১৭ জানুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ১২:৪২

পাঁচ ইসলামী ব্যাংকে ঘাটতি ২৪ হাজার কোটি টাকা

 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ‘বিশেষ ধার’ নিয়ে বছর শেষের চলতি হিসাব ইতিবাচক দেখিয়েছিল শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ইসলামী ব্যাংক। ধারের মেয়াদ শেষ হতেই এসব ব্যাংক আবার পড়েছে ঘাটতিতে। ব্যাংকগুলো হলো– ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন। গত বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলো প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকার ঘাটতিতে ছিল। এর মধ্যে বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণ (সিআরআর) বাবদ ঘাটতি ১০ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঋণাত্মক স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

চলতি হিসাবে ঘাটতি মেটাতে না পারলে গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে এসব ব্যাংকের লেনদেন বন্ধের হুঁশিয়ারি দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, এসব ব্যাংকের লেনদেন বন্ধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এর পর পাঁচ ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন ভালো দেখাতে বছরের শেষ কর্মদিবস ২৮ ডিসেম্বর কোনো উপকরণ ছাড়াই ‘বিশেষ ধার’ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাঁচ ইসলামীসহ মোট ৯টি ব্যাংককে ওই দিন দেওয়া হয় ২২ হাজার কোটি টাকা। এর আগে ২০২২ সালের শেষ কর্মদিবসেও পাঁচ ইসলামী ব্যাংককে ‘লেন্ডার অব দ্য লাস্ট রিসোর্ট’ হিসেবে ১৩ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

জানা গেছে, নানা অনিয়মের কারণে ২০২২ সালের শেষ দিক থেকে এসব ব্যাংকে চরম তারল্য সংকট দেখা দেয়। দিন দিন এ সংকট তীব্র হলেও ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। অনেক দিন ধরে বিধিবদ্ধ নগদ জমা (সিআরআর) এবং বিধিবদ্ধ তারল্য (এসএলআর) সংরক্ষণ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এ জন্য জরিমানার টাকা দেওয়ার মতো অবস্থাও নেই। অন্য ব্যাংক থেকে ধারদেনা করতে হলে বিভিন্ন উপকরণ লাগে। তা না থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ‘বিশেষ ধার’ এবং চলতি হিসাব নেতিবাচক নিয়েই চলছে পাঁচ ইসলামী ব্যাংক।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক সমকালকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকলেও অন্য ব্যাংকের সঙ্গে এসব ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ করা হয়নি। তবে ঘাটতি কিছুটা সমন্বয় করেছিল। ব্যাংকগুলোর সর্বশেষ অবস্থা জানা নেই। তবে এ বিষয়ে কাজ চলছে।

কোন ব্যাংকের ঘাটতি কত
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, একটি ব্যাংকের ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৪ টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সিআরআর হিসেবে রাখতে হয়। কোনো ব্যাংক এতে ব্যর্থ হলে অনর্জিত অংশের ওপর ৯ শতাংশ হারে জরিমানা দিতে হয়। বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকের সিআরআর ও এসএলআর ঘাটতি হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি হিসাব দীর্ঘদিন নেতিবাচক হওয়ার ঘটনা আগে ঘটেনি। গত ২৮ ডিসেম্বর তিন দিনের জন্য বিশেষ ধারের পরও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ঘাটতি মেটাতে পারেনি। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির মোট ঘাটতি ছিল ৪ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। আর বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি ঘাটতি বেড়ে ৭ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা হয়। গত বৃহস্পতিবার তা আরও বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি হিসাব নেতিবাচক রয়েছে ৭ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। আর এক হাজার ৮১৫ কোটি টাকা সিআরআর রাখার কথা থাকলেও এক টাকাও রাখতে পারেনি। বিশেষ ধারের কারণে অন্য চার ব্যাংক ডিসেম্বর শেষে সামান্য হলেও সিআরআর ও চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখাতে পেরেছে। তবে গত ৩১ ডিসেম্বর ধারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরদিন গত ১ জানুয়ারি থেকে আবার বড় ঘাটতি দেখাতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের মোট ঘাটতি ছিল ৯ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি হিসাবে নেতিবাচক ৩ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা এবং সিআরআর বাবদ ৬ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। গত ১ জানুয়ারি ব্যাংকটির ঘাটতি ছিল ৫ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। গত বৃহস্পতিবার সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মোট ২ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা ঘাটতির মধ্যে ১ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা ছিল চলতি হিসাব নেতিবাচক। বাকি ১ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা সিআরআর বাবদ। গত ১ জানুয়ারি ব্যাংকটির মোট ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংকে মোট ১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ঘাটতির মধ্যে ১ হাজার ৪৮ কোটি টাকা চলতি হিসাব নেতিবাচক এবং ৭৪৬ কোটি টাকা সিআরআর বাবদ ঘাটতি। গত ১ জানুয়ারি মোট ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। গত বৃহস্পতিবার গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের মোট ৫২১ কোটি টাকা ঘাটতির মধ্যে ৪৮৩ কোটি টাকা সিআরআর ও ৩৮ কোটি টাকা চলতি হিসাব নেতিবাচক। গত ১ জানুয়ারি ব্যাংকটির মোট ঘাটতি ছিল ৪৩০ কোটি টাকা।

