২৫ জানুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৩:০৭

বিএসএফের হাত থেকে রক্ষা পেলেন না বিজিবি সদস্যও

ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর হাতে প্রায়ই বাংলদেশী নাগরকিদের গুলী করে হত্যার ঘটনা ঘটছে। সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারত-বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে প্রতিবছরই। এরপরও সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। নানা অজুহাতে বাংলদেশী নাগরকিদের লক্ষ্য করে গুলী ছোড়ে বিএসএফ। কিন্তু এরমাঝে নতুন আতঙ্ক হয়েছে সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি সদস্যকে গুলী করে হত্যার ঘটনায়। এ ঘটনাটি সচেতন নাগরিকদের কাছে যেমন আঁতকে ওঠার মতো, তেমনি স্পর্শকাতরও।

গত সোমবার ভোর আনুমানিক সাড়ে ৫টার দিকে যশোরের বেনাপোল সীমান্তে বিএসএফের গুলীতে নিহত হন বিজিবি সদস্য সিপাহী মোহাম্মদ রইশুদ্দীন। যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আহমেদ হাসান জামিল সোমবার গভীর রাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে বিজিবি সদস্য নিহতের খবর দেন। বিএসএফের গুলীতে বিজিবি সদস্য নিহতের প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে আগ্রাসন প্রতিরোধ কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন।

এরআগে গত ১৭ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলীতে দুইজন বাংলাদেশী নিহত হন। উপজেলার বাড়াদি সীমান্ত এলাকার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ৮২ নম্বর প্রধান খুঁটির কাছাকাছি ভারতের অভ্যন্তরের বিজয়পুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। প্রাণ হারানো দুইজন হলেন দামুড়হুদা উপজেলার সাজেদুর রহমান ও খাজা মইনুদ্দীন। পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসএএম জাকারিয়া আলম বলেন, রাতে বাড়াদি সীমান্ত দিয়ে ভারতে গরু আনতে যান বেশ কয়েকজন গরু ব্যবসায়ী। ওই সময় ভারতের অভ্যন্তরে বিজয়পুর সীমান্ত এলাকায় প্রবেশ করলে তাদের লক্ষ্য করে গোবিন্দপুর ৩২ নম্বর বিএসএফ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা গুলী করেন।

