১৭ জানুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ১২:৪০

অন্যরকম’ ঠাণ্ডায় কাবু জনজীবন

 

কেউ বলে ‘সেইরকম’ শীত! কেউ বলছে ‘অন্যরকম’ শীত। আসলেই এবার শীতের মতিগতি ব্যতিক্রম। অন্যরকম। গেল ২০২৩ সালে টানা খরা-অনাবৃষ্টি ও উচ্চ তাপমাত্রা বাংলাদেশে ৫০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। বিশ^জুড়ে অধিকাংশ দেশে আগুনে ঝলসানোর মতো উচ্চ তাপদাহের রেকর্ড সৃষ্টি হয়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই গেল ডিসেম্বরের শেষ দিকে ও চলতি জানুয়ারি মাসের গোড়া থেকেই বাংলাদেশ, চীন, ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোসহ এশিয়া, ইউরোপ-আমেরকিাসহ পশ্চিমা দেশসমূহে কোথাও তুষারঝড়, কোথাও টানা তুষারপাত, তাপমাত্রার পারদ মাইনাসের দিকে সর্ব-নিম্নগামী, কোথাও অস্বাভাবিক ঠাণ্ডায় থর থর করে কাঁপছে এবং শীতকষ্টে কাঁদছে মানুষজন। থমকে গেছে পশুপাখি, প্রাণ-প্রকৃতি। চিরচেনা ছয়টি ঋতুর দেশ বাংলাদেশে পৌষ-মাঘ ভর শীতকালে শীত পড়বে, ঝরবে কুয়াশা এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আবহাওয়া-জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের শীত ব্যতিক্রমধর্মী। শৈত্যপ্রবাহের রাতের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ‘অস্বাভাবিক নীচে’ না নামলেও ঠাণ্ডার তীব্রতা ও অনুভূতি অস্বাভাবিক। এর ফলে শীতকষ্ট অসহনীয় হয়ে উঠেছে।

গতকাল মঙ্গলবার ‘বাঘ কাঁপানো মাঘ’ মাসের দ্বিতীয় দিনে প্রায় সারা দেশে রাতের সার্বিক তাপমাত্রা আরও কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে ৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন সোমবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল বরিশালে ৯ ডিগ্রি এবং আগের তিন দিনে উত্তরাঞ্চলে ৭.৫ থেকে ৮ ডিগ্রি সে. পর্যন্ত। গতকাল রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা ছিল সর্বনিম্ন ১৩.৮ ডিগ্রি সে.। যা মাঘের ঘোরতর শীত মৌসুমের এ সময়ে রাতের স্বাভাবিক তাপমাত্রা। তাহলে এবার শীতকষ্ট বা ঠাণ্ডার কামড় এতটা তীব্র কেন? এ বিষয়ে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা পাঁচটি ফ্যাক্টর বা কারণ উল্লেখ করেছেন।

এক, টানা প্রায় দুই সপ্তাহ যাবৎ রাত ও দিনের দীর্ঘ সময়ব্যাপী অতি ঘন কুয়াশা পড়ছে। ঘন কুয়াশার কারণে সূর্যের আলো ও তেজ মাটিতে আসা অবধি নিস্তেজ দুর্বল হয়ে পড়ছে। বাড়ছে ঠাণ্ডার অনুভূতি। দুই, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকের হিমেল হাড় কনকনে বায়ুপ্রবাহ আসছে প্রবল বেগে। তিন, দিন ও রাতের তাপমাত্রার যে স্বাভাবিক পার্থক্য থাকার কথা কুয়াশাপাত ও বিভিন্ন কারণে দিনের তাপমাত্রার পারদ নিচের দিকে নেমে গেছে এবং রাতের তাপমাত্রার খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে গত এক সপ্তাহ ধরে। যেমন- গতকালও দেশের বেশিরভাগ জেলায় দিনের (সর্বোচ্চ) তাপমাত্রার পারদ ১৮ কিংবা ২০ ডিগ্রিরও নিচের দিকে ধাবিত হয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়ায় দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৩.৯ ডিগ্রির বিপরীতে রাতের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১০.৭ ডিগ্রি সে., দিনাজপুরে তা যথাক্রমে ১৪ ও ১১.৪ ডিগ্রি, ডিমলায় ১৪.৫ ও ১১ ডিগ্রি, সৈয়দপুরে ১৪.৮ ও ১১.৬ ডিগ্রি, বদলগাছীতে ১৫ ও ১০.৩ ডিগ্রি, রাজধানী ঢাকায় যথাক্রমে ১৮.৫ ও ১৩.৮ ডিগ্রি সে.।

চার, শীত মৌসুমের এ সময়ে আবহাওয়া শুষ্ক থাকাই স্বাভাবিক, অথচ সেখানে বাতাসে জলীয়বাষ্প বা আপেক্ষিক আর্দ্রতার হার অনেক বেশিই রয়েছে। গতকাল ঢাকায় বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ ছিল সকালে ৯৩ শতাংশ ও সন্ধ্যায় ৭৮ শতাংশ। অতি আর্দ্রতায় বাতাসে শীতের আবহ জোরদার হয়েছে। পাঁচ, ঊর্ধ্বাকাশের হিমশীতল জেটবায়ু অত্যধিক হারে নেমে আসছে মাটির দিকে। বাড়ছে ঠাণ্ডা। সর্বত্র অসহ্য হয়ে উঠেছে শীতকষ্ট।

