১৫ জানুয়ারি ২০২৪, সোমবার, ৩:২২

হাসপাতালে বাড়ছে রোগী

 

কথায় আছে মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে। পৌষের শেষে মাঘের সেই কনকনে শীতের অনুভূতি পেয়েছে মানুষ। ঘন কুয়াশা ও হাড় কাঁপানো শীতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সেই সাথে ঠাণ্ডাজানিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চার জেলায় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ চলছে। এর সঙ্গে উত্তরের হিমেল হাওয়া ও ঘন কুয়াশায় সারা দেশে বইছে হাড় কাঁপানো কনকনে ঠাণ্ডা। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, শিশু ও বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক কম থাকায় তারা সহজে ঠাণ্ডাজনিত রোগে কাবু হয়ে পড়ছে। অনেকের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্য অনুসারে, শুধু ১৩ জানুয়ারি সারা দেশে নিউমোনিয়া, ক্রনিক ব্রংকাইটিস, ডায়রিয়া ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের মতো শীতকালীন রোগে আক্রান্ত হয়ে ৩ হাজার ১০১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগে ৬৭৭, ময়মনসিংহে ২৪১, চট্টগ্রামে ৭৮৬, রাজশাহীতে ১৭৮, রংপুরে ২৫৫, খুলনায় ৪৮০, বরিশালে ২৭৬ এবং সিলেটে ২০৮ জন ভর্তি হয়েছেন। এ সময় একজনের মৃত্যু হয়েছে।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এক মাসে ঠাণ্ডাজনিত রোগে আড়াই লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়ায় ৩২ জন মারা গেছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেশব্যাপী রোগীদের তথ্যের রেকর্ড থেকে জানা যায়, শীতকালীন অসুস্থতা হিসাবে শ্বাসতন্ত্রের রোগ ও ডায়রিয়া বড় আকারে দেখা দিয়েছে। গত ১৫ নভেম্বর থেকে ১৩ জানুয়ারি এ রোগে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৩১৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ৬১ হাজার ৯২৪ জন তীব্র শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ এবং ১ লাখ ৭১ হাজার ৩৯৪ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সংশ্লিষ্টরা জানান, শিশু শীতকালীন ফ্লু ও আরএস ভাইরাসে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। যেমন, সর্দি-কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, ব্রংকিওলাইটিসে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। অনেকে ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া, রেসেপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন, অ্যাজমাজনিত পালমোনারি প্রবলেম, জ্বর ও কোল্ড ডায়রিয়া নিয়ে হাসপাতালে আসছে। শিশু ও বয়স্কদের প্রতি বাড়তি সতর্কতার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শীতকালে স্বাভাবিকভাবেই ঠাণ্ডাজনিত মৌসুমি রোগব্যাধি বাড়ে। এ হাসপাতালেও রোগী আসছে। তবে সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বাড়েনি। তিনি জানান, নভেম্বরে ঠাণ্ডাজনিত রোগ নিয়ে ৩৮৮, ডিসেম্বরে ৪২৫ এবং জানুয়ারির ১২ দিনে ১৭০ শিশু ভর্তি হয়েছে। বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে আসা রোগীর অভিভাবকরা বেশির ভাগই নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সর্দি-কাশি, শাসকষ্টের কথা বলছেন। চিকিৎসকরা শারীরিক অবস্থা দেখে ভর্তি করছেন। বাকিদের চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে বাড়ি পাঠাচ্ছেন। কিছু কিছু রোগীর শারীরিক অবস্থা জটিল হওয়ায় পিআইসিইউতে রাখা হচ্ছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদ বলেন, অন্যসব হাসপাতালের মতো এ হাসপাতালে শীতকালীন রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা এখন বেশি। ঢামেকের বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে আসা শিশুদের বেশির ভাগই জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশি, নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস এবং কোল্ড ডায়রিয়ায় ভোগছে। অনেককে অবজারভেশনে রাখা হচ্ছে। জরুরি বিভাগে আসা রোগীদের পরিস্থিতি বুঝে ভর্তি এবং বহির্বিভাগের রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে পাঠানো হচ্ছে।
অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদের পরামর্শ ছয় মাসের কম বয়সি শিশুদের ঘন ঘন স্তন্যপান করানো উচিত। আর বেশি বয়সি শিশুদের বুকের দুধ ছাড়াও মৌসুমি সবজি, ফল খাওয়ানো দরকার। তিনি আরো বলেন, ঠাণ্ডা-কাশি হলেই ফার্মেসি থেকে শিশুকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো যাবে না।

২৫০ শয্যাবিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতাল শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মাহাবুবুল আলম জানান, শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে প্রতিদিনই শিশু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে স্ক্যানো রোগীদের চাপ বেশি। হাসপাতালে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঔষধ মজুদ রয়েছে। আমরা সার্বক্ষণিক তত্ত্ববাবধায়ন করছি। আর চিকিৎসার পাশাপাশি শিশুদের অভিভাবকসহ সকলকেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সচেতন থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

পাবনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আবু মো. শফিকুল হাসান বলেন, শীতের শুরু থেকে উত্তরবঙ্গের অন্যসব জেলার মতো পাবনা জেলা সদর হাসপাতালেও ঠাণ্ডাজনিত রোগী বেড়েছে। কিছুদিন ধরে শীতজনিত রোগীর চাপ বেশি। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। শিশুর ক্ষেত্রে শ্বাসতন্ত্রের তীব্র সংক্রমণ (অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন) বেশি দেখা যাচ্ছে। অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের মতো রোগীও আসছে। হাসপাতালের মেডিসিন ইউনিটে ৭২টি শয্যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি ঠাণ্ডাজনিত রোগী ভর্তি রয়েছে। যাদের বেশির ভাগের বয়স পঞ্চাশের ওপরে। অধ্যাপক ডা. আবু মো. শফিকুল হাসান আরো বলেন, ছোট-বড় সবাইকে সুস্থ রাখতে শীতের কাপড় পরতে হবে, মাথা ঢেকে রাখতে হবে। শিশুর মাথায় ঠাণ্ডা লাগানো যাবে না এবং বাড়ির বাইরে শিশুদের নিয়ে অহেতুক ঘোরাঘুরি করা যাবে না। শিশুর পাঁজরের নিচের অংশ দেবে যাওয়া, জ্বর, শ্বাস নেওয়ার সময় শব্দ, বমি, নিউমোনিয়ার এসব লক্ষণের প্রতি সতর্ক থাকতে হবে। এসব লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।

এদিকে চাঁদপুরের মতলব আইসিডিডিআরবিতে (আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আসিডিডিআরবি) রোটা ভাইরাসে (ডায়রিয়া) আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গড়ে দৈনিক ২৫০-৩০০ রোগী ভর্তি হচ্ছে। তবে অভিভাবকদের আতঙ্কিত না হয়ে রোগীদের স্থানীয় সরকারি হাসপাতাল বা মতলব হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত ডিসেম্বরে রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত ৯ হাজার ৩৩ শিশু চিকিৎসা নিয়েছে চাঁদপুরের মতলব আইসিডিডিআরবিতে। এর আগের বছর একই সময় চিকিৎসা নিয়েছিল সাত হাজার ৫৫১ শিশু। নতুন বছরের প্রথম ১০ দিনে ভর্তি হয়েছে দুই হাজার ৩৮০ শিশু। শীত মৌসুমে গড়ে দৈনিক ২৫০-৩০০ রোগী ভর্তি হচ্ছে।

চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, শরীয়তপুর ও মুন্সিগঞ্জ থেকে প্রতিনিয়ত এই হাসপাতালে ছুটে আসেন রোগীরা। তবে রোটা ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে দুই বছরের কম বয়সী শিশুরা।

গবেষণা কেন্দ্রটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রোটা ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত চাঁদপুর সদর, ফরিদগঞ্জ, কচুয়া, বরুড়া, বুড়িচং, চান্দিনা, মুরাদনগর, লক্ষ্মীপুর সদর ও চাটখিল উপজেলার শিশুরা। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে আক্রান্তের হার কমবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

সন্তানের চিকিৎসা করাতে লক্ষ্মীপুর থেকে আসা এক ব্যক্তি বলেন, শিশুর হঠাৎ বমি, জ্বর, পাতলা পায়খানা শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে স্থানীয় চিকিৎসকদের পরামর্শ নেওয়া হলেও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। পরে মতলব ডায়রিয়া হাসপাতালে নিয়ে আসি। এখন সুস্থ, বাড়ি নিয়ে যাবো।

আইসিডিডিআরবি মতলব হেলথ রিসোর্স সেন্টারের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. চন্দ্র শেখর বলেন, এ ভাইরাসে আক্রান্ত শিশুদের সুস্থ হতে ৫-৭ দিন সময় লাগে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। হেলথ রিসোর্স সেন্টারের প্রধান ডা. আলফজল খান জানান, গবেষণা কেন্দ্রটির ইতিহাসে এই প্রথমবার ডিসেম্বর মাসে সর্বাধিক রোগী ভর্তি হয়েছে, যা স্বাভাবিকের তুলনায় তিনগুণ বেশি রোগী। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত চিকিৎসক ও জনবল নিয়োগ করা হয়েছে।

তিনি আরো জানান, শীতকালে শিশুরা সাধারণত রোটা ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে থাকে। ভর্তি হওয়া ৮৫ শতাংশ রোগীই রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত। আক্রান্ত শিশুদের বুকের দুধ ও স্বাভাবিক খাবার খাওয়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

