১৭ জানুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ১২:৩৭

গ্যাস সংকটে চুলা জ্বলে না দাম বাড়ানোর তৎপরতা

 

তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানোর তৎপরতা শুরু হয়েছে। গ্যাসের চাপ এত কম যে চুলাই জ্বলে না সারাদিন। ভোর না হতেই চলে যায়। কোথাও মিট মিট করে জ্বলে। দিনের বেশির ভাগ সময় রান্নার চুলায় গ্যাস থাকে না। রাজধানীর অনেক এলাকার গ্রাহকেরা গ্যাসের অভাবে চুলা জ্বালাতে পারছেন না। বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিনিয়ত তিতাসের অভিযোগ কেন্দ্রে ফোন করে জানাচ্ছেন গ্রাহকেরা। গ্যাস সংকটের কথা স্বীকারও করেছেন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী। তবে এটি সাময়িক বলে মন্তব্য করে তিনি।

রাজধানীর মগবাজারের পূর্ব নয়াটোলা, মীরবাগ, উত্তর বাসাবো, মধ্যবাড্ডা, শাহজাহানপুর, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, কাজীপাড়া, ধানমণ্ডি, মহাখালী, নদ্দা, বসুন্ধরা, কুড়িল, ভাটারা, বাড্ডা, মিরপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এই অবস্থা চলছে বলে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

একই চিত্র রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর, বকশিবাজার, ডেমরা, শ্যামলী, বনশ্রী, ভাষানটেক এলাকায়ও। 

মগবাজারের পূর্ব নয়াটোলার বাসিন্দা সোহেল মিয়া জানান, গ্যাস না থাকায় মধ্যরাতে রান্না করতে বাধ্য হচ্ছেন। সকাল ৬টার দিকে মিট মিট করে চুলা জ্বলে। এতে রান্না করা যায় না। তিনি বলেন, বাধ্য হয়ে ইলেক্ট্রিক চুলার দিকে ঝুঁকছেন। মীরবাগের এক বাসিন্দা বলেন,  যেই গ্যাস লাইনে আসে তা দিয়ে চুলা জ্বলে না। বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার গ্যাস কিনেছেন। এতে তাকে মাসিক গ্যাস বিলের পাশাপাশি বাড়তি গুনতে হচ্ছে সিলিন্ডারের দেড় হাজার টাকা। যারা ইলেক্ট্রিক চুলা ব্যবহার করছেন তাদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি বিল। মোহাম্মদপুর টিক্কাপাড়া পানির প্যাম্পের কাছে জাহানারা নামের এক গৃহিণী থাকেন। তিনি মানবজমিনকে জানান, ভোর থেকেই লাইনে গ্যাস থাকে না। রান্না করা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে খাবার কিনে খেতে হয় ।

চুলায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস থাকুক বা না থাকুক, একজন গ্রাহককে মাসে গ্যাস বিল (দুই চুলা) দিতে হয় ১ হাজার ৮০ টাকা। এই বিল এখন ৫১২ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। গ্যাস বিতরণ সংস্থাগুলোর মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব মানা হলে দুই চুলার ক্ষেত্রে মাসে বিল আসবে ১ হাজার ৫৯২ টাকা। অন্যদিকে এক চুলার জন্য এখন মাসে বিল দিতে হয় ৯৯০ টাকা। এই বিলও ৩৯০ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে কারিগরি কমিটি গঠন করেছে জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এ কমিটি ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের সপক্ষে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে জমা দিতে দেশের ৬টি গ্যাস বিতরণ সংস্থাকে গত সোমবার চিঠি দিয়েছে ওই কমিটি। তথ্য-উপাত্ত যাচাইয়ের পর চলতি জানুয়ারি মাসের মধ্যেই নিজেদের সিদ্ধান্ত কমিশনকে জানাবে তারা। বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ৪৩ লাখ গ্রাহকের বাসাবাড়িতে গ্যাসের সংযোগ রয়েছে। এর মধ্যে প্রিপেইড গ্রাহক প্রায় ৪ লাখ ৩০ হাজার।

চুলায় গ্যাসের ব্যবহার ৬০ ঘনমিটারের চেয়ে বেশি ধরে মাসিক বিল সমন্বয় করতে গত বছর বিইআরসিতে আবেদন করে ঢাকা ও আশপাশের জেলায় গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। এর বাইরে আরও পাঁচটি গ্যাস বিতরণ সংস্থা থাকায় এ বিষয়ে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) মতামত চায় বিইআরসি। তিতাসের আবেদন অন্যদের জন্যও বিবেচনায় নিতে সুপারিশ করে চিঠি দেয় পেট্রোবাংলা। সর্বশেষ গত মাসে বিইআরসির সভায় এটি বিবেচনায় নেয়া হয়। আর গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে গঠন করা হয় কারিগরি কমিটি। দুই চুলার ক্ষেত্রে ৮৮ দশমিক ৪৪ ঘনমিটার ও এক চুলায় ৭৬ দশমিক ৬৫ ঘনমিটার নির্ধারণের আবেদন করেছে তিতাস। আবাসিকে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম এখন ১৮ টাকা। 

