২২ জানুয়ারি ২০২৪, সোমবার, ১২:৫১

গ্যাসসঙ্কটের প্রভাব পড়ছে বিদ্যুতেও গরমে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে

 

বাংলাদেশের চলমান গ্যাসসঙ্কটের প্রভাব এবার বিদ্যুৎ খাতেও পড়তে শুরু করেছে। আগামী গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা যখন বাড়বে তখন এই সঙ্কট আরো ব্যাপক আকার নিতে পারে বলেও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ায় কিছু এলাকায় বিদ্যুৎবিভ্রাট দেখা দিতে পারে বলে শনিবার এক ফেসবুকে পোস্টে সতর্ক করে দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকার পরও যেখানে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে আসছে গরমে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে, সেটা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরাও আশঙ্কা করছেন, গরমকাল শুরু হওয়ার আগেই বর্তমান গ্যাসসঙ্কটের সমাধান করতে না পারলে বিদ্যুতের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। এর ফলে সৃষ্ট বিদ্যুৎবিভ্রাটে বাসা-বাড়ির ভোগান্তি ছাড়াও শিল্পকারখানার উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তারা। সরকারও বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছে। কাজেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে একাধিক ‘বিকল্প উপায় ভাবা হচ্ছে’ বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
হঠাৎ বিদ্যুৎবিভ্রাট কেন?

বাসা-বাড়ি, কলকারখানার পর গ্যাসসঙ্কটে এবার বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। শনিবার এক ফেসবুক পোস্টে তারা বলেছে যে, কারিগরি ত্রুটির কারণে কক্সবাজারের মহেশখালীতে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে সরবরাহে বিঘœ ঘটছে। ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কিছুটা কমেছে।

‘এই পরিস্থিতিতে দেশের কিছু কিছু এলাকাতে খুবই স্বল্প সময়ের জন্য বিদ্যুৎবিভ্রাট হতে পারে। সম্মানিত গ্রাহকদের অনাকাক্সিক্ষত অসুবিধার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত বাংলাদেশে পরিচালিত গ্যাসবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রায় ২০ শতাংশ জ্বালানিই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়।

আমদানিকৃত এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশনের পর পাইপলাইনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। এই লক্ষ্যে কক্সবাজারের মহেশখালীতে দু’টি ভাসমান টার্মিনাল রাখা হয়েছে, যেগুলো ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট বা এফএসআরইউ নামেই বেশি পরিচিত।

সংস্কারজনিত কারণে জাহাজ দু’টির একটি গত নভেম্বর থেকে সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। আর কারিগরি ত্রুটির কারণে গত শুক্রবার অন্যটি থেকেও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এতে আকস্মিকভাবেই জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ কমে যায়। বিশেষ করে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে গ্যাসের সরবরাহ প্রায় পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি ওই এলাকার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতেও এর প্রভাব পড়ে।

এ অবস্থায় গ্রাহকদেরকে বিদ্যুৎবিভ্রাটের আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছিল বলে জানিয়েছেন পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন। তবে শনিবার রাতেই কারিগরি ত্রুটির সমাধান করা হয়েছে। ফলে আপাতত বিদ্যুৎবিভ্রাটের আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন। যদিও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের তথ্যে দেখা যাচ্ছে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশে প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। পেট্রোবাংলাও নিশ্চিত করেছে যে, ফ্লোটিং স্টোরেজ ও রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট থেকে আবার জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে। তবে পূর্ণ মাত্রায় গ্যাস সরবরাহ করতে আরও একটু সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইন্স) কামরুজ্জামান খান।

গরমকাল নিয়ে উদ্বেগ : শীতকালে বাংলাদেশে এমনিতেই বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে দৈনিক গড়ে দশ হাজার মেগাওয়াট বিদু্যুতের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন করা হচ্ছে প্রায় এগারো হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু গরমকালে এই চাহিদা ব্যাপক পরিমাণে বেড়ে যাবে।

এর আগে গরমকালে সাধারণত ১৬ থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুতের চাহিদা দেখা গেলেও এবার সেটি সাড়ে ১৭ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে চলে যেতে পারে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
বিপুল পরিমাণ এই বিদ্যুতের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি আসে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো থেকে। পেট্রোবাংলার হিসেবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের চাহিদাই হবে এবার দেড় হাজার মিলিয়ন ঘটফুটের মতো। তবে উৎপাদন সক্ষমতা অনুযায়ী গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সার্বিক চাহিদা হলো ২২৪০ এমএমসিএফডি।

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা হচ্ছে সাড়ে ৭০০-৮০০ এমএমসিএফডি গ্যাস। অর্থাৎ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের যে চাহিদা রয়েছে সেটির বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে ৪০ শতাংশের মতো। কাজেই গ্যাসের বর্তমান সঙ্কট চলমান থাকলে আসছে গ্রীষ্মকালে বিদ্যুৎবিভ্রাট প্রকট আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

