২৩ জানুয়ারি ২০২৪, মঙ্গলবার, ৯:২৫

গ্যাস সংকট শিল্পাঞ্চলে চাকরি হারানোর আতঙ্ক

 

গ্যাসের তীব্র সংকটে বেকায়দায় পড়েছে দেশের শিল্পাঞ্চল। সরবরাহ কিছুটা উন্নতি হওয়ার দাবি করা হলেও শিল্পকারখানায় চলছে হাহাকার। গ্যাসের অভাবে শিল্পাঞ্চল ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নরসিংদী, আশুলিয়া ও সাভারের কারখানাগুলোতে উৎপাদন বন্ধের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় সময়মতো ক্রেতাকে পণ্য সরবরাহ করা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পোশাক শিল্পের মালিকরা। পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পকারখানায় চাকরি হারানোর আতঙ্কে আছেন শ্রমিকরা। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের অর্থনীতি বর্তমানে নানামুখী চাপের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। ডলারের বাড়তি দাম ও সংকট লেগেই আছে। কড়াকড়ি আরোপের কারণে কমেছে আমদানি। শিল্পের অনেক কাঁচামাল আমদানি না হওয়ায় মূল্যবৃদ্ধি ও সংকট দেখা দিয়েছে। এসবের মধ্যেই দেখা দিয়েছে গ্যাসের সংকট।

কারখানার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলমান গ্যাস সংকটে দেশের ছোট-বড় প্রায় সব শিল্পকারখানাতেই উৎপাদন কমে গেছে। বেড়েছে ব্যয়ও।

ওদিকে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। রপ্তানিমুখী শিল্পে বাতিল হচ্ছে ক্রয়াদেশ। সবমিলিয়ে কলকারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শঙ্কা বাড়ছে। 

উদ্যোক্তারা জানান, আগে দিনের কিছু সময় গ্যাস পাওয়া গেলেও জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে গ্যাস সরবরাহ যেন একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। ক্ষতির মুখে পড়েছে মালিকরা। কারখানা চালু রাখা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। যেকোনো সময় কারখানা বন্ধের ঘোষণা আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন শিল্পকারখানার প্রায় তিন লাখ শ্রমিক চাকরি হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন। লাগাতার গ্যাস সংকটের ফলে কারখানাগুলোতে উৎপাদনের গতি মন্থর হয়ে পড়েছে। চাপ সামাল দিতে না পেরে ছোট ও মাঝারি শিল্পকারখানার অনেক উদ্যোক্তা তাদের কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে কারখানাগুলোতে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে বেশি দামে হলেও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ চান শিল্পোদ্যোক্তারা।

জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জে গ্যাসনির্ভর ছয় শতাধিক শিল্পকারখানা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অনেক কারখানা নির্বাচনের কারণে পণ্য রপ্তানি করতে পারেনি। ওদিকে জানুয়ারি মাসের বেতন দেয়ার সময় চলে আসছে। একইসঙ্গে বেতন বাড়ানোর চাপও রয়েছে। এ অবস্থায় কারখানা বন্ধ করে দিতে পারেন মালিকরা।

শিল্প এলাকা নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ওয়াপদারপুল এলাকায় আমজাদ ডায়িং লিমিটেডে গত তিন মাসে সংকট প্রকট হয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে গ্যাস একেবারেই নেই। ফলে কারখানার কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা বললেন এর কর্ণধার আমজাদ হোসেন। এক বছর ধরে গ্যাস সংকট নিয়ে ভুগছেন জানিয়ে তিনি বলেন, অথচ গ্যাসের মূল্য সাড়ে ১১ টাকা থেকে এক বছর আগে বাড়িয়ে সাড়ে ৩৪ টাকা করা হয়েছে।

অন্যদিকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘিরে সম্প্রসারিত হচ্ছে চট্টগ্রাম। গড়ে উঠছে একাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চলও। তবে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় শিল্পকারখানার ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে উৎকণ্ঠা। চট্টগ্রামে আগে গ্যাস সংকট হলে সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলের গ্যাস আনা হতো আশুগঞ্জ-বাখরাবাদ পাইপলাইন দিয়ে। কিন্তু এলএনজি আমদানি শুরু করার পর ওই পাইপলাইনে ভাল্ব লাগিয়ে ওয়ানওয়ে করে ফেলা হয়। এ কারণে চট্টগ্রাম থেকে গ্যাস শুধু নেয়া যায়; আনা যায় না। মহেশখালীর এলএনজি টার্মিনালে সমস্যা হলে তাই চট্টগ্রামে বিপর্যয় নেমে আসে। চট্টগ্রামে ভারী শিল্পকারখানা রয়েছে ১ হাজার ২০০টি। 

