়ী করছেন করপোরেট কোম্পানি ও মিল মালিকদের। কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী কামাল হোসেন বলেন, নাজিরশাইল চাল ৭০ টাকা থেকে বেড়ে ৮২ টাকা কেজি হয়েছিল এবং সেটা ২ টাকা কমে এখন ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিআর ২৮ চাল কেজিপ্রতি ৪ টাকা বেড়েছিল এখন ১ থেকে ২ টাকা কমে ৫০ থেকে ৫২ টাকায়, মিনিকেটে ৫ টাকা বেড়ে ছিল এখন ২ টাকা কমে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে চাল এনে কারওয়ান বাজারে ব্যবসা করেন মো. নাজিম উদ্দিন। মিলাররা গত নির্বাচনকে ইস্যু করে কেজিতে ৪ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছিল বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, এই দাম বাড়ানোর কোনো কারণ ছিল না। তবে নির্বাচনের পর সরকার এসে অভিযান চালানোর পর দাম কিছুটা কমেছে। এটা অব্যাহত থাকলে দাম আরও কমবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক মো. তাজুল ইসলাম পাটোয়ারী গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, এবছর আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও উৎপাদন বেশি হয়েছে। ১ কোটি ৭০ লাখ টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ টন। এ অবস্থায় চালের দাম বৃদ্ধির কোন কারণ থাকতে পারে না। এটা কোন কারসাজির মাধ্যমেই বাজারকে অস্থিতিশীল করা হচ্ছে।

এ মৌসুমে চালের দাম কেন এত বাড়ল তা জানতে চাইলে নওগাঁ চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন সরদার বলেন, হাটবাজারে ধানের আমদানি কমে গেছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় প্রতি মণে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি দামে ধান কিনতে হচ্ছে। এতে চালের দাম বেড়েছে।

সরকারের দেওয়া তথ্যানুয়ায়ী চাল উৎপাদনে দেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বাংলাদেশে গত অর্থবছরে প্রায় চার কোটি টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে বোরোতে ২ কোটি ১০ লাখ টন। এর মধ্যে মোটা চাল প্রায় ৬০ লাখ টন। আর সরু ও মাঝারি চালের পরিমাণ দেড় কোটি টন। ধারাবাহিকভাবে মাঝারি চালের উৎপাদন বাড়ছে। গত এক যুগে দেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত ধানের নতুন জাত থেকে বেশির ভাগই মাঝারি মানের চাল আসছে। অন্য দিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বিভাগের হিসাব অনুসারে বর্তমানে দেশের ১৭ কোটি মানুষের চালের চাহিদা ৩ কোটি ১২ লাখ টন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই হিসাব মতে দেশে প্রতি বছরই প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু উদ্বৃত্ততো থাকেই না উল্টো প্রতি বছর লাখ লাখ টন চাল আমদানি করতে হচ্ছে। গত বছরও প্রায় ৯ লাখ টন চাল আমদানি করতে হয়েছে। আমদানি করেও চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এমনটা কেন হচ্ছে। তাহলে কি হিসাবের মধ্যে কোন সমস্যা রয়েছে? অর্থনীতিবিদরা বলছেন সরকারের বিভিন্ন সংস্থা উৎপাদনের যে তথ্য দিচ্ছেন তা সঠিক নয়। এ তথ্যের সঙ্গে বাস্তবের অনেকটা ফারাক থেকে যাচ্ছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ইনকিলাবকে বলেন, চালের উৎপাদন এবং চাহিদার হিসাবে যে গরমিল তাতে এসব প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। তবে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বর্তমানে আমাদের চাহিদা পূরণে তা সক্ষম। চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজার ব্যবস্থাপনা এবং যথাযথ তদারকি জরুরি। তিনি বলেন, বর্তমানে ধানের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। কৃষি উপকরণ, সেচ, সার, বীজ, কীটনাশক, শ্রমিকের মজুরি সব বেড়ে যাওয়ায় প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ গত বছরের চেয়ে কমপক্ষে দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ টাকা বেড়েছে। তাই কৃষকদের ন্যায্যমূল্য দিতে হলে ধানের দাম বাড়াতে হবে। আর ধানের দাম বাড়লে চালের দাম স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। কবে বর্তমানে যেভাবে দাম বাড়ছে সেটা যৌক্তিক বলে মনে হয়না। এ জন্য যথাযথ বাজার তদারকি প্রয়োজন।

https://dailyinqilab.com/national/article/640229