সার্বিক বিষয়ে বক্তব্যের জন্য ওই পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) টেলিফোন করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। এর মধ্যে একটি ব্যাংকের এমডি ফোন ধরলেও আপাতত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত হয় ৩১ ডিসেম্বরভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে। আর্থিক প্রতিবেদনে যেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি, সিআরআর ঘাটতিসহ বিভিন্ন খারাপ অবস্থার প্রতিফলন দেখাতে না হয়, সে জন্য এ উপায়ে ধার দেওয়া হয়েছে। এভাবে ঘাটতি সমন্বয়ের সুযোগ না দিলে ব্যাংকগুলোর এলসি কনফারমেশন চার্জসহ সব ধরনের খরচ আরও বাড়বে। সাম্প্রতিক সময়ে এমন অবস্থা হলেও একসময় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ অন্য শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত ধার দিত।

চলতি হিসাবে কীভাবে ঘাটতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়ের সঙ্গে প্রতিটি ব্যাংকের একটি চলতি হিসাব থাকে। এই হিসাব থেকে ব্যাংকের সিআরআর, এসএলআর সংরক্ষণ, আন্তঃব্যাংক লেনদেন নিষ্পত্তি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দেওয়া পুনঃঅর্থায়নসহ সব লেনদেন নিষ্পত্তি হয়। বিদ্যমান নিয়মে কোনো ব্যাংকের চলতি হিসাবে টাকা না থাকলে লেনদেন হবে না– এটাই স্বাভাবিক। তবে মাসের পর মাস তা ঋণাত্মক হওয়ার সুযোগ নেই। তবে শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংকের হিসাব অনেক দিন ধরে ঋণাত্মক হলেও লেনদেন অব্যাহত আছে। ঘাটতি পরিস্থিতি অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে যাওয়ায় কয়েক দফা মৌখিক সতর্কতার পর গত ২৮ নভেম্বর পাঁচ ব্যাংকের এমডিকে সতর্ক করে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়, ‘মতিঝিল কার্যালয়ে রক্ষিত আপনাদের চলতি হিসাবের মাধ্যমে আন্তঃব্যাংক লেনদেন নিষ্পত্তি হয়। দীর্ঘদিন ধরে আপনাদের চলতি হিসাবের স্থিতি ঋণাত্মক, যা স্বাভাবিক ব্যাংকিং প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিষয়টি বারবার আপনাদের গোচরীভূত করা হলেও উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় চিঠি পাওয়ার ২০ কর্মদিবস তথা ২৬ ডিসেম্বরের মধ্যে চলতি হিসাবের ঋণাত্মক স্থিতি সমন্বয় করতে না পারলে সব বা নির্দিষ্ট কোনো ক্লিয়ারিং প্ল্যাটফর্ম থেকে বিরত রাখা হবে।’

 

https://www.samakal.com/economics/article/218386