উদ্যোক্তা ও কারখানার কর্মকর্তারা বলছেন, শ্রমিকরা কারখানায় আসছেন ঠিকই কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে কাজ ছাড়া প্রায় অলসই বসে থাকেন। ৮ ঘণ্টার কাজ ১৬ ঘণ্টাতেও শেষ হচ্ছে না। প্রতিদিন গুনতে হচ্ছে লাখ লাখ টাকার লোকসান। এ পরিস্থিতিতে রপ্তানি ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি কর্মবিহীন শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার শঙ্কার কথা বলছেন তারা। 

জানা গেছে, এবারের গ্যাস সংকটের কারণ মূলত সাগরে ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের রক্ষণাবেক্ষণ ও দেশি কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন কমে যাওয়া। গত দুই মাস ধরে জাতীয় সঞ্চালন লাইনে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট বা প্রায় ২০ শতাংশ কমে গেছে। একটি এলএনজি টার্মিনাল রক্ষণাবেক্ষণ শেষে ফেরত আসলেও আরেকটি টার্মিনাল ৪৫ দিনের জন্য রক্ষণাবেক্ষণে পাঠানো হচ্ছে। ফলে গ্যাস স্বল্পতার এ পরিস্থিতি দ্রুত সমাধান না হওয়ার কথাই বলছেন কর্মকর্তারা। 

গত রোববার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, রক্ষণাবেক্ষণ শেষে একটি এফএসআরইউ বা ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল পুনঃসংযোগ দিতে গিয়ে কিছুটা বিপত্তি ঘটেছিল। সম্প্রতি ব্যাপক গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের এটাই বড় কারণ। তবে সেই সমস্যা কেটে যাওয়ায় আগামী দুই/একদিনের মধ্যে সংকট কিছুটা স্বাভাবিক হবে। 

এদিকে চলমান এমন সংকটের মধ্যে নারায়ণগঞ্জে বিকেএমইএ’র প্রধান কার্যালয়ে জরুরি সভা করেন পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ। এতে সংগঠনের সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান গ্যাস না পেলে কারখানা বন্ধ করে দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না বলে সতর্ক করে দেন। তিনি বলেন, তিন লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান যে বন্ধ হবে সেজন্য আমাদের দায়ী করা চলবে না। দাম দিয়েও যদি গ্যাস না পাই তাহলে কী করে ব্যয়ভার বহন করবো। 

বর্তমান গ্যাস সংকটের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে ১০/১২ দিন গ্যাসটা থাকলো। নির্বাচনের সাতদিন পর থেকে গ্যাসটা আবার কমে গেল। সংকটই যদি থাকে নির্বাচনের আগে আমরা গ্যাসটা কী করে পেলাম। এখন আবার গ্যাসটা বন্ধ হয়ে যায় কী করে। শীত তো এবার প্রথম আসে নাই। 

মোট রপ্তানির ৫২ শতাংশ বা মাসে আড়াই হাজার কোটি টাকার পণ্য নিটওয়্যার খাত থেকে রপ্তানি হয় জানিয়ে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আয় করে নিটওয়্যার। পরোক্ষভাবে ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান আছে এখানে। কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে এই খাত এখন বন্ধ হওয়ার পথে। 
পোশাক রপ্তানিকারকদের আরেক সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, সঠিকভাবে জ্বালানি না পাওয়া গেলে কারখানা চলবে না, মেশিনগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। এভাবে জ্বালানির কারণে উৎপাদন কমতে থাকলে শিল্প টিকে থাকতে পারবে না। 

পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্ট আরেকটি খাত হচ্ছে টেক্সটাইল বা বস্ত্রকল। এ খাতের শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশন (বিটিএমএ)-এর অতিরিক্ত মহাসচিব মনসুর আহমেদ বলেন, গত এক মাস ধরে গ্যাসের সংকটটা মারাত্মক পর্যায়ে। উৎপাদন প্রক্রিয়া প্রায় বন্ধ। সক্ষমতার ৩০ শতাংশও উৎপাদন করা যাচ্ছে না। শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে। 
গ্যাসের কারণে সংকটে পড়ার কথা জানালেন বাংলাদেশ রি-রোলিং মিল এসোসিয়েশনের মহাসচিব মাহবুবুর রশীদ জুয়েল। লাইনে গ্যাস না থাকায় গত ছয় দিন ধরে সদর উপজেলার গোদনাইল এলাকায় তার মালিকানাধীন জুলফিকার স্টিল রি-রোলিং মিল লিমিটেড কারখানাটির উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ থাকার কথা জানালেন তিনি। 

