১৯ জানুয়ারি ২০২৪, শুক্রবার, ৫:০০

মিলারদের কারসাজিতে বেড়েছে চালের দাম

 

রাজধানীর বাজারে গত এক সপ্তাহের বেশি সময়ের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। ৫০ কেজির প্রতি বস্তা চাল ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। চালের মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই দাম বাড়ার পেছনে মিলারদের কারসাজিকে দায়ী করছেন পাইকারি বিক্রেতারা। মিল মালিকরা বলছেন, বাড়তি দামে ধান কেনায় চালের দাম বেড়েছে।

চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর বাজারে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের চারটি তদারকি দল (মনিটরিং টিম) মাঠে রয়েছে। পাইকারি ও খুচরা দোকানগুলোতে চাল বিক্রির নিবন্ধন, মজুদ ও ক্রয়মূল্যের সঙ্গে বিক্রয়মূল্যের তফাতের যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখছে তারা।

গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কৃষি, বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করছে। চালের দাম বাড়ার কারণ জানতে ও দাম কমিয়ে আনতে করপোরেট ব্যবসায়ীদের ডাকা হবে।

মন্ত্রী বলেন, ‘অবৈধ মজুদ বন্ধে আমরা নওগাঁ থেকে অভিযান শুরু করেছি। ইউএনও-ওসি গিয়ে অবৈধভাবে মজুদ করা এসব প্রতিষ্ঠান সিলগালা ও জরিমানা করেছেন।’ 

দুই-এক দিনের মধ্যে করপোরেট ব্যবসায়ীদের ডাকা হবে বলে মন্ত্রী জানান।  

গতকাল দেশব্যাপী এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারী নিম্ন আয়ের পরিবারের মধ্যে টিসিবির পণ্য বিক্রি কার্যক্রম উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম (টিটু) বলেন, ‘যাঁরা সৎভাবে ব্যবসা করবেন, তাঁদের সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।

কেউ অবৈধভাবে পণ্য মজুদ করে বা ষড়যন্ত্র করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করলে, তাঁদের ব্যাপারে কঠোর হতে আমরা পিছপা হব না।’ 

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘গত কয়েক দিন ধরে চালের বাজারে অস্থিরতা লক্ষ করছি। আমরা চালের বাজারে গিয়ে তাদের ব্যবস্থাপনা দেখব। মিল থেকে দোকান পর্যন্ত সাপ্লাই চেইনে যাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকে, সেটি দূর করার উদ্যোগ নেব।’

গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পছন্দের মোটা চাল কেজিতে চার থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে ৫৬ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

চিকন চালের মধ্যে মিনিকেট মানভেদে প্রতি কেজি ৭২ থেকে ৭৮ টাকা ও নাজিরশাইল মানভেদে ৭০ থেকে ৮৫ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
 
কারওয়ান বাজারে চালের পাইকারি ব্যবসায়ী ঢাকা রাইস এজেন্সির ব্যবসায়ী মো. সায়েম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত ৮ থেকে ১০ দিনের ব্যবধানে বাজারে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চালের দাম ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। চিকন চাল মিনিকেট প্রতি বস্তা মানভেদে বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার ৬০০ টাকায়। মোটা চাল ব্রি-২৮ প্রতিবস্তা মানভেদে বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৭০০ থেকে দুই হাজার ৮০০ টাকায় এবং নাজিরশাইল চাল মানভেদে তিন হাজার ৩০০ থেকে চার হাজার টাকা।’ 

তিনি বলেন, ‘বাড়তি দামে ধান কেনার কথা বলে মিলাররা চালের দাম নতুন করে বাড়িয়েছেন। যার প্রভাব পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে পড়েছে।’

কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে মোট চাল উত্পাদনের ৪০ শতাংশ হয় আমন মৌসুমে। চলতি আমন মৌসুমে প্রায় এক কোটি ৭১ লাখ ৭৮ হাজার টন চাল উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই)। মোট ৫৮ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে এ বছর ধানের আবাদ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত কাটা হয়েছে ৫৭ লাখ ২৭ হাজার হেক্টর বা সাড়ে ৯৭ শতাংশ জমির ধান। এখান থেকে চাল উত্পাদন হয়েছে এক কোটি ৭০ লাখ ৯৩ হাজার টন। গড় ফলন হয়েছে হেক্টরপ্রতি ২.৯৮ টন। গত বছরের শেষ দিকে পোকামাকড় এবং ঘূর্ণিঝড় মিধিলি ও মিগজাউমের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমির ধান। সেই হিসাবে কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এবার প্রায় এক কোটি ৭৪ লাখ টন চাল উত্পাদন হওয়ার কথা।

এদিকে স্বল্প আয়ের মানুষকে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে চাল বিতরণ করছে সরকার। চলতি অর্থবছরে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এসব কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির কার্যক্রমও। বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রথমবারের মতো সরকারের এই সংস্থা তাদের পণ্যে চাল যুক্ত করেছে, যা অনেক কম মূল্যে পাচ্ছেন ক্রেতারা। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে সরকারিভাবে চাল বিতরণ হয়েছে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। 
চালের বাজারে অভিযান

চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। উপসচিব পদমর্যাদার চারজন কর্মকর্তা এসব অভিযান পরিচালনা করেন। গতকাল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মালিবাগ, খিলগাঁও তালতলা ও ঠাটারি বাজারে এসব অভিযান চালানো হয়।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শ্রাবস্তী রায় বলেন, নিয়মিত বাজার তদারকির অংশ হিসেবে তাঁরা অভিযান পরিচালনা করছেন। 

শেরপুর (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, বগুড়ার শেরপুরে চালসহ নিত্যপণ্যের মূল্যে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজার মনিটরিংসহ চার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। গতকাল দুপুরে শহরের বারদুয়ারী হাটখোলা এলাকায় এই অভিযান পরিচালিত হয়।

অভিযানে নেতৃত্ব দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. সুমন জিহাদী। এ সময় উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এস এম রেজাউল করিম, র্যাব-১২ বগুড়া সিপিএসসির সহকারী পরিচালক মো. সোহেল রানাসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা তাঁর সঙ্গে ছিলেন।

সহকারী কমিশনার জানান, গতকাল শহরের বারদুয়ারী হাট এলাকা চালের দোকানসহ চারটি মুদির দোকানে দ্রব্যমূল্যের তালিকা না টাঙানো, মেয়াদ উত্তীর্ণ জিনিসপত্র বিক্রিসহ আইন লঙ্ঘন করায় প্রাথমিকভাবে ১৭ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, কুষ্টিয়ার চাল বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়েছে। পাইকারি ও খুচরা দোকান এবং ধান-চালের মোকাম খাজানগরের অটোমেটিক চালকলগুলোর তথ্য সংগ্রহ করেছে মনিটরিং দল। সকাল ১১টার দিকে কুষ্টিয়ার চৌড়হাঁসে চালের দোকান থেকে অভিযান শুরু করেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তানভীর হায়দার। অভিযানে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, খাদ্য অধিদপ্তর, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা অংশ নেন।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তানভীর হায়দার বলেন, প্লাস্টিকের বস্তায় চাল রাখা, মূল্য তালিকার সঙ্গে দরের সমন্বয় না থাকার অভিযোগে তিনটি দোকানকে দুই হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কুষ্টিয়ার সহকারী পরিচালক সুচন্দন মণ্ডল জানান, আরো একটি দোকানিকে ছয় হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

https://www.kalerkantho.com/online/business/2024/01/19/1356054