২১ জানুয়ারি ২০২৪, রবিবার, ৪:১৪

শিল্পোৎপাদনে ধস

 

সারাদেশে চলছে তীব্র গ্যাস সংকট। এতে অনেক শিল্পকারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার, ইস্পাত, নিটওয়্যারসহ গ্যাসনির্ভর শিল্প কারখানা। ক্রমবর্ধমান জ¦ালানি সংকটে দেশে শিল্প কারখানায় উৎপাদনে রীতিমতো ধস নেমেছে। পুরোপুরি গ্যাসনির্ভর অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনছেন শিল্প কারখানার মালিকেরা। রফতানিমুখী শিল্প কারখানার উৎপাদনের চাকা স্থবির হয়ে পড়েছে। তাতে রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দেশে অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও শিল্প কারখানার মূল চালিকাশক্তি জ্বালানির অভাবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে। তাতে নতুন কর্মসংস্থানের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে।

দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন খ্যাত বন্দর নগরী চট্টগ্রামে গত ১৯ জানুয়ারি গ্যাস সরবরাহ ছিল বন্ধ। গত ২ দিনেও চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। এদিকে গ্যাস সংকটের কারণে শিল্প ও বন্দর নগরী নারায়ণগঞ্জেও অনেক কলকারখানা বন্ধ রয়েছে। গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী এসব এলাকার শিল্প কারখানাতেও গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পর্যাপ্ত গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী এলাকার অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ করে নিটওয়্যার গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা চরম বিপাকে পড়েছেন। প্রতিদিন তাদের লাখ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। শিল্প কারখানার পাশাপাশি বাসাবাড়িতেও মিলছে না গ্যাস। ঢাকার সব এলাকার বাসিন্দাদের পাইপলাইনে গ্যাস মিলছে না। রাজধানীজুড়ে বাসাবাড়িতে জ্বলছে না চুলা। অফিসগামী, স্কুল-কলেজগামীরা পড়ছেন চরম বিপাকে। দিনের বেলায় চুলা না জ্বলায় বাসায় রান্না হচ্ছে না। এতে না খেয়েই অফিসে অথবা স্কুল-কলেজে যেতে হচ্ছে। গ্যাস সংকটের ফলে নগরবাসীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। অনেকে এখন সিলিন্ডার গ্যাসের ওপর নির্ভর করছেন। এতে তাদের ব্যয়ও অনেক বেড়েছে।

দেশ থেকে অবাধে পুঁজিপাচার ও বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় রিজার্ভ নিম্নমুখী। দেশে চলমান ডলার সংকটের মধ্যে রিজার্ভের পতন ঠেকাতে এলএনজিসহ জ্বালানি আমদানি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে দেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলনও কমে গেছে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র থেকেও শুরু হয়নি উত্তোলন। তাতে জ্বালানি সংকট চরমে উঠেছে। দেশের মোট চাহিদার অর্ধেক গ্যাসও পাওয়া যাচ্ছে না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের সার্বিক উৎপাদনশীলতায়।

পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে উল্লেখ করে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম জ্বালানি সংকট নিরসনে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, গ্যাসসহ জ্বালানির অভাবে দেশে শিল্প কারখানায় উৎপাদন বন্ধের উপক্রম হয়েছে। বিকল্প উপায়ে উৎপাদনের চাকা সচল রাখতে গিয়ে শিল্প মালিকেরা লোকসানের মুখে পড়েছেন। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দাম বাড়ছে। তাতে ভোক্তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। রফতানিমুখী শিল্প কঠিন সংকটে পড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং উন্নয়ন-বিনিয়োগের স্বার্থে এলএনজিসহ জ্বালানি আমদানি বাড়ানোসহ দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি এ বিষয়ে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী দেশে দৈনিক প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস গত কয়েক মাস ধরে সরবরাহ করা হচ্ছিল। তবে চলতি জানুয়ারিতে এ সরবরাহ কমে ২৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমেছে। এতে দেশে গ্যাস সংকট বেড়েছে। মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গভীর সমুদ্রে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল দুটিতে সংস্কার চলছে। এ জন্য এখন গ্যাসের সরবরাহ কিছুটা কম। এ জন্য গ্যাসের সঙ্কট দেখা দিয়েছে।

