১৭ জানুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ১২:৩৪

অর্ধেক খেলাপি ঋণই ৫ ব্যাংকের দখলে

 

ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের অর্ধেকই পাঁচ ব্যাংকের দখলে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, মোট এক লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে ৭৪ হাজার ৮৫০ কোটি টাকাই রয়েছে এ পাঁচ ব্যাংকের, যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ। গত জুনভিত্তিক তথ্য নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক ক্ষেত্রে ঋণ বিতরণ করা হয়। অতীতেও এ ধরনের অনেক ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল। আবার এসব ঋণ পরিশোধ না করারও প্রবণতাও বেশি। এর ফলে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে পুঞ্জীভূত খেলাপি ঋণ অনেক বেশি।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন’ এ উল্লেখ করা হয়েছে, গত জুনে এক লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের দখলে রয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৬৫ শতাংশ। আর শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের দখলে রয়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। বাকি ৫২ শতাংশ রয়েছে বাকি ৫৪ ব্যাংকের।

খেলাপি ঋণের শীর্ষে থাকা ১০ ব্যাংকের মধ্যে পাঁচটিই সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক, তিনটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, একটি বিশেষায়িত ব্যাংক ও একটি বিদেশী ব্যাংক রয়েছে। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল চারটি সরকারি ব্যাংক, দু’টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, দু’টি বিশেষায়িত ব্যাংক ও দু’টি বিদেশী ব্যাংক।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, সময়ে সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের নীতিমালা শিথিল করা, প্রভাবশালীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করা ও ব্যাংক পরিচালকদের কেউ কেউ ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেয়ায় এ আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। আর এ মন্দ ঋণ সামাল দিতে আয়ের বড় একটি অংশ দিয়ে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। এর পরও কুলাতে না পেরে কোনো কোনো ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির মুখে পড়ে যাচ্ছে। অপরদিকে ব্যাংকগুলো আয়ের একটি বড় অংশ আয় খাতে নিতে পারছে না। এসব আয় ব্যাংকের খাতে স্থগিত করে রাখতে হচ্ছে। সবমিলেই ব্যাংক খাতে চাপ বেড়ে যাচ্ছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে মন্দঋণ বেড়ে গেলে নানা সঙ্কট বেড়ে যায়। প্রথমেই এসব ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ ব্যাংকগুলো আয় খাতে নিতে পারে না। এসব সুদ স্থগিত রাখা হয়। দ্বিতীয়ত, ধারাবাহিকভাবে এক বছরের বেশি সময় ঋণ আদায় না হলে ওই ঋণ মন্দ ঋণ হয়। আর একবার মন্দঋণ হলে তা আদায়ের জন্য ব্যাংকের মামলা করতে হয়। আর মামলা চলে দীর্ঘ দিন ধরে। এতে মামলা চালাতে ব্যাংকের যেমন ব্যয় হয়, তেমনি দীর্ঘসূত্রতার কারণে এসব ঋণ আদায়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আর একাধারে তিন বছর মন্দঋণ হলে ওই ঋণখেলাপি ঋণের হিসাব থেকে আলাদা করে রাখা হয়। করা হয় অবলোপন। এভাবে এসব ঋণ ব্যাংকের সম্পদের ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আর এসব ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে। প্রভিশন সংরক্ষণ করতে ব্যাংকের নিট আয় কমে যায়। এতে বছর শেষে শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে লভ্যাংশ বিতরণ কম করতে পারে। অনেক ব্যাংকের মন্দঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতেই আয় শেষ হয়ে যায়। এর পরও অনেকের প্রভিশন ঘাটতিতে পরে। সবমিলেই ব্যাংকের রেটিংও খারাপ হয়ে যায়।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এক শ্রেণীর ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ব্যাংক থেকে নানা কৌশলে ঋণ নিচ্ছে। কিন্তু ওইসব ঋণ ফেরত দিচ্ছেন না। প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপও নেয়া যাচ্ছে না। বরং নিত্যনতুন উপায় উপরণ বের করে ব্যাংক থেকে নতুন করে ঋণ বের করে নিচ্ছে। আবারো ওইসব ঋণখেলাপি হচ্ছে। আবারো নামমাত্র ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ঋণ নিয়মিত করে নতুন করে ঋণ নেয়া হচ্ছে। এভাবে একশ্রেণীর ব্যবসায়ীর পুঞ্জীভূত ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ কমাতে হলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বাড়তেই থাকবে, বৈ কমবে না।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/806975