১৩ বছর আগে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফ সদস্যরা গুলী করে হত্যা করে এক কিশোরীকে। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি সেই ঘটনায় নিহত কিশোরীর নাম ফেলানী। লাল রঙের জামা গায়ে ফেলানীর লাশ কাঁটাতারের বেড়ায় পাখির মতো ঝুলে ছিল প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। ৩০ ঘণ্টা পর বিজিবির কাছে ফেলানীর লাশ হস্তান্তর করেছিল বিএসএফ। সেই ঘটনা আলোড়ন তুলেছিল দেশে-বিদেশে। ফেলানী হত্যার পর এক যুগ কেটে গেলেও থামেনি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত হত্যা। দেশটির সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বিএসএফের গুলীতে প্রতি মাসেই ঘটছে এমন হত্যাকা-। এটা এমনই এক হত্যা, যার দায় নেওয়ার মতো থাকে না কেউ।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গত বছরের (২০২৩ সাল) বছরের জানুয়ারি থেকে নবেম্বর পর্যন্ত শুধু বিএসএফের সরাসরি গুলীতে নিহত হয়েছে ২২ বাংলাদেশী। আহত হয়েছে ২০ জনের বেশি। গুলী ছাড়াও এ সময়ে সীমান্তে ঘটেছে আরও কয়েকটি হত্যাকা-ের ঘটনা। বছর শেষে এই সংখ্যা যে আরও বৃদ্ধি পাবে, এ কথা বলাই বাহুল্য। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সীমান্ত হত্যার ঘটনা নিয়ে সংস্থাটি জানায়, গত বছরের জানুয়ারি মাসে বিএসএফের গুলীতে দুজন নিহত, দুজন গুলীবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত ও একজন নির্যাতনে গুরুতর আহত হন। এ ছাড়াও অপর একজন খাসিয়াদের গুলীতে নিহত হন। ফেব্রুয়ারি মাসে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন দুজন বাংলাদেশি ও আহত হয়েছেন একজন। এ ছাড়াও বিএসএফের ছোড়া সাউন্ড গ্রেনেডেও আহত হয়েছিলেন বাংলাদেশী এক কৃষক। মার্চ মাসে সীমান্তে হতাহতের ঘটনা কমে এলেও ভারতের অভ্যন্তর থেকে এক বাংলাদেশী নাগরিকের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। বিজিবির সঙ্গে পতাকা বৈঠকের পর লাশটি হস্তান্তর করে বিএসএফ। এপ্রিলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলীতে একজন বাংলাদেশী নিহত ও দুজন আহত হয়েছেন। এ ছাড়াও ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে গুলীবিদ্ধ একজনের লাশ ও বাংলাদেশী অন্য এক নাগরিকের লাশ উদ্ধার করা হয়। সীমান্তে স্থলমাইন বিস্ফোরণেও গুরুতর আহত হয়েছেন একজন। এ ছাড়াও বিজিবির গুলীতে একজন নিহত ও একজন আহত হয়েছেন। মে মাসে বিএসএফের গুলীতে নিহত হন দুজন, একজনের গুলীবিদ্ধ লাশ উদ্ধার ও একজন গুলীতে আহত হন। জুন মাসে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন তিনজন, গুলি ও গ্রেনেড বিস্ফোরণে আহত হন ছয়জন। জুলাই মাসে বিএসএফের গুলীতে নিহত হন একজন। এ ছাড়াও সীমান্তে গোলাগুলীর ঘটনায় দুজন গুলীবিদ্ধ হয়ে নিহত ও দুজন গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। আগস্ট মাসে বিএসএফের গুলীতে একজন নিহত, দুজন গুলীতে আহত হন। পাশাপাশি সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে এক ভারতীয় নাগরিকের ও বাংলাদেশী এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে বিএসএফের গুলীতে চারজন নিহত ও ভারতীয় নাগরিকদের গণপিটুনিতে একজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। অক্টোবর মাসে ভারতীয় সীমান্তে বিএসএফের গুলীতে এক কিশোরসহ নিহত হয় চারজন এবং গুলীবিদ্ধ হয় আরেক কিশোর। নবেম্বর মাসে সীমান্তে বিএসএফের গুলীতে দুজন নিহত হয়। গুলীতে আহত হয় একজন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর, দশ মাসে গুলীতে নিহতের সংখ্যা ২০। আহত হয়েছে আরও ২২ জন। সংস্থাটির দেওয়া তথ্যমতে, দেশের খুলনা বিভাগের নিহত হন চারজন, রাজশাহী বিভাগে তিনজন, রংপুর বিভাগে ১০ জন ও সিলেট বিভাগে তিনজন। বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায়ও দেখা যায়, সীমান্তে হত্যা কখনোই থামেনি। বরং কোনো কোনো বছর এই সংখ্যা ছাড়িয়েছিল চল্লিশের ঘর। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০২২ সালে বিএসএফের গুলী, নির্যাতন ও ধাওয়ায় ২৩ বাংলাদেশী নিহত হয়েছে। ২০২১ সালে বিএসএফের হাতে গুলীসহ বিভিন্নভাবে হত্যার শিকার হয়েছিল ২০ জন। ২০২০ সালে গুলী ও নির্যাতনে হত্যার ঘটনা ঘটে ৪৮টি। ২০১৯ সালে বিএসএফের গুলী ও নির্যাতনে ৪৬ জন নিহত হয়। ২০১৮ সালে বিএসএফর গুলীতে নিহত হয় ৮ জন এবং নির্যাতনে নিহতের সংখ্যা ছিল ৬ জন। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৪ জন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে, বিএসএফ আত্মরক্ষার জন্য হত্যা করে। কিন্তু হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ‘ট্রিগার হ্যাপি’ নামে এক প্রতিবেদনে সীমান্তে গুলী থেকে বেঁচে যাওয়া এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ ছিল, বিএসএফ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা না করে বা সতর্ক না করেই নির্বিচারে গুলী চালায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী আত্মরক্ষার প্রয়োজনে প্রথমে সতর্ক করতে ফাঁকা গুলী ছুড়তে হবে। যদি এতে হামলাকারী নিবৃত না হয় এবং জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় সেক্ষেত্রে গুলী ছোড়া যাবে, তবে সেটা হতে হবে অবশ্যই হাঁটুর নিচের অংশে। কিন্তু এসবের কোনো তোয়াক্কাই যেন নেই বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর। ফেলানী হত্যার দৃশ্যই কি মনে করিয়ে দেয় না, বিএসএফ গুলী ছোড়ে স্রেফ হত্যার উদ্দেশ্যেই। বিএসএফ কোনো ক্ষেত্রেই প্রমাণ করতে পারেনি যে, হতাহতের শিকার মানুষগুলোর মাধ্যমে তাদের প্রাণ সংশয় বা গুরুতর আহত হওয়ার ঝুঁকি ছিল।

https://www.dailysangram.info/post/547065