তবে তিতাসের তথ্য কিছু ভিন্ন। তিতাস বলছে, এখন ৩৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। গত বছরের শেষ দিকে পাওয়া যেত ২৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। কিন্তু এতেও প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হয়নি। এখন সরবরাহ আবারো ২০০ কোটি ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে। সরবরাহ কম থাকায় গ্রাহকদেরও নিরবচ্ছিন্নভাবে সব জায়গায় গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ চলমান এই সংকট নিয়ে বলেন, আমরা চাই আগামী মার্চে রোজা শুরুর সময়ে গ্যাস সরবরাহ যেন স্বাভাবিক রাখা যায়। মার্চের আগেই এলএনজি টার্মিনাল দু’টি পুরোপুরি সচল হয়ে যাবে। তখন গ্যাস সংকট কেটে যাবে বলে আশা করি।

অন্যদিকে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, এই গ্যাস সংকটের পেছনে দেশীয় উৎপাদন কমে যাওয়া একটা কারণ। পাশাপাশি এলএনজি আমদানির পরিমাণও কমেছে। বর্তমানে রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং ডলার সংকটের কারণে দ্রুত আমদানিও সম্ভব হবে না। তাই খুব নিকট ভবিষ্যতে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথও দেখতে পাচ্ছেন না তারা। তারা বলছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে গ্যাস সরবরাহের উন্নতি হবে। তবে তখন গ্যাসের চাহিদা আরও বাড়বে। ফলে ধৈর্য ধরা ছাড়া কোনো সমাধান দেখাতে পারছেন না তারা।

বর্তমানে ডলার মজুতের যে অবস্থা, এমন পরিস্থিতিতে সরকারের আমদানি বাড়ানোর সম্ভাবনাও কম। গত ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, তিন মাসের বেশি আমদানি বিল মেটানোর জন্য এই রিজার্ভ যথেষ্ট। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্ট ২০২৪-এ গবেষণায় অংশ নেওয়া ৭০টি বাংলাদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জ্বালানি সরবরাহের ঘাটতিকে অর্থনীতি ও তাদের ব্যবসার জন্য এক নম্বর হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছে।

বিজিএমইএর ভাইস প্রেসিডেন্ট শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে শিল্প উৎপাদন বিশেষ করে তৈরী পোশাক শিল্প সংকটের মুখে আছে। কোনো কোনো কারখানার উৎপাদন ৩০ ভাগে নেমে এসেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ সবখানেই গ্যাস সংকট। আমরা এটা নিয়ে মন্ত্রণালয়ে বার বার কথা বলেছি। কিন্তু মার্চের আগে এই সমস্যার সমাধান হবে না বলে জানানো হয়েছে। তারপরও আমরা তরল গ্যাস কিনে উৎপাদন ও সরবরাহ ঠিক রাখার চেষ্টা করছি। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় শিপমেন্ট শিডিউল বিপর্যয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে গ্যাস সংকট চরমে উঠেছে। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও সাভার এলাকায় সংকট বেশি; যে কারণে এসব এলাকার ডাইং কারখানাগুলো অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

সারাদেশে গ্যাস সংকটের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো প্রতিবেদন নিচে তুলে ধরা হলো।

চট্টগ্রাম থেকে রফিকুল ইসলাম সেলিম জানান, গ্যাস সংকট অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে। কক্সবাজারের মহেশখালীতে বঙ্গোপসাগরে ভাসমান এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) টার্মিনালে বিগড়ে যাওয়ায় গ্যাস সরবরাহে বিপর্যয় নেমে আসে। গতকাল শনিবার টানা দ্বিতীয় দিনের মতো প্রায় গ্যাসশূন্য ছিল চট্টগ্রাম অঞ্চল।

চিটাগাং চেম্বার সভাপতি ওমর হাজ্জাজ বলেন, জ্বালানির অভাবে চট্টগ্রামের শিল্প কারখানা অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। চট্টগ্রামে গ্যাসের মোট চাহিদা ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি হলেও সরবরাহ মিলছে মাত্র ২৫০ থেকে ২৭০ মিলিয়ন ঘনফুট। আবার চট্টগ্রাম থেকে ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট মেঘনাঘাটে সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে চট্টগ্রাম দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশি^ক কারণে জ্বালানির দাম বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরপরও দেশের স্বার্থে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বিনিয়োগ আকর্ষণে চট্টগ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু জ্বালানি সংকটের কারণে নতুন নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হলে এসব উন্নয়নের প্রকৃত সুফল মিলবে না। ডলার সংকটের কারণে সরকার দেশি বিনিয়োগ আপাতত নিরুৎসাহিত করছে, তবে এই সময়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ জরুরি। কিন্তু জ্বালানি সংকটে সেই সম্ভাবনাও কাজে লাগছে না।

