২৮ জানুয়ারি ২০২৪, রবিবার, ১১:৩৮

অর্থনীতির মূল সঙ্কট আসলে কোনটি

-ড. মো: মিজানুর রহমান

সমস্যায় জর্জরিত দেশের অর্থনীতি। স্বাধীনতার পর একসাথে এত চ্যালেঞ্জে পড়েনি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। অর্থনীতির সব সূচক যেমন- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, টাকার মান কমে যাওয়া, মুদ্রাস্ফীতি, আমদানি-রফতানি, চলতি হিসাবে ঘাটতি, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের ভয়ানক অবস্থা, ব্যাংক ঋণ, খেলাপি ঋণ, শেয়ার বাজার, বেকারত্ব, ইত্যাদি স্মরণকালের সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। ব্যাংকিং খাত আরো দুর্বল হচ্ছে। কমছে রাজস্ব আয়। প্রতিটি সূচকেরই অবস্থা এমন যে, কোনটির চেয়ে কোনটি বেশি খারাপ শনাক্ত করা কঠিন।

এই কঠিন বিষয়টি সহজ করে দিয়েছে দেশের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি ব্যবসায়ীদের মতামতেরভিত্তিক জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে গত ১৭ জানুয়ারি। তাতে দেখা যায়, প্রায় ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ীর মতে দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যে এক নম্বর সমস্যা দুর্নীতি। ৫৫ শতাংশ ব্যবসায়ীর মতে, দ্বিতীয় স্থানে আছে অদক্ষ আমলাতন্ত্র। ৪৬ শতাংশ ব্যবসায়ীর মতে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে তৃতীয় বড় সমস্যা বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতার অভাব।

২০২৩ সালে ব্যবসায় পরিবেশ কেমন ছিল, সেটি বিশ্লেষণ করতেই এই জরিপ চালানো হয়। গত বছরের মে-জুলাই সময়ে ঢাকা, গাজীপুর ও সাভারের বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ৭১ শীর্ষ কর্মকর্তার মতামত নেয়া হয়। জরিপে সহায়তা করে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ)। এ ছাড়া ডব্লিউইএফের ফিউচার অব গ্রোথ রিপোর্ট ২০২৩-এর বাংলাদেশ অংশের জন্য সিপিডি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে।
জরিপে দেখানো হয়, পাবলিক ইউটিলিটি, রেজিস্ট্রেশন, আমদানি-রফতানি, লাইসেন্স নেয়া, পাবলিক কন্ট্রাক্ট নেয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি ব্যবসায়ীদের নিয়মিত ভোগাচ্ছে। এ ছাড়া ব্যবসায়িক কার্যক্রমের অন্যতম বাধা ঘুষ। একজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, একটি পরিষেবা সংযোগ নেয়ার আবেদন করলে তার কাছে যে পরিমাণ ঘুষ চাওয়া হয়েছিল, তা তার পরিকল্পিত বিনিয়োগের সমান। তার মতে, বড় ব্যবসায়ীরা কোনো না কোনোভাবে ঘুষ-দুর্নীতি সামলে নিতে পারলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের কাছে এটি বড় সমস্যা।

মোটাদাগে ব্যবসায়-বাণিজ্যে ১৭টি সমস্যা চিহ্নিত করেছে সিপিডি। সিপিডির মতে, অর্থপাচার ব্যাপক হারে হচ্ছে যা ঠেকানো বড় চ্যালেঞ্জ। ৬০ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, এখনো ২৩ শতাংশ কর ফাঁকি হচ্ছে। ব্যবসায়-বাণিজ্যে এবার নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে। যেমন বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট। এসব কারণে ব্যবসায় পরিবেশ জটিলতর হয়েছে। কিছু ব্যবসায়ীর সক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু এ সংখ্যা খুবই কম। সমস্যাগুলোর সমাধান না হলে বৈষম্য বাড়বে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে যাবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা পিছিয়ে পড়বে।