টানা ঠাণ্ডায় ঘন কুয়াশা ও হিমেল হাওয়ায় বৈরী আবহাওয়ায় বিশেষ করে গরিব, দিনমজুর, অসহায়, গৃহহীন ভাসমান মানুষেরা খড়কুটো জ্বালিয়ে কোনমতে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। তাদের রোজগার কমে গেছে। শীতবস্ত্র বিতরণ কিংবা দরিদ্র জনগোষ্ঠিার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানোর উদ্যোগ তেমন চোখে পড়ে না। তাছাড়া সর্বত্র ঠাণ্ডাজনিত বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধির প্রকোপ বেড়েই চলেছে। হাসপাতাল-ক্লিনিকে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে।

কী বলছে আবহাওয়া পূর্বাভাস : আগামী তিন দিনের আবহাওয়া পূর্বাভাসে আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, উপ-মহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও এর কাছাকাছি এলাকায় রয়েছে। এর ফলে তৈরি হয়েছে একটি শীত-কুয়াশার বলয়। আজ বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে জানা গেছে, অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। রাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারী থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে এবং এটি কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীন নৌ পরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগে সাময়িকভাবে বিঘ্ন ঘটতে পারে।

সারাদেশে রাত ও দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে। দেশের কোথাও কোথাও ঠাণ্ডা পরিস্থিতি বিরাজ করতে পারে।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে জানা গেছে, খুলনা বিভাগের দু-এক জায়গায় হালকা বৃষ্টি কিংবা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা এক থেকে ২ ডিগ্রি সে. বৃদ্ধি পেতে পারে এবং দিনের তাপমাত্রাও কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে আগামী শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার পরবর্তী পূর্বাভাসে জানা গেছে, রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে হালকা বৃষ্টি, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, কোথাও কোথাও বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।

তখন সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে। দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। এর পরের ৫ দিনে রাতের তাপমাত্রা হ্রাস পেতে পারে। এ সময়ে ক্রমেই আরো বাড়তে পারে ঠাণ্ডা ও শৈত্যপ্রবাহের জোর।

অন্যদিকে পূর্বাভাস অনুযায়ী মাঘের কুয়াশার সাথে মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া ও অকাল বৃষ্টিপাত হলে আলু, টমেটো, পেঁয়াজ, আদা-রসুন, তরমুজসহ শীতকালীন ফল-ফসল, শাক-সবজি ফলনে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ক্ষতি হতে পারে বোরো বীজতলার। সেই সাথে কোল্ড ইনজুরি, লেট ব্লাইট রোগসহ ফল-ফসলে পোকার সংক্রমণ নিয়ে চিন্তিত কৃষকেরা।

এদিকে শ্রীমঙ্গল থেকে আনোয়ার হোসেন জসিম জানান, মৌলভীবাজার শ্রীমঙ্গলে উপজেলায় গতকাল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টায় শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষক বিপ্লব দাশ ইনকিলাবকে এ তথ্য জানান। এবার মাঘের শুরুতেই দাপট দেখাতে শুরু করেছে শীত। ঘুন কুয়াশা আর হাড়কাঁপানো বাতাসে চা শ্রমিকদের জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে।

জেলাজুড়ে গত কয়েকদিনে হিমেল হাওয়া আর প্রচন্ড শীতে জনজীবন বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে। ঘন কুয়াশার সঙ্গে প্রচন্ড শীতে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। বিশেষ করে চা শিল্পাঞ্চলে তুলনামূলক বেশি শীত থাকায় পিছিয়ে পড়া চা জনগোষ্ঠীর মানুষজনের দুর্ভোগ বেড়েছে। এবং ঠান্ডার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতজনিত রোগের প্রকোপ। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষেরা।

শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া জানায়, গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টায় ৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সোমবার ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রোববার সকাল ৯টায় ১১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। গত ২০ ডিসেম্বর থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত শ্রীমঙ্গল উপজেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি থেকে ১৬ ডিগ্রি পর্যন্ত্র তাপমাত্রা ওঠানামা করছিল। এবং মঙ্গলবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। একই সময়ে সর্বোচ্চ ২৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে কক্সবাজারে। আগের দিন সোমবার সর্বনিম্ন সাড়ে ৯ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল বরিশালে।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা বলেন, শ্রীমঙ্গলে শীত মৌসুমে চা শ্রমিক ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা বেশি কষ্ট পান। অন্যান্য বছরের মতো এ বছর শীত মৌসুমে বিভিন্ন সংগঠন ও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন গরম কাপড় বিতরণ করা হয়নি এখানে।

শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.আবু তালেব ইনকিলাবকে জানান, এই শীতে দরিদ্র অসহায় শীতার্ত মানুষের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। এবং ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের নিকট কম্বল বিতরণের জন্য দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া আমার ব্যক্তিগত ভাবেও শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ করছি। উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের মাজদিহি পাহাড়ে নির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের ২০০ পরিবারের মাঝে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ অব্যাহত থাকবে।

https://dailyinqilab.com/national/article/632162