২৯ জানুয়ারি ২০২৪, সোমবার, ১২:১৩

ডাকাতদলে কিশোর-তরুণ বাড়ছে

 

গভীর রাতে বাড়ির লোকজন ঘুমিয়ে। এ সময় একদল ডাকাত হানা দিল বাড়িতে। অস্ত্রের মুখে সবাইকে জিম্মি করে স্বর্ণালংকারসহ কয়েক লাখ টাকার মালপত্র লুট করে তারা। এ সময় গৃহকর্তাসহ নারী ও শিশুকে মারধর করা হয়।

গত বছরের ৫ অক্টোবর পটুয়াখালীর রামলক্ষ্মণগ্রামের সেলিম গাজীর বাড়িতে এই ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় করা মামলায় ১০ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ। তাদের মধ্যে আদালতে ছয়জনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার তথ্য জানিয়ে বাউফল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আতিকুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এলাকায় ডাকাতির ঘটনা বেড়েছে। সেলিম গাজীর বাড়িতে ডাকাতির ঘটনায় জড়িত সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

জিজ্ঞাসাবাদে গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর অবসরপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তা রেজাউলের বাড়িতে ডাকাতির ঘটনায়ও তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।’

গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ছয়জন কিশোর-তরুণ জানিয়ে পরিদর্শক বলেন, নবীন-প্রবীণ মিলিয়ে এটি একটি বড় ডাকাতদল। সারা দেশে তাদের আরো সহযোগী রয়েছে। এরা আধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে খুব দ্রুত মালপত্র লুটে নেয়।

মাত্র এক মিনিটে যেকোনো তালা খুলতে পারে। আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র রয়েছে তাদের। ঢাকাসহ সারা দেশে দৌরাত্ম্য ছিল তাদের।

গ্রেপ্তার ডাকাতদের তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ সূত্র বলছে, সারা দেশে এমন ২৫টির বেশি ডাকাতদলের খোঁজ মিলেছে। গত ১০ অক্টোবর বিকেলে রাজধানীর উত্তরা এলাকার একটি টেক্সটাইল কারখানার দুই কর্মকর্তাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ৪৮ লাখ টাকাসহ তিনটি মোবাইল ফোন এবং কম্পানির খালি চেকবই ছিনিয়ে নেয় ডাকাতরা।

এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সংঘবদ্ধ ডাকাতদলের সাতজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাদের কাছ থেকে ডাকাতির ২৩ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়।

গত ২৭ জুন রাজধানীর বাড্ডা এলাকার লিংক রোডের একটি ফ্ল্যাটে পরিবারের সদস্যদের হাত-পা বেঁধে ৩০ ভরি স্বর্ণালংকার এবং ১১ লাখ টাকা লুট করে ডাকাতরা। এ ঘটনায় বাড্ডা থানায় মামলা করা হয়েছে।

পুলিশ ও র‌্যাবের মাসিক অপরাধমূলক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশে দেড় হাজারের বেশি ডাকাতি-দস্যুতার ঘটনা ঘটে।

র‌্যাব জানায়, ২০২৩ সালে রাজধানী ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে ডাকাতির ঘটনায় জড়িত অভিযোগে ৬৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে কিশোর ও তরুণ রয়েছে।

২০২৩ সালে র‌্যাবের উল্লেখযোগ্য অভিযানের মধ্যে রয়েছে, ১ জানুয়ারি র‌্যাব-৪ ও র‌্যাব-১১-এর একটি দল ঢাকার আশুলিয়ার নবীনগর এলাকায় অভিযান চালিয়ে সংঘবদ্ধ আন্ত জেলা ডাকাতদলের প্রধান আলমগীরসহ ১৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। গত ১৬ মার্চ র‌্যাব-১১-এর একটি দল গজারিয়ার চর বাউসিয়া এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডাকাতি চলাকালে ডাকাতচক্রের দলনেতাসহ আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক সরঞ্জাম ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। গত ৮ এপ্রিল র‌্যাব-৭-এর একটি দল ফৌজদারহাট কালুশাহ মাজারসংলগ্ন মহাসড়কে অভিযান চালিয়ে ১০ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। গত ৯ আগস্ট র‌্যাব-২-এর একটি দল রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় পাঁচ ডাকাতকে দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে। গত ১৫ ডিসেম্বর র‌্যাব-৯-এর একটি দল ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর এলাকা থেকে লুণ্ঠিত মালপত্রসহ তিন ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, গত বছর অনেক ডাকাতির অভিযোগ পাওয়া যায়। বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘবদ্ধ ডাকাতচক্রের বিরুদ্ধে র‌্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি ও জোরালো অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

