২৮ জানুয়ারি ২০২৪, রবিবার, ১১:৪৭

নির্বাচনের দিন ১৮ সাংবাদিক প্রহৃত ও নিগৃহীত

বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ৭ই জানুয়ারি অনিয়ম ও সহিংসতার অভিযোগ কভার করতে গিয়ে অবমাননা অথবা হয়রানির শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ১৮ জন সাংবাদিক। বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে এ কথা জানিয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। তারা বিবৃতিতে বলেছে, বিরোধীদের নির্বাচন বর্জন এবং কম ভোটার ভোট দেয়ার মধ্যদিয়ে পঞ্চমবারের মতো ক্ষমতায় ফিরেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ নির্বাচনকে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি’ বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নিউ ইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরো প্রধান মুজিব মাশাল সিপিজেকে বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য নির্বাচনের আগেই তারা বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সরকার তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্যদিকে দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর মতে সরকারের সমালোচনামূলক রিপোর্ট প্রকাশের কারণে মানবজমিন পত্রিকার ওয়েবসাইট ব্লক করে দেয়া হয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগের দিন শনিবার, ৬ই জানুয়ারি। কী কারণে পত্রিকাটির ওয়েবসাইট ব্লক করে দেয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কোনো নোটিশ পায়নি এই পত্রিকাটি। আবার ৮ই জানুয়ারি সোমবার ওয়েবসাইটটি চালু করে দেয়া হয়।

নির্বাচনের দিন স্থানীয় সময় দুপুর একটার দিকে আওয়ামী লীগের ব্যাজ লাগানো ১৫ থেকে ২০ জনের মতো মানুষ সাতজন সাংবাদিকের ওপর হামলা করে। ওই সাংবাদিকরা হলেন- আনন্দ টিভির সংবাদদাতা এমএ রহিম, একই টিভির ক্যামেরা অপারেটর রিমন হোসেন, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইনিউজ৭১-এর সংবাদদাতা মাসুদ রানা, মোহনা টিভির সংবাদদাতা সুমন খান, বাংলা টিভির সংবাদদাতা ইলিয়াস বসুনিয়া, দৈনিক ভোরের চেতনার সংবাদদাতা মিনাজ ইসলাম এবং দৈনিক দাবানলের সংবাদদাতা হযরত আলি।

রহিম ও রানার মতে, তারা উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাটের একটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর রহমানের ওপর আক্রমণের রিপোর্ট কাভার করছিলেন। এ সময় হামলাকারীরা লোহার রড ও বাঁশের লাঠি দিয়ে এসব সাংবাদিকদের প্রহার করে। অন্যদেরকে প্রহার ও ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে থাকে। ওইসব সূত্র এবং হাতিবান্ধা পুলিশ স্টেশনে রানা যে অভিযোগ দিয়েছেন সে অনুযায়ী, হামলাকারীরা এ সময় সাংবাদিকদের ক্যামেরা, মাইক্রোফোন সহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ভাঙচুর করে এবং কেড়ে নেয়। অভিযোগে বলা হয়েছে, এই হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছে আতাউর রহমানের প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাসীন পার্লামেন্টারিয়ান প্রার্থীর ভাতিজা মো. জাহিদুল ইসলাম এবং মো. মোস্তাফা। মো. জাহিদুল ইসলাম সিপিজে’কে বলেছেন, তিনি এই হামলায় জড়িত নন। হামলায় মোস্তাফা জড়িত থাকার প্রশ্নে কোনো উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। সিপিজে জানতে চাইলে এ মামলার বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান হাতিবান্ধা পুলিশ স্টেশনের ওসি সাইফুল ইসলাম।

অন্যদিকে বিকাল ২টা ৪০ মিনিটের দিকে ডেইলি স্টার পত্রিকার সংবাদদাতা সিরাজুল ইসলাম রুবেল, একই পত্রিকার রিপোর্টার আরাফাত রহমান রাজধানী ঢাকার একটি ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ব্যালটবাক্স ভর্তি করার রিপোর্ট করতে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টাকালে তাদেরকে ঘিরে ধরে প্রায় ২৫ জন মানুষ। তারা ওই সাংবাদিকদের ফোন কেড়ে নেন। ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও ছবি মুছে দেন। ডেইলি স্টারের রিপোর্টার দীপন নন্দির সঙ্গে ভোটকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যেতে বাধা সৃষ্টি করেন। ওই ভোটকেন্দ্রের রিপোর্ট সংগ্রহে রুবেল এবং আরাফাত রহমানের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন দিপন নন্দি। পরে প্রায় ৩টা ৫ মিনিটের সময় পুলিশি সহায়তায় তারা ভোটকেন্দ্র ত্যাগ করতে সক্ষম হন।