শ্রমিক নেতা সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, শিল্পকারখানাগুলোতে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান নির্ভর করে। সুতরাং শিল্প কারখানাগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। শিল্প মালিকদের এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে, এমন সময়ে শ্রমিকরা যাতে কর্মচ্যুত না হন। 

সাভারের স্টাফ রিপোর্টার জানান, শিল্পাঞ্চল সাভার-আশুলিয়ায় তীব্র গ্যাস সংকটে ভোগান্তিতে রয়েছেন আবাসিক গ্রাহকেরা। ফলে তাদের রান্নার জন্য খুঁজতে হচ্ছে ভিন্ন পন্থা তেমনি চড়া দামে বিকল্প জ্বালানি কিনে উৎপাদন ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানার মালিকেরা। সাভার পৌর এলাকাসহ উপজেলার বিভিন্ন বাসা বাড়িতে তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। আর এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে এলাকাবাসী। এই শিল্পাঞ্চলে প্রায় দেড় হাজারের মতো ছোট-বড় শিল্পকারখানা রয়েছে। এসব কারখানার জেনারেটর বা বয়লার চালানোর জন্য ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চিতে গ্যাসের চাপের ইউনিট) চাপের গ্যাস প্রয়োজন কিন্তু বর্তমানে তা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। কারখানা মালিকরা বলছেন, তাদের পণ্য উৎপাদন খরচ বেড়েছে। সাভারের আল মুসলিম গ্রুপের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মো. আবু রায়হান বলেন, প্রায় মাসখানেক ধরে আমাদের এই গ্যাস সংকট পোহাতে হচ্ছে। কারখানা চালাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। সাভার তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আবু সালেহ মো. খাদেম উদ্দিন বলেন, চাহিদা অনুপাতে জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় এই সংকট দেখা দিয়েছে। তবে দ্রুতই এ সংকট নিরসনে আমরা কাজ করছি।

গাজীপুরের স্টাফ রিপোর্টার জানান, রাজধানীর পার্শ্ববর্তী গাজীপুর জেলায় হাজারের বেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান। গ্যাস সংকটে শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সময়মতো রপ্তানি অসম্ভব হয়ে পড়ছে বলে জানান শিল্প মালিকরা। সিএনজি স্টেশনগুলোতে লেগে আছে দীর্ঘ লাইন। বাসা বাড়িতে রান্না-বান্নায় ভোগান্তি বেড়েছে। গ্যাসের এমন সংকটে গত কয়েক দিন ধরে গাজীপুরের কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, বাসন ও টঙ্গীসহ বিভিন্ন এলাকায় বেশির ভাগ কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে বলে সেখানকার মালিক-কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। এভাবে চলতে থাকলে কারখানার কার্যক্রমে ধস নামবে বলে আশঙ্কা করছেন শিল্পকারখানার মালিকরা। গাজীপুরে প্রতিদিন ৬শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। অথচ গত কয়েকদিন ২৪ ঘণ্টায় সরবরাহ হয়েছে ৪শ’ মিলিয়ন ঘনফুটেরও কম।

এদিকে জেলা শহরের গাজীপুর মেট্রো সদর, বাসন, গাছা, টঙ্গীসহ বিভিন্ন এলাকায় বাসা বাড়িতে সকালে রান্নার চুলায় গ্যাসের চাপ খুবই কমে যাচ্ছে। কখনো কখনো একেবারে শূন্যে নেমে যাচ্ছে। এতে করে রান্না-বান্না করতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন লোকজন। 
গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ও ট্রান্সমিশনের গাজীপুর শাখার উপ-মহাব্যবস্থাপক শাহজাদা ফরাজী জানান, গাজীপুরে বর্তমানে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম রয়েছে। গ্যাসের চাহিদা ছিল ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট তার বিপরীতে পাওয়া গেছে ৩৭০ মিলিয়ন ঘনফুট।

https://mzamin.com/news.php?news=94427