২৫ জানুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৩:১২

শিল্পাঞ্চলে ছাঁটাই আতঙ্ক

ক্রমবর্ধমান গ্যাস জ্বালানি সঙ্কটে শিল্প কারখানায় উৎপাদনে ধস নেমেছে। উৎপাদন এবং সেই সাথে রফতানি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। কাজ না থাকায় বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে শ্রমিকদের। তাতে লোকসান গুণছেন শিল্প মালিকেরা। ফলে শ্রমিকদের মাঝে ছাঁটাই আতঙ্ক বিরাজ করছে। কোথাও আবার নানা অজুহাতে নীরবেই শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। চট্টগ্রামের সরকারি বেসরকারি তিনটি ইপিজেডসহ এখানকার শিল্পাঞ্চলগুলোতে কাজ হারানো ভয়ে রয়েছেন লাখো শ্রমিক। সব চেয়ে বেশি আতঙ্কে পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা। দেশে এমনিতেই বেকারত্ব বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। তার উপর নজিরবিহীন মূল্যস্ফীতির মধ্যে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হলে আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও সার্র্বিক আর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বৈশি^ক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে গত বছরের মধ্যভাগ থেকে তৈরি পোশাকসহ রফতানি পণ্যের ক্রয় আদেশ কমতে থাকে। বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে রফতানি অনেক কমে আসে। তার সাথে যুক্ত হয় ডলার সঙ্কট। দেশ থেকে অবাধে পুঁজিপাচার আর আর্থিক খাতে সীমাহীন লুটপাটের কারণে দেশে ডলারের সঙ্কট তীব্র হতে থাকে। ডলারের অভাবে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হয়। নতুন করে যুক্ত হয় শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি।

গত ২০ ডিসেম্বর শ্রমিকদের নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা করা হয়। নতুন এই কাঠামো বাস্তয়াবনের মধ্যেই তীব্র হয়ে উঠে গ্যাসসহ জ্বালানি সঙ্কট। তাতে শিল্প কারখানার উৎপাদনে রীতিমত ধস নামে। বিশেষ করে গ্যাস নির্ভর পোশাক ও ইস্পাত কারখানা অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে। উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ায় রফতানিও থমকে যায়। অব্যাহত গ্যাস, বিদ্যুৎ সঙ্কটে শিল্প কারখানা স্থবির হয়ে পড়ে। ছোটখাট অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। জ¦ালানি সঙ্কট অবসানের কোনো সম্ভাবনাও নেই। চরম এক অনিশ্চয়তা গ্রাস করছে শিল্পখাতকে।
শতভাগ রফতানিমুখি শিল্প মালিকেরা বলছেন, বৈশি^ক মন্দায় রফতানি কমে যাওয়ায় এবং গ্যাসসহ জ্বালানি সঙ্কটের কারণে পোশাক খাত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গত দুই বছর ধরে স্থবিরতা চলছে এই খাতে। এরফলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তীব্র জ্বালানি সঙ্কটের কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। আবার বিশ্ববাজারে দেশি পোশাকের দামও পড়ে গেছে। যথাসময়ে পণ্য জাহাজীকরণ করতে না পারায় রফতানি আদেশ বাতিল হচ্ছে। এতে কারখানাগুলো ক্ষতিরমুখে পড়েছে। কাজ কমে গেছে, অথচ শ্রমিকদের বেতনভাতা দিতে হচ্ছে। এতে কারখানা মালিকদের দায় দেনা কেবলই বাড়ছে।

চট্টগ্রামে এক সময় প্রায় এক হাজারের মতো পোশাক কারখানা ছিল। এই সংখ্যা এখন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। চালু ৫০০ কারখানার মধ্যে ২০০টির মতো কারখানা সরাসরি পোশাক রফতানি করছে। অন্য কারখানাগুলো চলছে খুড়িয়ে। এসব কারখানা সাব-কন্ট্রাক্ট হিসাবে উৎপাদন করছে। কাজ কমে যাওয়ায় অনেক কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বেশির ভাগ কারখানা নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নও করতে পারেনি।