‘গরমকালে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপক বেড়ে যাবে। তখন যদি এই গ্যাসের সমস্যা থাকে, তাহলে গরমকালে বিদ্যুৎবিভ্রাট প্রকট হবে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডেফিনেটলি সেটার একটা নেতিবাচক ইফেক্ট পড়বে, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম।

এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার জন্য সরকারের নীতিকেই দায়ী করছেন আরেক জ্বালানি বিেেশষজ্ঞ শামসুল আলম।
‘আমদানি করব বলে আমরা নিজেদের গ্যাসক্ষেত্রগুলো অবহেলা করলাম। এখন শীতকালে চাহিদা কম থাকার পরও আমরা গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছি না’, বিবিসি বাংলাকে বলেন আলম।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভুল নীতির কারণে একদিকে যেমন গ্যাসের নিজস্ব (দেশের ভেতরে) উৎপাদন কমেছে, তেমনি অন্য দিকে আমদানি নির্ভরতা বেড়েছে। এখন ডলার সঙ্কটের কারণে অতিরিক্ত আমদানি করাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আগামীতে জ্বালানি সঙ্কট মোকাবেলা এবং আমদানি করে চাহিদা পূরণ করাই হবে দেশের বড় চ্যালেঞ্জ।

‘আমদানির ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাচ্ছি একটা স্থবিরতা আছে। ফলে এই মুহূর্তে কোনো স্বল্পকালীন সমাধান নাই।’ ‘এই জ্বালানিসঙ্কট যেটা, সেটা ডলারের সঙ্কট না কাটলে স্বল্পকালীন কোনো সমাধান নাই,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন অধ্যাপক তামিম।
এ অবস্থায় সরকারকে আগেভাগেই আসন্ন সঙ্কট মোকাবেলার প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারের পরিকল্পনা কী?

বাংলাদেশে সাধারণত গরমকালে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুতের চাহিদা থাকে। এরই মধ্যে আবহাওয়াবিদরা পূর্বাভাস করেছেন যে, চলতি বছর গরমের মাত্রা আরো বাড়তে পারে। তাদের এই বক্তব্য সত্যি হলে গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা এবারে আরো বাড়বে। কিন্তু বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া দৈনিক উৎপাদন প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, গ্যাসসঙ্কটের কারণে এখনই ডজনখানেক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন কম হচ্ছে, বেশ কয়েকটি বন্ধও রাখা হয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আসছে গরমকালে সরকার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করবে কিভাবে? “বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে এবং আমরা সে অনুযায়ী পরিকল্পনাও করে রেখেছি”, বিবিসি বাংলাকে বলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম হওয়ায় এবার কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রতিই সরকার বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন হামিদ।
“আমাদের বেজলোড কোল পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো চলে আসছে। আমরা নিজেরা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি, পাশাপাশি ভারত থেকেও বিদ্যুৎ নিচ্ছি। কাজেই সমস্যা হবে না” বিবিসি বাংলাকে বলেন হামিদ। বাংলাদেশে বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহার করা হয়, যার একটি বড় অংশই আসে বিদেশ থেকে। ডলার সঙ্কটের কারণে কয়লা আমদানি করতে না পারায় গত বছর রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশ কিছুদিনের জন্য বন্ধও করে দেয়া হয়েছিল। তবে চলতি বছর এখনো পর্যন্ত কয়লার সরবরাহ ঠিকই আছে বলে জানিয়েছে সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ। কিন্তু ডলার সঙ্কট বা অন্য কোনো কারণে সামনে যদি সরবরাহ ঠিক না থাকে, তখন কী হবে?

“এক্ষেত্রে আমাদের বিকল্প ভরসা হচ্ছে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো” বলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি আরো জানাচ্ছেন, “আমাদের নিজস্ব যে গ্যাস আছে, সেখানে হয়তো কিছু রেশনিং করতে হবে।” কিন্তু দেশে ইতোমধ্যেই যেখানে বাসা-বাড়ি ও শিল্প কারখানায় চরম গ্যাসসঙ্কট চলছে, সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অতিরিক্ত গ্যাসের ব্যবহার কি সঙ্কটকে আরো তীব্রতর করবে না? “তখন আমাদের অন্য যে সোর্সগুলো আছে, যেমন সিএনজি পাম্প এবং শিল্প কারখানা সেখানে হয়তো রেশনিং করব। জোন ভাগ করে সে অনুযায়ী আমরা দিবো, যদি পরিস্থিতি তেমন খারাপ হয়”, বিবিসি বাংলাকে বলেন নসরুল হামিদ।

এ ছাড়া জ্বালানি সঙ্কট সমাধানের জন্য সরকার বহুমুখী জ্বালানি ব্যবহার করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এরই অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সৌর ও বায়ু বিদ্যুতের মতো বিকল্প উৎস থেকে উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে জোর তৎপরতা চালানো হচ্ছে বলে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন বলেন প্রতিমন্ত্রী।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/808229