২৬ জানুয়ারি ২০২৪, শুক্রবার, ৪:২৪

মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে দুর্দশা

সড়ক দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা, খুনসহ যেকোনো অপমৃত্যুর কারণ জানতে লাশের ময়নাতদন্ত করতে হয়। এসব লাশের কাটা-ছেঁড়া করতে প্রয়োজন হয় আধুনিক অস্ত্রের। থাকতে হয় এক্স-রে মেশিনসহ বিভিন্ন যন্ত্র। কিন্তু এসবের কিছুই নেই স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে। টিনের ছাপড়ায় দেড়শ’ বছরের পুরানো মর্গটি এখন নিজেই যেন লাশ হয়ে পড়েছে। এখানে আসা লাশের নেই কোনো নিরাপত্তা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ময়নাতদন্ত সঠিকভাবে না হলে মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য উদ্‌ঘাটন ও অপরাধী শনাক্তে বিপাকে পড়তে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।

এ হাসপাতালের মর্গে রাজধানীর ১৯টি থানা ও দুটি ফাঁড়ির অপঘাতে মৃত্যুর শিকার মরদেহগুলোর ময়নাতদন্ত করা হয়। সরজমিন দেখা যায়, মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছনে বাবুবাজার ব্রিজের নিচে এম্বুলেন্স পার্কিং করা ফাঁকা জায়গার শেষ প্রান্তে একটি টিনশেডের জীর্ণ-শীর্ণ ঘরে চলছে মর্গের কার্যক্রম। দেয়াল থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা। ফটকে নড়বড়ে মরিচা পড়া লোহার গ্রিলের দরজা।

চারপাশেই ঝোপ-জঙ্গল। মর্গের সামনে ও ভেতরে মরদেহ রাখার যে ট্রলি তাতেও মরিচা ধরেছে। এখানে ময়নাতদন্ত কার্যক্রমের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের রয়েছে অপ্রতুলতা। মরদেহের কাটাছেঁড়ায় হাতুড়ি, বাটাল, ছুরি, কাঁচিই মর্গটির প্রধান সরঞ্জাম। নেই পোর্টেবল এক্স-রে, এমআরআই, সিটি স্ক্যান মেশিন। মরদেহ রাখার জন্য মর্গে একটি মাত্র মর্চুয়ারি রয়েছে, সেটিও বছরের পর বছর নষ্ট। নেই নমুনা রাখার কোনো ল্যাব। মরদেহগুলো রাখা হয় হাসপাতালের হিমাগারে। ময়নাতদন্তের কাজে সহায়তাকারী ডোমেরও রয়েছে স্বল্পতা। পুরো মর্গে একজন ডোম ও দুজন সহকারী। দুই কক্ষবিশিষ্ট এই টিনের ছাপড়ার মর্গে ময়নাতদন্তের জন্য একটার বেশি লাশ আসলেই রাখতে হয় বাইরে। নেই পর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা।

মর্গটির দায়িত্বে থাকা শ্যামল চন্দ্র দাস বলেন, মর্গের একটা মাত্র মর্চুয়ারি। তাও বছরের পর বছর নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। একেতে ছোট মর্গ এর ওপর নষ্ট মর্চুয়ারিটি রুমের বেশিরভাগ জায়গা দখল করে আছে। তিনি বলেন, মর্চুয়ারিটি যখন ভালো ছিল তখন মরদেহ আসলেই স্টোরেজে ঢুকিয়ে রাখতাম। ১২টি লাশ রাখা যেতো এক সঙ্গে। তারপর ধীরে ধীরে ময়নাতদন্তের কাজ করা হতো। কিন্তু এটি নষ্ট হয়ার পর আমাদের কষ্টের শেষ নেই। কখনো কখনো একাধিক মরদেহ বরফ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করতে করতে অনেক রাত হয়ে যায়। ফলে অনেক রাতে বাসায় ফিরতে হয়। তিনি বলেন, ফ্রিজটি নষ্ট হওয়ার পর থেকে অন্তত ৬ থেকে ৭টি আবেদনপত্র দিয়েছি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। তারা সংশ্লিষ্ট মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে দিয়েছেন। মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানটি আজ নয় কাল করে করে সময় পার করছে। মূলত মেরামত ব্যয় বেশি হবে বলে এভাবেই মর্চুয়ারিটি পরে আছে। অনেক সময় অজ্ঞাত পরিচয় মরদেহ এলে শনাক্তের দুই থেকে ৩দিন মর্গে রাখার প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত মর্চুয়ারির অভাবে মরদেহ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা যায় না। এতে মরদেহে পচন ধরে যায়। আশেপাশে দুর্গন্ধ ছড়ায়। আলামত নষ্ট হয়। মর্গের ভেন্টিলেশন ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও নাজুক। বাধ্য হয়েই সংকট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর কামদা প্রসাদ সাহা বলেন, আমাদের হাসপাতালের মর্গের বড় সমস্যা অবকাঠামো। দুই কক্ষের একটি টিনের ছাপড়া ঘরে দীর্ঘদিন ধরে মর্গের কার্যক্রম চলে আসছে। কিছুদিন আগেও মর্গে চুরি হয়েছে। নতুন যন্ত্রপাতি যে কিনে রাখা হবে সেই উপায়ও নেই। তাই যা আছে সেগুলো দিয়েই কাজ চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, মর্গের ভেতরেও তো যাচ্ছে তাই পরিবেশ। একটা মাত্র মর্চুয়ারি, সেটিও নষ্ট। লাশ রাখতে হয় হাসপাতালের ফ্রিজে। একটার বেশি লাশ আসলে সেগুলো মর্গের বাইরে অপেক্ষায় রাখতে হয়। ময়নাতদন্তের কার্যক্রমের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির চাহিদা দিয়েছি একাধিকবার কিন্তু কাজ হয়নি। তিনি বলেন, যেখানে লোকবল দরকার কমপক্ষে ৩ জন ডোম, সেখানে মাত্র একজন কাজ করছেন। তবুও তিনি স্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত নন। আমাদের শিক্ষকেরও সংকট রয়েছে। এ সংকটের প্রভাব সরাসরি মর্গে পড়ছে। মর্গে আমি ছাড়াও অন্য শিক্ষকদেরও যেতে হয়। আমিও সবসময় যেতে পারি না। বিভিন্ন কোর্টে খুনের মামলার সাক্ষী দিতে ছুটতে হয়। অনেক বলেছি, আবেদন করেছি, কোনো কাজ হয়নি। তবে শুনছি সামনে বেশ কয়েকটি হাসপাতালে নতুন মর্গ তৈরির প্রকল্প হাতে নিচ্ছে অধিদপ্তর। সেই তালিকায় আমাদেরটাও থাকতে পারে বলে আশা করছি।

https://mzamin.com/news.php?news=94882