২৩ জানুয়ারি ২০২৪, মঙ্গলবার, ৯:৩০

জলে গেল ১১১ কোটি টাকা

তৈরি করা হয়েছে সেতু। সংযোগ সড়ক নেই। তাই অকেজো পড়ে আছে সেতুটি। কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা নদীতে। ছবি : কালের কণ্ঠ
শতকোটি টাকা খরচ করেও কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা নদীতে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত হয়নি। যতটুকু কাজ হয়েছে, রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় আগের দৈন্য চেহারায় ফিরে গেছে নদীটি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রকল্প পরিকল্পনায় পানিপ্রবাহের বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি, জোর দেওয়া হয় কেবল নদীকেন্দ্রিক অবকাঠামো নির্মাণে। আর মূল সমস্যাটি উপেক্ষার কারণেই প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাস্তবে রূপ নেয়নি।

একটি সম্ভাবনাময় প্রকল্পের মুমূর্ষু অবস্থা দেখে হতাশ এলাকাবাসী। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ‘নরসুন্দা প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে আমরা বহু আন্দোলন, মানববন্ধন করেছি। কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়েছি বহুবার। কিন্তু প্রত্যাশিত মাত্রায় কাজগুলো হয়নি।

আমরা চাই নরসুন্দা উৎসমুখের বাঁধটি খুলে দেওয়া হোক। আবার ভালোভাবে খনন করা হোক নদীটি। নদীর দখল-দূষণ দূর করা হোক।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালে নরসুন্দা নদীকেন্দ্রিক একটি প্রকল্প নেয় সরকার।

প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়, ‘নরসুন্দা নদী পুনর্বাসন ও কিশোরগঞ্জ পৌরসভাসংলগ্ন এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প’। এতে ব্যয় ধরা হয় ১১০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। প্রকল্পের মধ্যে ছিল হোসেনপুর উপজেলা থেকে কিশোরগঞ্জ শহর হয়ে নীলগঞ্জ পর্যন্ত ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৩ কিলোমিটার নদী পুনঃখনন। ২০১৭ সালে কোনো রকমে এর কাজ শেষ করে এলজিইডি।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল নদী খনন করে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে নরসুন্দায় পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করা।
আর ওই চলমান নদী ঘিরে শহর সাজানো। এ জন্য শহরে ছয় কিলোমিটার নদীর পার সিসি ব্লক দিয়ে বাঁধাই করা, ছোট-বড় মিলিয়ে ১১টি দৃষ্টিনন্দন সেতু নির্মাণ, ওয়াকওয়ে, দুটি পার্ক, মুক্তমঞ্চ, নদী পর্যবেক্ষণে সুউচ্চ টাওয়ার নির্মাণসহ আরো কিছু অবকাঠামোগত কাজ করা হয়। তবে যে নদী ঘিরে এত আয়োজন, সেই নদীতে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত হয়নি। অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ১১টি সেতুর মধ্যে চারটির সঙ্গে শহরের রাস্তাগুলোর কোনো সংযোগ স্থাপিত হয়নি। এগুলো পরিণত হয়েছে মাদকসেবীদের আড্ডাখানায়। পুরান থানা এলাকার একটি সেতুর পাইলিং ছাড়া আর কিছু করা হয়নি। ওয়াকওয়ের অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে। শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া পুরো নরসুন্দা নদী ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় হয়ে গেছে। আর নদীতে ঝিরিঝিরে স্রোতে বইছে পচা দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা পানি। নদীতে ভরা কচুরিপানার জঞ্জাল। তদারকি না থাকায় নদীপারের বহু জায়গাজমি বেদখল হয়ে তৈরি হয়েছে নানা ধরনের স্থাপনা।

পুরান থানা এলাকার ব্যবসায়ী মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আগে দরকার নদীর নাব্যতা ফেরানো। পরে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ। কিন্তু এ প্রকল্পে হয়েছে উল্টোটা। অহেতুক দেশের এতগুলো টাকা অপচয় করা হলো।’

কিশোরগঞ্জ এলজিইডির একটি সূত্রে জানা গেছে, পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য হোসেনপুরের জামাইল এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে একটি স্লুইস গেট। কিন্তু স্লুইস গেট থেকে ব্রহ্মপুত্র আরো প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে। এ ছাড়া ব্রহ্মপুত্রের পানির স্তর আরো অনেক নিচে, তাই প্রকল্প শেষ হলেও পানি পাচ্ছে না নরসুন্দা।

এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী আমিরুল ইসলাম প্রকল্প পরিকল্পনায় গলদের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘এসব কাজ মূলত পানি উন্নয়ন বোর্ড করে থাকে। এর পরও কাজটি বাস্তবায়নে এলজিইডিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রকল্পটি আমার সময়ে হলে আমি পানিপ্রবাহের দিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতাম।’

নির্বাহী প্রকৌশলী আরো বলেন, অবকাঠামোগত অনেক কাজই হয়েছে। তবে শহরে এতগুলো সেতু না হলেও চলত। রাস্তা বের না করে সেতু নির্মাণ করা উচিত হয়নি। আর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পৌরসভার, এলজিইডির নয়। বর্তমান অবস্থাকে ভিত্তি ধরে আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হলে পানিপ্রবাহ নিশ্চিতসহ সব সমস্যা দূর হবে বলে তিনি মনে করেন।

কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মাহমুদ পারভেজ বলেন, ‘নরসুন্দা প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। তাই অসম্পূর্ণ কাজটি পৌরসভার পক্ষ থেকে বুঝে নেওয়া হয়নি। প্রকল্পটি ভালোভাবে শেষ করা হলে আমরা এটি গ্রহণ করব এবং রক্ষণাবেক্ষণ করে যাব।’

কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মতিউর রহমান বলেন, ‘শুধু ভরাট নয়, অপরিকল্পিত উন্নয়নও নরসুন্দাকে আজ গতিহীন, নাব্যতাহীন করেছে। আজ পর্যন্ত এ নদী ঘিরে কোনো সমন্বিত ও পরিকল্পিত উন্নয়ন দেখা যায়নি। কিন্তু আশার কথা, পানি উন্নয়ন বোর্ড নরসুন্দাকে ঘিরে একটি বড় প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। এটির অনুমোদন পাওয়া গেলে এবং এর বাস্তবায়ন সম্ভব হলে শুধু নদী নয়, কিশোরগঞ্জবাসীর আর্থ-সামাজিক, কৃষিব্যবস্থা, মত্স্যসম্পদ ও পরিবেশের বৈপ্লবিক পরিবর্তন হবে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2024/01/23/1357123