১৮ জানুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৪:৩৯

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

৯৮.৩ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি

 

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে নগরবাসীর প্রত্যাশা ছিল অনেক। সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না উড়ালসড়কটি। সাধারণ মানুষের নয় বিত্তশালীদের সড়কে পরিণত হয়েছে ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রথম অংশটি। উদ্বোধনের পর থেকে এখন পর্যন্ত উড়ালসড়কটি ব্যবহার করে যতগুলো যানবাহন চলেছে তার ৯৮ দশমিক ৩৬ শতাংশই প্রাইভেটকার কিংবা মাইক্রোবাস ক্যাটাগরির। অথচ এই সময়ের মধ্যে গণপরিবহন অর্থাৎ বাস চলেছে মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ। আর ট্রাক চলাচল করেছে নামমাত্র। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল ও ট্রাফিক রিপোর্টে উঠে এসেছে এই তথ্য। 

প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকা শহরের যানজট অনেকাংশে কমে যাবে; একইসঙ্গে ভ্রমণের সময়ও বেঁচে যাবে বলে জানিয়ে আসছিলেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। তবে বাস্তবতা হলো- এয়ারপোর্ট থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত উড়ালসড়কটি চালু হলেও নিচের রাস্তার যানজট কমেনি। বরং যেসব জায়গায় উড়ালসড়কের র‌্যাম্প নেমেছে সেখানে বাড়তি গাড়ির চাপ বেড়ে যানজট প্রকট হচ্ছে। বিশেষ করে মহাখালী বাস টার্মিনাল, ফার্মগেট ও এয়ারপোর্টে র‌্যাম্প নামার অংশে যানজট দেখা যায়।

নগর বিশেষজ্ঞরা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েকে গণমুখী প্রকল্প বলতে নারাজ। তারা বলছেন, এটি দিয়ে কেবল ব্যক্তিগত গাড়িই চলাচল করে। সাধারণ মানুষ এর সুবিধা পায় না। তাই এই ধরনের প্রকল্প শহরের জন্য টেকসই না। 

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল ও ট্রাফিক রিপোর্টের তথ্য বলছে, উদ্বোধনের পর থেকে চলতি ১৪ই জানুয়ারি পর্যন্ত ৪০ লাখ ৫২ হাজার ৫৪৭টি গাড়ি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে চলাচল করেছে। এরমধ্যে ৯৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ অর্থাৎ ৩৯ লাখ ৮৬ হাজার ৩৩৫টি গাড়ি প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস ক্যাটাগরির। এরমধ্যে বাস চলাচল করেছে মাত্র ৬০ হাজার ৯২১টি ও ট্রাক চলেছে মাত্র ৫ হাজার ১০০টি। উদ্বোধনের পর থেকে ৩৩ কোটি টাকার টোল আদায় হয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে। এরমধ্যে সেপ্টেম্বরে ৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, অক্টোবরে ৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা, নভেম্বরে ৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, ডিসেম্বরে ৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ও জানুয়ারিতে (১৪ তারিখ পর্যন্ত) ৩ কোটি ৪১ লাখ টাকার টোল আদায় হয়েছে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে নগরের সাধারণ মানুষের মধ্যে বৈষম্য প্রকট ও দৃশ্যমান করছে উল্লেখ করে নগর পরিকল্পনাবিদ ও ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান মানবজমিনকে বলেছেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শহরকে বাইপাস করেই যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা ডিজাইনই করেছে শহরের ভেতরে আসার জন্য। ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে টোল আদায় করাই ছিল আগ্রহ। এই ধরনের সড়কগুলো সারা পৃথিবীতেই ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে। এই ব্যক্তিগত গাড়ি যেখানে নামে বা ওঠে সেখানে শহরের ভেতর এক ধরনের চাপ তৈরি হয়। সার্বিকভাবে বলা যায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যানজট কমবে না বরং ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার আগ্রহ আরও বাড়বে। এজন্য এটা শহরকে টেকসই করা কোনো প্রকল্প না। এটা আগাগোড়াই শহরের জন্য বোঝা। 