গ্যাসের অভাবে ১৮ জানুয়ারি রাত থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে লোহা উৎপাদনকারী সব রি-রোলিং মিল বন্ধ রয়েছে জানিয়ে মোস্তাফা হাকিম গ্রুপের অন্যতম পরিচালক মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, গ্যাস সরবরাহ বন্ধের সাথে সাথে সব রি-রোলিং মিল বন্ধ করে দিতে হয়েছে। অব্যাহত গ্যাস জ্বালানি সংকটে এসব কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত গ্যাস না পাওয়ায় উৎপাদনের চাকা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। বসিয়ে বসিয়ে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে। আবার বিকল্প জ্বালানিতে উৎপাদন সচল রাখতে গিয়ে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। তাতে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম বাড়ছে। শিপ ব্রেকিং শিল্পকে ঘিরে চট্টগ্রামে গড়ে ওঠা বিকাশমান ইস্পাত শিল্প দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। অথচ জ্বালানির অভাবে সম্ভাবনাময় এই খাতটি এখন হুমকির মুখে। ইস্পাতসহ শিল্প কারখানা সচল রাখতে এলএনজি নির্ভরতা বাদ দিয়ে আগের মতো আশপাশের গ্যাস ক্ষেত্র থেকে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি।

গ্যাসের অভাবে তৈরী পোশাক খাতে বিপর্যয় নেমে এসেছে উল্লেখ করে বিজিএমইএর সহ-সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, গত দুই দিনে এই খাতে উৎপাদনে ধস নেমেছে। কাজ না থাকায় শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে পোশাক খাত হুমকির মুখে পড়বে। আমেরিকা-ইউরোপসহ বিশ^ বাজারে রফতানি আদেশ কমছে। তিনি বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামকে সচল রাখতে আগের মতো জাতীয় গ্রিড থেকে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।

এদিকে চট্টগ্রামে দুই দিন পরও গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। যদিও পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, কারিগরি ত্রুটি সারানোর পর এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে। কিন্তু পাইপলাইনে এলেও বেশির ভাগ এলাকায় গ্রাহকের কাছে গ্যাস পৌঁছেনি। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে পাইপলাইনে এলএনজি টার্মিনালের গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়। কিন্তু চাপ অস্বাভাবিক কম। যেখানে ইদানীং নিয়মিত ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যায়, সেখানে শনিবার বিকেল পর্যন্ত ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। একদম পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। গতকালও দিনভর বাসা-বাড়িতে গ্যাসের হাহাকার দেখা যায়। সিএনজি ফিলিং স্টেশনে ছিল যানবাহনের ভিড়। কয়েকটি স্টেশনে ক্ষুব্ধ চালকেরা গ্যাসের দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

সাভার থেকে সেলিম আহমেদ জানান, আশুলিয়ার একটি ফ্যাশন কারখানার ব্যাবস্থাপক রফিকুল হক বলেন, তাদের কারখানায় গ্যাসের সংকট চলছে। মাঝে মধ্যে দিনে দুই-তিন ঘণ্টা গ্যাস পাচ্ছেন। তবে যখন আসছে তখন গ্যাসের চাপ খুবই কম থাকছে। ফলে কারখানা বন্ধই রাখতে হচ্ছে। অনেক শিল্প মালিক গ্যাসের অভাবে সিএনজি দিয়ে কারখানা চালু রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে সাভার তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড ব্যবস্থাপক আবু সালেহ মো. খাদেম উদ্দিন বলেন, শীতে গ্যাসের প্রেসার কম থাকে। তবে দ্রুতই এ সংকট নিরসন করা হবে। সাভার উপজেলার বিভিন্ন বাসাবাড়িতে তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। আর এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন এলাকাবাসী। সাভার ও আশুলিয়ায় এলাকার অনেক স্থানে দিন থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় গ্যাস থাকছে না। ভোর রাতে ঘণ্টাখানেকের জন্য গ্যাস পাওয়া গেলেও তার প্রেসার থাকে খুবই কম। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সাভার ও আশুলিয়ার বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের তীব্র সংকট। এতে করে অনেকেই রান্না করতে পারছেন না। বিশেষ করে আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চলে পোশাক শ্রমিকদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। সারাদিন কর্মব্যস্ততার পর ফিরে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হচ্ছে তাদের।

