২১ জানুয়ারি ২০২৪, রবিবার, ৪:১৬

মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে আঞ্চলিক মহাসড়কে

 

বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে দুমড়েমুচড়ে গেছে মাইক্রোবাস। গতকাল সকালে পাবনার ঈশ্বরদীর মিরকামারী পূর্বপাড়ায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। ছবি : কালের কণ্ঠ

ঘটনাস্থল সিলেট-জাফলং মহাসড়ক। গত শুক্রবার রাত ১টার দিকে যাত্রীবাহী একটি গাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয় পণ্যবাহী ট্রাক। এতে চারজনের মৃত্যু ঘটে। গতকাল শনিবার দুপুর ১২টার দিকে রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের সইপাড়া এলাকায়ও একই ধরনের দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় দুজনের।

একই দিন সকাল ৮টায় দাশুড়িয়া-কুষ্টিয়া মহাসড়কে বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে মারা যায় দুজন।

দেশের আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোতে প্রায়ই ঘটছে এমন দুর্ঘটনা। ঝরছে অনেক যাত্রীর প্রাণ। পঙ্গু হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে অনেকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় মহাসড়কের তুলনায় আঞ্চলিক মহাসড়কের দুই পাশে নানা কারণে রাস্তা দখল হয়ে থাকে। যান চলাচলের বিষয়টি পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় দিন দিন আঞ্চলিক মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে।

দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আনফিট যানবাহন চলাচলের আধিক্য, ছোট ও মাঝারি যান চলাচল বেশি থাকা, অনুমোদনহীন তিন চাকার যান চলা, সড়কে পরিবহন ও ব্যবস্থাপনার শৃঙ্খলার অভাব, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নজরদারি কম থাকা, রাস্তার পাশে ঘন ঘন বাজার বসা—এসব আঞ্চলিক মহাসড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করেছে। ক্রমে তা বাড়ছে।

একই সঙ্গে শীতকালে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হলো ঘন কুয়াশায় চালকের কিছু স্পষ্ট দেখতে না পাওয়া।

সড়ক দুর্ঘটনার প্রাণহানির অন্যতম প্রধান কারণ সঠিক গতিতে যান চলাচল না করা। যান চলাচলে অতিরিক্ত গতি কিংবা কম গতি দুটিই ক্ষতিকর। দুটিই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির জন্য দায়ী। নগর, আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়কে যান চলাচলে নির্দিষ্ট গতি নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও তা মানা হচ্ছে না বা মানা যাচ্ছে না।

আঞ্চলিক মহাসড়কে গতির ধারাবাহিকতা ঠিক রাখা সবচেয়ে কঠিন।

এক প্রশ্নের জবাবে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমীন উল্লাহ নুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, দুর্ঘটনা কমাতে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। সরকারি নানা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও কাজ করছে। তবু সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, একটা দুর্ঘটনার সঙ্গে পরিবহন চালক, মালিক, যাত্রী, পথচারী, অন্য গাড়ি—সব কিছুই জড়িত। পুলিশ না থাকলেই আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোতে তিন চাকার ছোট গাড়ি উঠে যাচ্ছে। পুলিশ কতক্ষণ পাহারা দিয়ে রাখবে। সবার সম্মিলিত সচেতনতা না থাকলে দুর্ঘটনা কিভাবে কমবে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, জাতীয় মহাসড়ক যতটা নজরদারির মধ্যে থাকে, আঞ্চলিক মহাসড়ক ততটা থাকে না। আবার আঞ্চলিক মহাসড়ক স্থানীয়দের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। গ্রামীণ সড়ক থেকে আঞ্চলিক সড়কে যানবাহন চলে আসে। এতে ঝুঁকি বাড়ে। গতির ভারসাম্য রাখা যায় না।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে তিন চাকা ও ছোট যানবাহনের কারণে ১১.২২ শতাংশ দুর্ঘটনা বেড়েছে। ২০২৩ সালে মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩৪.৮৬ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে এবং ২৮.৪১ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে সংঘটিত হয়েছে। যদিও আগের বছরের তুলনায় গত বছর আঞ্চলিক মহাসড়কে দুর্ঘটনা কম হয়েছে।

আঞ্চলিক মহাসড়কে দুর্ঘটনার প্রসঙ্গে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, যত আনফিট গাড়ি আছে, সব আঞ্চলিক মহাসড়কে চালানো হয়। সেখানে নজরদারি খুব কম। তাই দুর্ঘটনা কমানো যাচ্ছে না। পরিবহন ও সঠিক সড়ক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বিকল্প নেই।

সাইদুর রহমান বলেন, ‘গতির ভারসাম্যহীনতা দুর্ঘটনার পেছনে বড় কারণ। আঞ্চলিক মহাসড়কে ছোট গাড়ির কারণে বড় গাড়ি চলাচলে বাধা পায়। আবার অতিরিক্ত গতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। আমরা প্রশিক্ষিত চালক তৈরি করতে পারছি না। সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ হচ্ছে না। ফলে সড়কে পরিবহনের শৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, চলতি বছরের গত ৮ জানুয়ারি থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ১০ দিনে সারা দেশে ১০৭টি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় ৯৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত আরো ১৫২ জন।

জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, আঞ্চলিক মহাসড়কে সব ধরনের গাড়ি চলে। এটা গ্রামীণ সড়কের পাশে হওয়ায় ছোট গাড়ির চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আবার জাতীয় সহাসড়কের তুলনায় আঞ্চলিক মহাসড়কের দুই পাশে নানা কারণে রাস্তা দখল হয়ে থাকে। এতেও মূল সড়ক ছোট হয়ে আসে। যান চলাচলের বিষয়টি পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় দিন দিন আঞ্চলিক মহাসড়কে ঝুঁকি বাড়ছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2024/01/21/1356560