দুর্নীতি বন্ধসহ ব্যবসায়-বাণিজ্যের সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক শীর্ষ পর্যায়ে সদিচ্ছা প্রয়োজন। ব্যবসায়-বাণিজ্যের পরিবেশে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ তলানিতে আছে। ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডসহ এশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায়ও বেশ পিছিয়ে আছে দেশটি। দক্ষিণ এশিয়ার বিবেচনাতেও বাংলাদেশ এগিয়ে নেই। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের দক্ষতা ভালো বলা যাবে না। বাংলাদেশে ডেল্টা প্ল্যান থাকলেও বাস্তবায়নটা অনেক বেশি আমাদের চোখে পড়ছে না। তাই আমরা অন্য দেশের চেয়ে পিছিয়ে আছি।

ব্যবসায়-বাণিজ্যের পরিবেশের উন্নয়নে সিপিডি ১০টি সুপারিশ করেছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও মনিটরিং করা। ব্যাপক দুর্নীতি রোধে স্বাধীন ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা ও তাদের সব ধরনের ফ্যাসিলিটি দেয়া। ব্যাংক, শেয়ারবাজার, নিয়ন্ত্রক সংস্থার সংস্কার ও টাকা পাচার বা দুর্নীতি ধরতে একটি সমন্বিত আর্থিক লেনদেন কাঠামো তৈরি করা। সরকারি কেনাকাটা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার ও আধুনিকায়ন। প্রতিযোগিতা করার জন্য যে সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোকে আরো শক্তিশালী করা এবং আইন-কানুন, বিধি-বিধানে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা, যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ, ব্যবসায় আরো এগিয়ে যেতে পারবেন।

রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দুর্নীতি
ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতির কারণে অর্থনীতি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না। সিপিডির প্রতিবেদনে লুটপাটের যে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে, দেশের শীর্ষ তিন অর্থনীতিবিদের মতে, লুটপাটের প্রকৃত চিত্র তার চেয়েও ভয়াবহ। আরো ভয়াবহ হলো- এ টাকার বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে। মূলত সরকারের ভুল নীতির কারণেই অপরাধীরা সুবিধা পেয়েছে। অপরাধী ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কারো কারো জোগসাজশের ফলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ব্যাংকিং খাত এখন জিম্মি দশায় আছে। এ খাত নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্ব কমে গেছে। তারা কিছু করতে পারছে না।

ব্যাংকিং খাতে লুটপাট রাজনৈতিক প্রভাবেই। ২০০৯ সাল থেকে দেশে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় চতুর্থ প্রজন্মের ১৩টি বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ছিল ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির রাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া। বিশেষজ্ঞ এমনকি সরকারের ঘনিষ্ঠ লোকেরাও এতে আপত্তি জানিয়েছিলেন। তার পরও লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক সিদ্ধান্ত যতটা না সামনে থেকে নেয়া হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি নেয়া হচ্ছে পেছন থেকে; কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থে।

এত ছোট অর্থনীতির একটি দেশে ৬১টি ব্যাংক অনেক বেশি। একই ধরনের প্রোডাক্ট ও সেবা নিয়ে প্রতিযোগিতা করছে ৫২টি বাণিজ্যিক ব্যাংক। পরিসংখ্যান বলছে, ৩০০ থেকে ৫০০ বিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি। অর্থনীতির তোয়াক্কা না করে এই ব্যাংকগুলো ব্যাংকিং নয় বরং জনগণের অর্থ লোপাটেই যেন বেশি মনোযোগী। দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী এরা। সরকারের অনেক পদক্ষেপ খেলাপিদের পক্ষে গেছে। একটার পর একটা ছাড় পেয়েছেন খেলাপিরা। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা বদলানো হয়েছে বারবার। এমনকি আইন সংশোধন করে তাদের একাধিকবার ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা দেয়া হয়েছে। সঠিক পর্যালোচনা ও জাস্টিফিকেশন ছাড়াই মনগড়াভাবে লোন রাইট অফ করা হচ্ছে দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করতে। কাগজ-কলমে ক্ষমতা, নিয়ম-নীতি থাকলেও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক তা প্রয়োগ করতে পারছে না।

ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের দাম এক বছরে ৩০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। রিজার্ভের ধসও ঠেকানো যাচ্ছে না। রেমিট্যান্সের বিপর্যয় আরো গভীর হয়েছে। ডলারের অভাবে ব্যবসায়ী ও শিল্পমালিকরা এলসি খুলতে পারছেন না। সাধারণ মানুষ নিত্যদিনের খরচ মেটাতে পারে না। উন্নয়নের নামে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ফলে দেশ এখন প্রায় ২০ লাখ কোটি টাকা ঋণের ভারে পিষ্ট। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব, ভ্রান্তনীতি গ্রহণ, নীতির সমন্বয়হীনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব, সর্বোপরি লাগামহীন দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ সঙ্কট থেকে বের হতে পারছে না।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ক্যাপিটাল অ্যাডিকুয়েসির অনুপাত ১১ দশমিক ২ শতাংশ, যেখানে ভারতের ১৬ শতাংশ, পাকিস্তানের ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও শ্রীলঙ্কার ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সর্বশেষ গ্লোবাল কম্পিটিটিভনেস রিপোর্ট অনুযায়ী, ব্যাংকিং ব্যবস্থা সাউন্ডনেসে ১৪১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩০তম, যা সাউথ এশিয়ান অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বনিম্ন। অপর দিকে, গ্লোবাল ইকোনমির গবেষণা মতে, বিশ্বের ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় ১৩৬ দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ৮৫তম, যা ২০০৯ সালের তুলনায় ২২ ধাপ পিছিয়েছে। বিগ থ্রি হিসেবে পরিচিত বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী তিনটি রেটিং এজেন্সি বাংলাদেশের ঋণমান যেভাবে হ্রাস করেছে বা নেতিবাচক সঙ্কেত দিয়েছে, তাতে অর্থনীতি ‘রেড ফ্ল্যাগস’ এ উঠে এসেছে। বিদেশী ঋণ প্রদানকারী ও বিনিয়োগকারীরা আর আস্থা রাখতে পারছেন না। নজিরবিহীন তারল্য সঙ্কটের কারণে অনেক ব্যাংক ধার করে চলছে। আস্থার সঙ্কটের কারণে অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখছেন । অনাদায়ী ঋণ, খেলাপি ঋণের ফলে তারল্য সঙ্কটের কারণে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে লোন দেয়া সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে।

অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, আদালত ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানও সামগ্রিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আনু মুহাম্মদ বলেন, অর্থনীতিতে স্বচ্ছতার সমস্যা, জবাবদিহির সমস্যা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতার সমস্যা এখন প্রকট। ব্যাংক থেকে একটি গ্রুপের বিপুল অর্থ পাচার নিয়ে পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হয়, অথচ সরকারের দিক থেকে কোনো সাড়া নেই।

ব্যাংকার মোহাম্মদ আলী বলেন, দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা লুণ্ঠন। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশে এত এত কোটিপতি হচ্ছে। এই কোটিপতিরা শত-সহস্র কোটি টাকার মালিক। কিন্তু সেই হারে কর আদায় বাড়ছে না। বিনিয়োগ হারিয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ২৩-২৫ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে অনেক দিন ধরে। রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আমদানি সঙ্কুুচিত করা হয়েছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে। ফলে কর্মসংস্থান বাড়ছে না; আয়ও বাড়ছে না। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, দেশের অর্থনীতির সব সেক্টরে সঙ্কট। দুর্নীতির কারণেই বেশির ভাগ সঙ্কটের সৃষ্টি; সমাধানের জন্য প্রয়োজন সুশাসন।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
Mizan12bd@yahoo.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/809631