সাধারণ মানুষ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধা পাচ্ছে না এটাকে অন্যায্য মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমাদের ট্রান্সপোর্ট পলিসিতে আছে যেখানে সাধারণ মানুষকে সেবা দেয় সেখানে সরকারের আগ্রহ থাকার কথা। কিন্তু এখন উল্টো হচ্ছে। সরকার সাধারণ মানুষের জন্য যদি মানসম্মত বাস সার্ভিস দিতে পারতো এই টাকা দিয়ে তাহলে অনেক বড় একটা পরিবর্তন আসতে পারতো। প্রথম থেকেই এই ধরনের মেগা প্রকল্পের বিপরীতে ছিলাম আমরা। ব্যক্তিগত গাড়িকে আমন্ত্রণ জানায় এই ধরনের কোনো প্রকল্পই শহরের জন্য টেকসই না। দিনশেষে এটা প্রমাণিত। আমরা ভবিষ্যতে যেন বড় ভুল না করি সেই শিক্ষা নেয়া উচিত। এক্সপ্রেসওয়েটা তো গণমুখী নাই, বরং এটার জন্য হাতিরঝিল, পান্থকুঞ্জ পার্ক ধ্বংস করে পলাশী পর্যন্ত নতুন র‌্যাম্প তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রাথমিক পর্যায়ের পরিকল্পনায়ও ছিল না। এটা যখন পলাশীতে নামবে তখন বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওখানে ব্যক্তিগত গাড়ি নামা, ওঠার কারণে আলাদা একটা চাপ তৈরি হবে নীলক্ষেতের মতো জায়গায়।

এয়ারপোর্ট থেকে মহাখালী নিয়মিত বাসে চলাচল করেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মহসিন হাসান। তিনি বলেন, আমাদের বাসে করেই গন্তব্যে যেতে হয়। সব সময় যেসব বাসে যাই তা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে চলে না। আমাদের যানজটেই যেতে হয়। অবরোধ থাকলে একটু যানজট কম থাকে। অন্য সময় তীব্র যানজট হয়। বঙ্গবন্ধু এয়াপোর্ট পরিবহন নামের বাস থেকে নামার পর কথা হয় আরফান আলী নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি বনানী-এয়ারপোর্ট রুটে নিয়মিত চলাচল করেন। আরফান আলী বলেন, ওপর দিয়ে গাড়িগুলো দ্রুত চলে যায়। কিন্তু আমরা তো সেই যানজটেই থাকি। লোকাল গাড়িগুলো উপরে চলাচল করে না। দু’-একটা বিআরটিসি বাস চলে সেটার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। 

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম এস আকতার মানবজমিনকে বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে মাঝখানে নামা-ওঠার ব্যবস্থা নাই। গাড়ি থাকার কোনো উপায় নাই, দাঁড়ানোও যাবে না। যারা এয়ারপোর্ট থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত চলছে তারা বাসে চলতে পারছে। এখন আংশিক চালু হয়েছে তাই পুরো সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। পুরোটা যখন চালু হবে তখন সব ধরনের মানুষ পুরো সুবিধা পাবে। ঢাকার যে যানজট এখন সেটা থেকে কিছুটা হলেও কমে আসছে। 

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা খরচ করে ঢাকার প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি তৈরি করছে থাইল্যান্ডভিত্তিক কনগ্লোমারেট প্রতিষ্ঠান ইতালথাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড, চীনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান শ্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন। এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে গঠন করা হয়েছে ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নামের একটি বেসরকারি কোম্পানি। নির্মাণ-পরবর্তী সাড়ে ২১ বছর টোল আদায় করবে এ কোম্পানিটি।

https://mzamin.com/news.php?news=93623