২৪ জানুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ৩:২৯

সরকারের ব্যাংক ঋণের বেশির ভাগই দীর্ঘমেয়াদি

- কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এক দিনে ধার ১৯ হাজার কোটি টাকা

সরকারের ব্যাংক ঋণের বেশির ভাগই দীর্ঘ মেয়াদের জন্য নেয়া হয়েছে। ব্যাংক থেকে নেয়া সরকারের মোট ঋণের ৭৪ শতাংশ বা দুই লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকাই দুই বছর থেকে ২০ বছর মেয়াদি। আর ২৬ শতাংশ বা ৯৫ হাজার কোটি টাকার মেয়াদ হলো দুই বছরের কম মেয়াদি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এ দিকে টাকার সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে কিছু ব্যাংক। তারা প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছে। গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে ধার দিয়েছে ১৯ হাজার ২৬ কোটি টাকা।

জানা গেছে, বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। প্রতি সপ্তাহে ব্যাংকিং খাত থেকে কত কোটি টাকা ঋণ নেয়া হবে বছরের শুরুতেই তার আগাম কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ওই কর্মসূচি অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদি ট্রেজারি বিল ও বন্ডের নিলামের আয়োজন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নিলামে চাহিদা অনুযায়ী সরকারের ঋণের জোগান দিয়ে থাকে ব্যাংকগুলো। তবে প্রচলিত ব্যাংকগুলো ঋণের জোগান না দিলেও বাধ্যতামূলকভাবে সরকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ একশ্রেণীর ব্যাংককে ঋণের জোগান দিতে হয়। আর ওই ব্যাংকগুলোকে পিডি ব্যাংক (প্রাইমারি ডিলার) বলে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত জুন শেষে সরকারের পুঞ্জীভূত ব্যাংক ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৬৬ হাজার ৮২ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল তিন লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। তিন লাখ ৬৬ হাজার ৮২ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণের মধ্যে বেশির ভাগই দীর্ঘ মেয়াদের ঋণ। সাধারণত ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ স্বল্পমেয়াদি হয়। কিন্তু সরকারের বেশির ভাগ ঋণ দেয়া হয় দীর্ঘ মেয়াদে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, সরকার মূলত দু’টি উপকরণের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। একটি ট্রেজারি বিল ও অপরটি ট্রেজারি বন্ড। ট্রেজারি বিলের মেয়াদ হয় সাধারণত এক বছরের কম সময়ের জন্য। আর ট্রেজারি বন্ডের মেয়াদ হয় এক বছরের বেশি সময়ের জন্য। সাধারণত বাজারে পাঁচ ধরনের ট্রেজারি বন্ড রয়েছে। এক বছর মেয়াদি, দুই বছর মেয়াদি, পাঁচ বছর মেয়াদি, ১০, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, সরকার এক বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৪০ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১১ শতাংশ। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩০ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। এক বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার উপরে বেড়েছে ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ঋণ। অপর দিকে দুই বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে সরকারের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৫০১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৫ শতাংশ। যেখানে আগের বছরে ছিল ৩৮ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১২ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে গত জুন শেষে ঋণ নেয়া হয়েছে ৯০ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৫ শতাংশ। অপর দিকে ১০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নেয়া হয়েছে এক লাখ তিন হাজার ৩১২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৮ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে এ ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। ১৫ বছর মেয়াদি সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১২ শতাংশ। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪১ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। আর ২০ বছর মেয়াদি সরকারের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ শতাংশ। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২৬ হাজার ২৮ কোটি টাকা।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, সরকারের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেয়ায় ব্যাংকের অর্থ দীর্ঘ দিনের জন্য আটকে যাচ্ছে। কিন্তু এতে আজকে যে ঋণ নেয়া হচ্ছে ১০, ১৫ বা ২০ বছর মেয়াদি হলে তা পরিশোধ করতে হবে দীর্ঘ দিন পর। এতে চলমান একটি সরকারের যেমন ঋণ পরিশোধের চাপ কম থাকে, তেমনি ব্যাংকের ঋণ দীর্ঘ দিন আটকে থাকায় কাক্সিক্ষত হারে বেসরকারি বিনিয়োগে বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু সরকার দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ নিতে চাইলে পিডি ব্যাংকগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে ঋণের জোগান দিতে হয়। এখানে ব্যাংকেরও করার কিছু থাকে না।

এ দিকে একশ্রেণীর ব্যাংকের টাকার সঙ্কট চরম আকারে চলে গেছে। ইসলামী ব্যাংকগুলো কলমানি মার্কেট থেকে ধার নিতে পারে না। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশেষ উপায়ে ব্যাংকগুলোকে টাকার জোগান দেয়া হচ্ছে। আবার প্রচলিত ব্যাংকগুলো রেপো, বিশেষ রেপো ও বিশেষ তারল্য সহযোগিতার আওতায় ঋণ নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ২২ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলো ঋণ নিয়েছে ১৯ হাজার ২৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কলমানি মার্কেট থেকে কাক্সিক্ষত হারে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। এতে কমে গেছে কলমানি মার্কেট থেকে ধারের পরিমাণ। বিপরীতে ইন্টার ব্যাংক রেপোর মাধ্যমে বেশি হারে ঋণ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে যেখানে কলমানি মার্কেট থেকে ধার নেয়া হয়েছিল ১৬ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকা, সেখানে গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) কলমানি মার্কেট থেকে ধার নেয়া হয়েছে ১৩ লাখ ৯ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। অপর দিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ইন্টার ব্যাংক রেপোর মাধ্যমে ধার নেয়া হয়েছিল ৬৩ হাজার কোটি টাকা। সেখানে গত অর্থবছরে নেয়া হয়েছে প্রায় ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এখানে দেখা যাচ্ছে কলমানি মার্কেট থেকে লেনদেনের হার ২১ শতাংশ কমলেও রেপোর মাধ্যমে বেড়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। এর অন্যতম কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, একশ্রেণীর ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করছেন না। অপর দিকে ব্যবসাবাণিজ্যে মন্দার কারণে সামগ্রিক ঋণ আদায় কমে গেছে। এতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। আর খেলাপি হলে ব্যাংকের আয় থেকে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। অপর দিকে সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার তুলনামূলক বেশি এবং ঝুঁকিমুক্ত ঋণ। এতে ব্যাংকের দিন শেষে শতভাগ মুনাফাসহ আদায় হয়। এ কারণে একধরনের ব্যাংক যাদের কাছে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল রয়েছে তারা স্বল্পমেয়াদি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে। এতে ঝুঁকির পরিমাণ কম হলেও বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/808758