পুলিশের তথ্য
ডিএমপি সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা মহানগর পুলিশের আটটি ক্রাইম বিভাগের ৫০ থানায় দস্যুতা ও ডাকাতির মামলা করা হয়েছে ২৩৫টি। এর মধ্যে দস্যুতার মামলা করা হয়েছে ১৯৯টি আর ডাকাতির ৩৪টি। এ ছাড়া ছিনতাইয়ের মামলা করা হয়েছে ১০৩টি।

ডিএমপির গত বছরের অপরাধবিষয়ক মাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে ডিএমপির আটটি ক্রাইম বিভাগের প্রতিটি থানা এলাকায় দস্যুতা ও ছিনতাইয়ের পাশাপাশি ডাকাতির ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে রমনা বিভাগে ২৮টি, ওয়ারী বিভাগে ৩৬টি, লালবাগে ২৩টি, মতিঝিলে ৩৪টি, মিরপুরে ১৯টি, গুলশানে ১৮টি, উত্তরয় ২১টি এবং তেজগাঁওয়ে ৬৫টি মামলা করা হয়।
ডিএমপির অপরাধবিষয়ক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে জানা যায়, ২০২২ সালে ডিএমপিতে মোট মামলা করা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৪৯টি। এসবের মধ্যে ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় ১৭২টি মামলা করা হয়। এই হিসাবে ২০২২ থেকে ২০২৩ সালে এ ধরনের ঘটনা বেড়েছে।

দস্যুতা-ছিনতাই বেড়েছে
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর তিন শতাধিক স্থানে দস্যুতা ও ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটে। এরপর উল্লেখযোগ্য হলো গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, রমনা, আবদুল্লাপুর বাসস্ট্যান্ড, আজমপুর বাসস্ট্যান্ড, কুড়িল বিশ্বরোড, ৩০০ ফুট, মতিঝিল ব্যাংকপাড়া, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, খিলগাঁও, বাসাবো, কমলাপুর, শাহবাগ, সায়েদাবাদ, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও উত্তরা। এ ছাড়া পুরান ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকায় দস্যুতার ঘটনা ঘটে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার খন্দকার মহিদ উদ্দীন বলেন, ‘গত এক বছরে এক হাজারের বেশি ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। কিছু কিশোরও আছে তাদের সঙ্গে। তারা জামিনে বের হয়ে একই কাজে জড়াচ্ছে। তাদের দমনে আমাদের তৎপরতা চলছে।’

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, দেশে সব ধরনের অপরাধের মধ্যে এখন কিশোর-তরুণদের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। শুধু পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা কিছুটা কঠিন। এ ক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজের নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষের ভূমিকা জরুরি।

নাম প্রকাশ না করে পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, এসব ডাকাতি-দস্যুতার মধ্যে যেসব কিশোর-তরুণ রয়েছে, তাদের বেশির ভাগই মাদকাসক্ত। নেশার টাকা জোগাতে তারা ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছে।

পুলিশের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালে ঢাকায় ৬৩টি ছিনতাইয়ের মামলা করা হয়। পরের বছর ২০২২ সালে সেই মামলার সংখ্যা বেড়ে ১০৩-এ পৌঁছে। পরের বছরও ছিনতাইয়ের ১০৩টি মামলা করা হয়।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2024/01/29/1358884