গাজীপুর থেকে মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, গাজীপুরে শিল্প কারখানা ও বাসাবাড়িতে তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। এ সংকটের কারণে শিল্প কারখানায় যেমন উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি বাসাবাড়িতে রান্নাবান্না করতে না পারায় বাইরে থেকে খাবার এনে খেতে হচ্ছে। গত এক সপ্তাহ ধরে গ্যাসের এ তীব্র সংকট চলে আসছে বলে বিভিন্ন শিল্প কারখানা কর্তৃপক্ষ ও বাসাবাড়ির মালিকরা জানিয়েছেন। গাজীপুর জেলার কোনাবাড়ি, কালিয়াকৈর, কাশিমপুর ও এর আশপাশের এলাকার বেশিরভাগ কারখানায় গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়ে কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। গাজীপুরে একাধিক কারখানা কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে জানা যায় যে, কারখানায় বয়লার চালানোর জন্য প্রতি ঘনফুটে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ থাকা দরকার। কিন্তু অনেক কারখানায় চাপ কমে প্রতি ঘনফুটে ১ থেকে ২ পিএসআইতে দাঁড়িয়েছে। কোথাও কোথাও শূন্যে নেমেছে। একাধিক প্রাপ্ত তথ্য তথ্য জানা গেছে, গত এক সপ্তাহ ধরে এই সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। শ্রমিকরা কারখানায় আসছেন ঠিকই কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে কাজ করতে পারছেন না। এতে কারখানা মালিকরা পড়েছেন মহাবিপদে। প্রতিদিন তাদের লাখ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করা না হলে রফতানি বাণিজ্যে মারাত্মক ধস নামার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে গাজীপুরে প্রতিষ্ঠিত এসএস নিটওয়্যারের এক কর্মকর্তা জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে তীব্র সংকটের কারণে তাদের কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং তাদের প্রচুর লোকসানের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বিদেশি অর্ডারের মাল সময়মতো দিতে না পারলে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিবে। যে কারণে শ্রমিকদের বেতন সময়মতো পরিশোধ করা সম্ভব হবে না।

নারায়ণগঞ্জ থেকে মোক্তার হোসেন মোল্লা জানান, বাংলাদেশ গার্মেন্টস মালিক-শ্রমিক ঐক্যফ্রন্টের নারায়ণগঞ্জ জেলা সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সেলিম আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, নারায়ণগঞ্জে গার্মেন্ট সেক্টরে গ্যাস সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। গ্যাসের এ সংকটের সময় যতক্ষণ গ্যাস থাকে ততক্ষণ উৎপাদন সম্ভব বাকি সময় বন্ধ রাখতে হয়। ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়াটা স্বাভাবিক। তবে গ্যাস সংকটের কারণে কোনো প্রতিষ্ঠান এখনো বন্ধ না হলেও এ অবস্থা বিদ্যমান থাকলে ভবিষ্যতে ফ্যাক্টরি চালু রাখা কঠিন হবে।

নরসিংদী থেকে মো. রফিকুল ইসলাম জানান, বস্ত্র শিল্প কারখানা সমৃদ্ধ নরসিংদী জেলা বর্তমানে গ্যাস সংকটের কারণে টেক্সটাইল ও ডাইং ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। বেশ কিছুদিন যাবত গ্যাসের চাপ একেবারেই নেই বললেই চলে। গ্যাস সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলোয় দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। মালিকেরা শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে দিতে হচ্ছে মজুরি। এতে করে বড় রকমের লোকসানের মুখে পড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে যে, গ্যাস-সংশ্লিষ্ট বস্ত্র শিল্প কারখানাগুলো দিনে ৩-৪ ঘণ্টা চলে, বাকি সময় শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে মজুরি দিতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে। নরসিংদী সদর শীলমা›দিদিতে অবস্থিত রাতুল টেক্সটাইল মিলের ম্যানেজার মকবুল হোসেনকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আর কিছুদিন গ্যাসের এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের মতো যত ফ্যাক্টরি আছে সবগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট মোমেন মোল্লা বলেন, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের নিকট আমাদের সমস্যাগুলো তুলে ধরেছি। তারা আশ্বস্ত করেছেন অল্প কিছুদিনের মধ্যে সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। এদিক দিয়ে আবাসিক গ্যাসের অভাবে সাধারণ মানুষগুলো দিনে একবারও রান্না করা খাবার তৈরি করতে পারছে না।

https://dailyinqilab.com/national/article/633063