২০২২ সালের জুনে আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাসের দাম বাড়ায় বিইআরসি। তখন প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১৮ টাকা করা হয়। তবে মিটার ছাড়া গ্রাহকদের জন্য মাসে গ্যাস ব্যবহারের পরিমাণ কমিয়ে দুই চুলায় ৬০ ঘনমিটার এবং এক চুলায় ৫৫ ঘনমিটার ধরা হয়। এতে দুই চুলার মাসিক বিল ১ হাজার ৮০ ও এক চুলার বিল ৯৯০ টাকা ঘোষণা করা হয়। সূত্র জানায়, দেশে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। দিনে ৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া গেলে শিল্প আবাসিকের চাহিদার অনেকখানি পূরণ করা সম্ভব হয়। এখন সরবরাহ হচ্ছে ২৫০ কোটি ঘনফুটেরও কম। ডলার সংকটে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি কমে যাওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। একইসঙ্গে দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোতেও উৎপাদন কমেছে। আমদানি বাড়ানো গেলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে।

এ বিষয়ে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)’র জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম মানবজমিনকে বলেন,  চুলায় ঠিকমতো গ্যাস না থাকলেও গ্রাহককে পুরো বিলই দিতে হচ্ছে।  কীভাবে অবিবেচকের মতো দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। এটা গণবিরোধী। এমন পরিস্থিতিতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। রান্নার চুলায় গ্যাস না দিয়ে এলপিজি’র বাজার বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এতে বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর স্বার্থ আছে। বড় আকারের লুণ্ঠন হচ্ছে এখাতে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মানুষ কষ্টে আছে। এমন পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর চিন্তা কীভাবে তাদের মাথা থেকে আসে।

গ্যাসের সংকট নিয়ে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী যা বললেনগ্যাসের স্বল্পতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। বর্তমানে কিছু সংকটও রয়েছে। তবে এটা সাময়িক। আশা করছি, কয়েকদিনের মধ্যেই সংকট দূর হবে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে। গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রতিমন্ত্রী একথা জানিয়ে বলেন, মন্ত্রণালয় বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের চলমান কার্যক্রম ও গতিশীলতা ধরে রাখতে চায়। তবে চ্যালেঞ্জ আছে অনেক। দিন-তারিখ ঠিক করে নয়, দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোই লক্ষ্য। ভোলা-বরিশাল পাইপলাইন তৈরি করার লক্ষ্য রয়েছে। আরও ১০০টি কূপ খনন করা হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। আশাকরি, ২ বছরের মধ্যে ৫০০ এমএমসিএফ (মিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস যোগ করা যাবে। তিনি বলেন, এলএনজি আমদানিও বাড়বে। গ্যাস ম্যানেজমেন্ট ও মাস্টারপ্ল্যান করা হচ্ছে। বিবিয়ানায় সম্ভাবনা রয়েছে, ১ দশমিক ৬ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শেভরন সেখানে কাজ করছে। গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান করার বিষয়ে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানকে আনতে চাই। সেটি নিয়ে কাজ চলছে। তিনি আরও বলেন, মার্চের প্রথম সপ্তাহে এফএসআরইউ (ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল) আসবে। ২০২৬ সালের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দেয়ার লক্ষ্য রয়েছে। আমদানি বড় করতে চাই না।  তিনি বলেন, আগামী ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে হরিপুরের তেলের বিষয়টিও নিশ্চিত হওয়া যাবে। বিপিসির পাইপলাইন কার্যক্রম চলমান আছে। সেটি দ্রুত শেষ করা হবে। বিদ্যুতের বিষয়ে তিনি বলেন, বিদ্যুতের জন্য চ্যালেঞ্জ আছে। রোজা ও সেচ মৌসুম শুরু হতে যাচ্ছে। চাহিদা পূরণের চেষ্টা করা হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস, তেল ও কয়লার সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে সমস্যা হবে না। নসরুল হামিদ বলেন, বিশ্ব বাজারে তেল, গ্যাস ও কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত ১৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হচ্ছে। সামনে সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যাবে বলে আশা করা যায়। দেশে জ্বালানি তেলের দামের বিষয়ে তিনি বলেন, বাড়ানো বা কমানো বিষয় নয়; ডায়নামিক প্রাইস করার কাজ চলছে। কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতের দায়মুক্তি আইনের বিষয়ে তিনি বলেন, বিশেষ আইন আছে বলেই কাজ করা যাচ্ছে। দুর্নীতি কমাতে অনলাইন/প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। আইন ব্যবহারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেই কাজ করা হবে।

https://mzamin.com/news.php?news=93472