২৫ জানুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৩:১২

লাভে চলছে বিপিসি অথচ তেলের দাম কমছে না

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যহ্রাসের সুফল পাচ্ছে না দেশের ভোক্তারা। বিগত কয়েক মাস ধরে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ওঠা-নামা করছে ৭০ থেকে ৮০ ডলারের মধ্যে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির ফলে ক্ষতির হাত থেকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)কে বাঁচাতে ২০২২ সালের আগস্ট মাসে জ্বালানি তেলের দাম ৪৭ শতাংশ বৃদ্ধি করে সরকার ফলে বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছরে চার হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি। তবে, যথেষ্ট মুনাফা ও বিশ্ববাজারে তেলের দাম সহনীয় থাকার পরও দেশের বাজারে আর কমছে না দাম।

বিপিসি লাভ করলেও দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমছে না-প্রসঙ্গে দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, দেশে যখন সরকার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করেছিল, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী ছিল ঠিকই। কিন্তু সেটা স্বল্প সময়ের জন্য ছিল। ওই দামের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বাজারে তেলের দাম বাড়ানো হলো। কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম যখন কমলো, তখন দেশের বাজারে কমানো হলো না।
দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদার মাত্র ৮ শতাংশ পূরণ হয় স্থানীয় উৎস থেকে। আমদানির মাধ্যমে বাকি চাহিদা পূরণে কাজ করে বিপিসি। অপরিশোধিত তেল আমদানি করা হয় সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। এর বাইরে আটটি দেশ থেকে জি-টু-জি চুক্তির মাধ্যমে পরিশোধিত তেল আমদানি করা হয়।

বিপিসি’র বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ১৫ লাখ ৫১ হাজার টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করেছে বিপিসি।

আমদানি বাবদ সংস্থাটির ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া, ৪০ লাখ ৩৬ হাজার টন ডিজেল, প্রায় তিন লাখ ৩৭ হাজার টন মোগ্যাস, চার লাখ ৭৮ হাজার টন জেট ফুয়েল, প্রায় চার লাখ ৩৬ হাজার টন ফার্নেস অয়েল ও ৩০ হাজার টন মেরিন ফুয়েল আমদানি করা হয়েছে। সবমিলিয়ে সংস্থাটি এ সময় মোট পরিশোধিত জ্বালানি আমদানি করেছে প্রায় ৫৩ লাখ ১৭ হাজার টন, যার আর্থিক মূল্য ৫১ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা।

করোনা-পরবর্তীতে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেলে লোকসানের মুখে পড়ে বিপিসি। সেবার ২০২১-২২ অর্থবছরে দুই হাজার ৭০৫ কোটি টাকা লোকসান করে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও এর আগে থেকে লাভের মুখেই ছিল বিপিসি। গত নয় বছরে বিপিসি’র মুনাফার পরিমাণ ৪২ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চার হাজার ২১২ কোটি, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সাত হাজার ৭৫৩ কোটি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চার হাজার ৫৫১ কোটি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছয় হাজার ৫৩৩ কোটি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিন হাজার ৮৪৬ কোটি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ৬৫ কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছরে নয় হাজার ৯২ কোটি টাকা মুনাফা করে বিপিসি। এর মধ্যে কেবল ২০১৬ সালের ২৫শে এপ্রিল দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছিল। এমন মুনাফা সত্ত্বেও লোকসানের হাত থেকে বিপিসিকে বাঁচাতে ২০২২ সালে রেকর্ড পরিমাণ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করে সরকার। ফলে শেষ অর্থবছরে বিপুল পরিমাণ মুনাফার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ১৫ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা জমা দেয় সংস্থাটি। সবমিলিয়ে গত নয় বছরে মোট এক লাখ ৫৯৭ কোটি টাকা সরকারের নিকট জমা দিয়েছে সংস্থাটি।

বিগত কয়েক মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ওঠা-নামা করছে ৭০ থেকে ৮০ ডলারের মধ্যে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুনাফা নয় বরং সরকারি প্রতিষ্ঠানের উচিত সাশ্রয়ী মূল্যে জনগণের নিকট পণ্য সরবরাহ করা।

সমপ্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মূল্য নির্ধারণ নিয়ে কাজ করছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে ভর্তুকি থেকে বের করে আনাই সরকারের লক্ষ্য। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারের জ্বালানি তেলের দাম সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে সরকার আগামী কয়েক মাসের মধ্যে একটি স্বয়ংক্রিয় জ্বালানি-মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছে। এ পরিকল্পনার আওতায় প্রতি মাসে একবার পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম সমন্বয় করা হবে।

বিপিসি’র বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিপিসি মুনাফা করেছে ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। সরকারকে লভ্যাংশ দিয়েছে ২০০ কোটি টাকা। বিপিসি’র সূত্র বলছে, গত অর্থবছরের মুনাফা থেকে লভ্যাংশ নেয়ার পাশাপাশি উদ্বৃত্ত অর্থ হিসেবে বিপিসি’র কাছ থেকে ৫০০ কোটি টাকা নিয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেও (জুলাই-ডিসেম্বর) ৪০০ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে বিপিসি।

২০২২ সালের মার্চে বিশ্ববাজারে অপরিশোধ জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল (১৫৮ দশমিক ৯৯ লিটার) ১৪০ ডলারে পৌঁছায়। একই সময়ে ডিজেলের দাম ১৭০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর ধাপে ধাপে দাম কমতে থাকে। যদিও বিশ্ববাজারে ডিজেলের গড় দাম ১৩৯ ডলার ধরে দেশে নতুন দাম নির্ধারণ করে সরকার। এর সঙ্গে পরিবহন ভাড়া এবং বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও কর যুক্ত হয় ৩২ শতাংশ। এ ছাড়া ৬ শতাংশ মুনাফা ধরে বিপিসি। আর গ্রাহক পর্যায়ে নির্ধারিত দামের সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবেশকদের কমিশন। এরপর গত বছর জ্বালানি তেলের দাম কমে ৭০ ডলারের নিচে নেমে আসে বিশ্ববাজারে। তবে বর্তমানে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ৮০ ডলার। আর ডিজেলের দাম ৯৮ ডলার।

কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম এ ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, বিপিসি বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলে নীরবতা পালন করে। মুনাফা পকেটে ঢুকায়। জনগণকে সুবিচার থেকে বঞ্চিত করে সরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যহ্রাসের সুফল জনগণ পায় না। এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, ফার্নেস অয়েল প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর মাধ্যম আনার সুযোগ দেয় সরকার। এভাবে লুণ্ঠন করে সভ্য সমাজ চলতে পারে না। তিনি বলেন, জনগণ যাতে জ্বালানির সুবিচার পায় সেই প্রত্যাশাই করবো।

https://mzamin.com/news.php?news=94737