১৭ জানুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ১২:৪১

ভবনের নকশা অনুমোদন দিয়েই খালাস রাজউক

 

২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ডেমরার কোনাপাড়ায় একটি নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ থেকে ইট মাথায় পড়ে মারা যান গার্মেন্টকর্মী রুনা বেগম (২২)। পরের বছরের ৩০ অক্টোবর মোহাম্মদপুরে আরেকটি নির্মাণাধীন ভবন থেকে ইট পড়ে মারা যায় দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আব্দুল হাফিজ কারেমী। সবশেষ গত ১১ জানুয়ারি মৌচাক মার্কেটের পাশে একটি ভবনের ওপর থেকে কংক্রিটের খণ্ড মাথায় পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক দ্বীপান্বিতা বিশ্বাস দিপু।

এভাবে মাঝেমধ্যেই নির্মাণাধীন ভবনের ওপর থেকে ইট-পাথর পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। নির্মাণ শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনা তো আছেই! কিন্তু এসব মৃত্যুর ঘটনায় দায়ী কে– সেই প্রশ্ন এবার উঠেছে জোরেশোরে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল (সিভিল) বিভাগের অধ্যাপক মো. বদরুজ্জামান সমকালকে বলেন, ‘যে ভবন থেকে ইট পড়ে আর যিনি ভবনটি বানান, এটা তাদের দায়। কারণ কনস্ট্রাকশন সেফটি প্ল্যান অনেকে অনুসরণ করেন না! দেখা যায়, ১০ তলার ওপর একজন ওয়েল্ডিং করছেন কোমরে কোনোরকম একটি দড়ি বেঁধে নিয়ে। রাজউকের নিয়মিত এসব মনিটর করার কথা। থার্ড পার্টি হিসেবে তারা সেই কাজটিও ঠিকমতো করছে না।’ বড় বড় প্রকল্পে প্রতিনিয়ত সেফটি প্ল্যান জমা দিতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শাহজালাল বিমানবন্দরে যে তৃতীয় টার্মিনাল হচ্ছে, সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু বিআরটি বা কোনো ব্যক্তি যখন ভবন তৈরি করেন, তখন সেই নিরাপত্তা দেখা যায় না।’ অধ্যাপক মো. বদরুজ্জামান বলেন, ‘নির্মাণাধীন ভবনের সরঞ্জাম পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায়ও আনা হচ্ছে না। যেন বাংলাদেশের মানুষের জীবনের দাম কম। গরিব মানুষ হলে তো কথাই নেই।’ তাঁর মতে, সেফটি প্রটোকল অনুসরণ করলে দুর্ঘটনা পুরোপুরি বন্ধ না হলেও অনেকটা কমে আসবে। 

রাজধানীতে ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদনের পর প্রতিটি পর্যায়ে কাজ তদারকির কথা বলা হয়েছে ইমারত নির্মাণ বিধিমালায়। টিনশেড কাঠামো থেকে শুরু করে বহুতল ভবন নির্মাণ– সব ক্ষেত্রেই এ নিয়ম প্রযোজ্য। কিন্তু রাজউকের পক্ষ থেকে কখনোই নির্মাণকাজ তদারকি করা হয় না। নির্মাণের শুরু থেকে একজন পরিদর্শক সার্বক্ষণিক তদারকি করার কথা থাকলেও নকশা অনুমোদন দিয়েই যেন তারা খালাস।

ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ (সংশোধিত)-এ একটি ভবনের নকশা অনুমোদনের পর প্রতিটি ধাপে মনিটরিংয়ের কথা উল্লেখ আছে। বিধিমালার ৩০৫ ও ৩০৭ ধারায় বলা হয়েছে, বহুতল ভবন নির্মাণ শুরুর সময় নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রাজউককে অবহিত করবে। রাজউকের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে কাজ শুরু হবে। বিধিমালার ৩১১ ধারায় বলা হয়েছে, বেজমেন্ট নির্মাণের পর নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে রাজউকের কাছ থেকে একটি সনদপত্র নিতে হবে। ৩১৩ ধারায় বলা হয়েছে, নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তদারকির দায়িত্ব পালন করলেও রাজউকের পক্ষ থেকে তদারকির ব্যবস্থা থাকতে হবে। ৪০২ ধারায় বলা হয়েছে, ভবনের নকশা প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত স্থপতি ও প্রকৌশলীরা তদারকি করবেন এবং প্রতিটি স্তরের কাজ শেষের পর রাজউককে অবহিত করে পরবর্তী স্তরের কাজের অনুমোদন নিতে হবে। ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার পর রাজউক থেকে ভবনের ব্যবহার সনদপত্র নেওয়ার কথা বলা হয়েছে বিধিমালার ৪০৭ ধারায়। এই সনদপত্র জমা দেওয়ার পর সেখানে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ দেবে সেবা সংস্থাগুলো। অথচ রাজউক কখনোই স্তরে স্তরে মনিটরিংয়ের কাজ করে না। আবার ভবন ব্যবহারের ছাড়পত্র না নিয়েও অনেকে সেবা সংযোগ পেয়ে যান।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান সমকালকে বলেন, ‘রাজউকের ইন্সপেক্টর ও অথরাজইড অফিসাররা সরেজমিন পরিদর্শন করলে নিরাপত্তা ঘাটতির বিষয়টি বের হতো। মনে হয় তারা একবারও সরেজমিন যান না।’ তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের হেলমেট ও নির্ধারিত ড্রেস ছাড়া কাজ করার সুযোগ নেই। অনেকখানে নিরাপত্তা জাল থাকে না। স্থানীয় কাউন্সিলও কর্তৃপক্ষকে সে বিষয়ে জানায় না।’ 

বাংলাদেশ লেবার স্টাডিজের তথ্যমতে, গত ১০ বছরে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১৪ হাজার ৩০৬ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হন ৭৯৩ জন। আর হতাহতের একটি বড় অংশই নির্মিণ শ্রমিক। এর আগে রাজধানীর ভাটারায় একটি নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে নিহত হন দুই শ্রমিক। তারা ১৪ তলা ভবনের ৯ তলায় মাচায় দাঁড়িয়ে পলেস্তারার কাজ করছিলেন। হঠাৎ মাচা ছিঁড়ে দু’জন নিচে পড়ে যান। উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। গত ২৩ জুন ক্যান্টনমেন্ট পশ্চিম মানিকদি এলাকায় নির্মাণাধীন একটি ভবনের ৯ তলা থেকে পড়ে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। 

এ প্রসঙ্গে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিচালনা বোর্ডের সদস্য (উন্নয়ন) মেজর (অব.) ইঞ্জিনিয়ার সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘নির্মাণ শ্রমিকদের কাজ করার সময় সেফটি বেল্ট পরার কথা। অনেক ক্ষেত্রেই তারা তা করেন না। ভবনের চারপাশে নেট-টিন দিয়ে ঘেরাও দেওয়ার কথা। প্রতি তলার কাজ করার সময় আশপাশে শেড দিতে হয়, যাতে নির্মাণসামগ্রী পড়ে গেলে শেডে আটকে যায়। ভালো ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান এভাবেই কাজ করে। কিন্তু অনেকেই এ নিয়মের ধার ধারেন না! এটা দেখার দায়িত্ব মূলত রাজউকের।’ তবে ভবন ব্যবহারের জন্য সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র লাগে। তাই তারাও নজরদারি বাড়াতে পারে বলে মনে করেন ইঞ্জিনিয়ার সামসুদ্দীন আহমদ। তিনি জানান, নির্মাণকাজে শর্তের বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ কারে শিগগির সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেওয়া হবে, যাতে ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা আর না ঘটে।

https://www.samakal.com/capital/article/218378