বিজিএমইএর একজন নেতা বলেন, জ্বালানি সঙ্কটে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। আবার রফতানিও কমে গেছে। কারখানার একাধিক ইউনিট বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে কত দিন বেতন দেওয়া যাবে তা নিয়ে আমরা চিন্তিত। একদিকে আয় কমে গেছে, আবার অন্যদিকে ব্যাংক লোনের দায় দেনা বাড়ছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে শ্রমিক ছাঁটাই করা ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না। একই অবস্থা ইস্পাতসহ অন্যখাতের শিল্প কারখানাতেও। কাজ না থাকায় লোকাসনের মুখে কারখানা মালিকেরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই করা হচ্ছে। বিশেষ করে খরচ কমাতে বেশি বেতনের শ্রমিকদের যাবতীয় পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় করে দেওয়া হচ্ছে। অনিশ্চয়তার কারণে শ্রমিকেরাও টাকা পয়সা যা পাচ্ছেন তা নিয়ে নীরবে চলে যাচ্ছেন। অনেকে পেশা বদল করে গ্রামে চলে যাচ্ছেন। কারখানাগুলোতে নতুন নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। নানামুখি সঙ্কটের কারণে চালু কারখানাগুলোতে নতুন ইউনিট চালু হচ্ছে না। আবার নতুন বিনিয়োগও বন্ধ রয়েছে। তাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ রুদ্ধ হয়ে গেছে।

গত ২০ ডিসেম্বর তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা করে সরকার। ওই বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন পোশাক কারখানা মালিকেরা। নতুন কাঠামোয় একজন শ্রমিকের প্রারম্ভিক বেতন সাড়ে চার হাজার টাকা বাড়ানো হয়। কিন্তু অভিজ্ঞ শ্রমিকদের একই পরিমাণ বেতন না বাড়ায় বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেয়। একই হারে বেতনের দাবিতে চট্টগ্রাম ও কর্ণফুলী ইপিজেডসহ শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকরা আন্দোলনে নামে। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শ্রমিকদের দাবির মুখে সকল শ্রমিকের একই হারে বেতন বাড়িয়েছে চট্টগ্রাম ইপিজেডের প্যাসিফিক জিন্স, এইচকেডি, মেরিম কো লিমিটেডসহ কয়েকটি কারখানা। এসব কারখানা বেতন বাড়িয়ে দেওয়ায় অন্য কারখানার শ্রমিকরাও একই হারে বেতন দাবি করেন। এতে অসন্তোষের মুখে কয়েকটি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে পরে শ্রমিকদের দাবি মেনে নিয়ে এসব কারখানা ফের চালু হয়।

শ্রমিকেরা জানান, বৈশি^ক মন্দার কারণে ইপিজেডের কারখানাগুলোতেও কাজ কমে গেছে। অনেক কারখানায় বেশি বেতনের শ্রমিকদের নানা অজুহাতে ছাঁটাই করছে।

তবে চট্টগ্রাম ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুস সোবহান বলেন, ইপিজেডের কারখানাগুলোতে নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন হয়েছে। শুরুতে কিছু ভুল বোঝাবুঝি হলেও পরে তা নিরসন হয়েছে। চট্টগ্রামে গ্যাস বিপর্যয়ের সময় কিছু কারখানায় কিছুটা সমস্যা হলেও এখন জ্বালানি সঙ্কট নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, সব কারখানা পুরোদমে সচল রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইপিজেডের বাইরে কারখানাগুলোতে নতুন বেতন কাঠামো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। এই নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ থাকলে বিদ্যমান মন্দা পরিস্থিতিতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। চাকরি হারানোর ভয়ে শ্রমিকেরা রাস্তায় নামার বদলে সুদিনের অপেক্ষায় আছে। তবে এর মধ্যেও কিছু কিছু কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। আবার গ্যাসসহ জ্বালানি সঙ্কটের কারণে উৎপাদন কমে যাওয়ায় শ্রমিকদের মধ্যে কাজ হারানোর আতঙ্ক বিরাজ করছে। শ্রমিক ছাঁটাই হলে আর্থ-সামাজিক অবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ইস্ট ডেল্টা বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর মুহাম্মদ সিকান্দার খান। তিনি বলেন, এমনিতে দেশে বেকারত্বের সমস্যা প্রকট। তার উপর নতুন করে শ্রমিকেরা কাজ হারালে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বৈশি^ক মন্দার কারণে দেশের শিল্প কারখানায় মন্দা অবস্থা চলছে। এই সঙ্কট থেকে কিভাবে বের হওয়া যায় তার উপায় বের করতে হবে। এসময় শ্রমিকদের প্রতি মালিকপক্ষের মানবিক হওয়া উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, যখন ব্যবসা ভালো ছিল তখন তো মালিকেরা লাভ করেছেন। তখন লভ্যাংশের ভাগতো শ্রমিকেরা পাননি। তারা শুধু বেতন ভাতা পেয়েছেন। ফলে দুঃসময়ে তাদের ছাঁটাই করা অমানবিক হবে।

https://dailyinqilab.com/national/article/633987