অন্যদিকে ২টা ৪৫ মিনিটের দিকে চট্টগ্রাম শহরে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা ব্যালট দিয়ে বাক্স ভর্তি করছেন এমন অভিযোগের পর ছবি ধারণ ও ভিডিও করার পর প্রথম আলোর সংবাদদাতা মোশাররফ শাহকে প্রহার করে ২০ থেকে ২৫ জন। মোশাররফ শাহ বলেছেন, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তার সঙ্গে এ ঘটনা নিয়ে কথা বলার সময় ওই ব্যক্তিরা তার দিকে এগিয়ে যায়। তার নোটবুক কেড়ে নেয়। তিনি যা দেখেছিলেন, তার নোট রেখেছিলেন এতে। তার মোবাইল ফোন থেকে পুলিশের উপস্থিতিতে ভিডিও ফুটেজ মুছে দেয়। ওই সাংবাদিক সিপিজে’কে আরও বলেছেন, প্রায় ৩০ মিনিট পর তিনি ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে সক্ষম হন। তার আগে তাকে চড়থাপ্পড় ও ঘুষি মারা হয়। তিনি আরও বলেছেন, তার সহকর্মী সাংবাদিকদের সহায়তায় প্রায় এক ঘণ্টা পর ফিরে পেয়েছেন ফোন। হামলাকারীদের মধ্যে একজনকে নুরুল আবসার হিসেবে শনাক্ত করতে পেরেছেন সাংবাদিক মোশাররফ শাহ। নুরুল আবসার আওয়ামী লীগের ছাত্র বিষয়ক সংগঠন ছাত্রলীগের স্থানীয় ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক। এ বিষয়ে মন্তব্য চাইলে নুরুল আবসার কথা বলতে রাজি হননি। এর আগে মোশাররফ শাহের ওপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হামলা চালায় ছাত্রলীগের সদস্যরা।

ঢাকার ভেতরে একটি ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা ব্যালট দিয়ে বাক্স ভর্তি করছিলেন। এর ছবি ধারণ করেন দৈনিক কালবেলার সাব-এডিটর সাইফ বিন আইয়ুব। বিকা প্রায় ৪টার দিকের এ ঘটনা। এ সময় ২০ থেকে ৩০ জন ব্যক্তি তাকে ঘিরে ধরে অপদস্থ করে এবং তার ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন ও অন্যান্য ব্যক্তিগত জিনিসপত্র কেড়ে নেয়। তারা এই সাংবাদিককে একটি দেয়ালের সঙ্গে ঠেসে ধরে। ঘুষি মারতে থাকে। পেটে লাথি মারে। গলায় ঝুলানো তার পরিচয়পত্র জোর করে কেড়ে নেয়ার সময় তার শরীরে আঁচড় লাগে। এই সাংবাদিক বলেছেন, হামলাকারীরা তাকে ভবনটির ভেতর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নেয়। ঘটনাস্থলে পুলিশের উপস্থিতি থাকায় তিনি তাদের সাহায্য কামনা করেন। কিন্তু তারা পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করেনি। তাকে বাইরে নিয়ে প্রায় ১৫ মিনিট ধরে প্রহার করে। তিনি বলেন, পরের দিন মোবাইল ফোন এবং ভাঙা ল্যাপটপ ফিরে পেলেও তিনি ওয়ালেট, হাতঘড়ি ও অন্যান্য জিনিসপত্র ফিরে পাননি।
আলাদা আরেক ঘটনা ঘটে ঢাকার একটি ভোটকেন্দ্রে। সেখানকার একটি ভোট গ্রহণের কক্ষের বাইরে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ভিডিও বিষয়ক সাংবাদিক স্যাম জাহানকে আওয়ামী লীগের ব্যাজ পরা নির্বাচনী কর্মকর্তারা এবং কিছু টিনেজার মিলে ৮ থেকে ১০ জন ধাক্কা দিতে থাকে বিকাল ৪টার দিকে। ওই টিনেজারদের দু’জন এই সাংবাদিককে পরে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয়।

ঢাকার আরেকটি ভোটকেন্দ্রে খবর সংগ্রহে গেলে নিউএজ পত্রিকার চারজন সাংবাদিককে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা ঘিরে ধরে এবং তাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করে। এই সংবাদিকরা হলেন মুক্তাদির রশিদ, ফটোসাংবাদিক সৌরভ লস্কর, রিপোর্টার নাসির উজজামান এবং তানজিল রহমান। আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহযোগী বিপ্লব বড়ুয়া সিপিজেকে বলেছেন, নির্বাচনের দিনে সাংবাদিকদের ওপর সব হামলায় দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে আইনপ্রয়োগকারীরা। তিনি আরও বলেন, এসব ঘটনায় সরকার তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে বিচার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

https://mzamin.com/news.php?news=95170