এদিকে কনকনে শীতে খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে গিয়ে ৪৪ জন দগ্ধ হয়েছে। এরমধ্যে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে রংপুরসহ আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে এসব দগ্ধ রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দু’জনের মৃত্যু হয়।

হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ দিনের ব্যবধানে (রোববার দুপুর পর্যন্ত) শীতে আগুন পোহানোসহ গরম পানি ব্যবহার করতে গিয়ে দগ্ধ হয়ে রোগী ভর্তি হন ৪৪ জন। এর মধ্যে বর্তমানে বার্ন ইউনিটে ১১ জন এবং সার্জারি, শিশু ও মহিলা ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন ৩১ জন। চিকিৎসাধীনদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু।

বরিশাল ব্যুরো জানায়, নদী বিধৌত বরিশাল বিভাগের মানুষ ঝড়তুফান মোকাবেলা করতে অভ্যস্ত হলেও এবারের হার কাঁপানো শীতে পর্যুদস্ত করে ফেলেছে পুরো জনপদকে। শীতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে শিশু বৃদ্ধরা। হাসপাতালেও ঠাণ্ডাজনিত রোগীর লম্বা লাইন।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, ঠাণ্ডাজনিত রোগে বিভাগের ছয়টি জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৮৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ডায়রিয়ায়। বিভাগে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ১৮৭ জন। নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে ৭৯ জন এবং ঠাণ্ডাজনিত অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ১২৩ জন।

ঠাণ্ডায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা। ২৪ ঘণ্টার প্রতিবেদনে এমন চিত্রই উঠে এসেছে। এরমধ্যে ডায়রিয়া আক্রান্ত ভোলায় ৫১, পটুয়াখালীতে ৪১, বরগুনায় ৪০, বরিশালে ৩২, পিরোজপুরে ২২ ও ঝালকাঠিতে ১১ জন। নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টেও সবচেয়ে বেশি পটুয়াখালীতে ৩১ জন, ভোলায় ২১, বরিশালে ১৬, পিরোজপুরে ৮ ও ঝালকাঠিতে ৩ জন। ঠাণ্ডাজনিত অন্যান্য রোগের সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত পটুয়াখালীতে ৮১ জন। ঝালকাঠিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৪ জন আর বরিশালে আক্রান্ত হয়েছেন ৮ জন।
গত ১ মাসে এই বিভাগে শীতকালীন রোগের প্রাদুর্ভাবে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬ হাজার ৩৯৩ জন।এরমধ্যে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৯৬ জন এবং নিউমোনিয়া-শ্বাসকষ্টে ভুগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ২৯৭ জন।

বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, ছয়টি জেলার সবগুলো সরকারি হাসপাতাল, সেবাকেন্দ্রে শীতকালীন রোগের গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। দিনে দিনে রোগী বাড়লেও দ্রুত সময়ে চিকিৎসা পাওয়ায় মৃত্যুর কোনো ঘটনা ঘটেনি। শীত কমতে শুরু করলে ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও কমবে।

বিভাগীয় আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক মাজহারুল ইসলাম বলেন, শনিবার বরিশালের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল রোববার তা আরো কমে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটিই এই মৌসুমে বিভাগের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। তিনি বলেন, আগামী দুই দিনের মধ্যে তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে।

স্টাফ রির্পোটার, মাদারীপুর থেকে জানান, জেলাসদরসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্স সূত্রে জানা গেছে, শীতে হাসপাতালে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিনই শিশুদের নিয়ে হাসপাতালে ভিড় করছেন স্বজনরা।

সিরাজগঞ্জ জেলা ও বেলকুচি উপজেলা সংবাদদাতা জানান, সিরাজগঞ্জে চলমান প্রচণ্ড শীতে দিন দিন বাড়ছে ঠাণ্ডাজনিত রোগ। কয়েক দিনে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক গুণ। শিশুরা কোল্ড ডাইরিয়া, নিউমোনিয়া, সর্দি-কাঁশি, জ্বর সহ ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে অভিভাবকেরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। চিকিৎসকেরা অভিভাবকদেরও সতর্ক থাকতে বলছেন।

ঠাণ্ডাজনিত রোগে সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৩০-৩৫ জন রোগী ভর্তি হচ্ছে। এদের বেশিরভাগ শিশু। পাশাপাশি নানা বয়সী নারী-পুরুষরাও ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে হাসপাতালে প্রতিদিন বাড়ছে ঠাণ্ডায় আক্রান্ত রোগীর চাপ।

হাসপাতালে ভর্তি এক শিশুর বাবা আব্দুল হালিম জানান, হঠাৎ করে ঠাণ্ডা বেশি পড়ায় তার বাচ্চার ডায়রিয়া শুরু হয়। পরে সদর হাসপাতালে এনে ভর্তি করানো হয়। এখন সুস্থ মনে হচ্ছে। রায়গঞ্জ উপজেলা থেকে আসা আরেক শিশুর অভিভাবক আমজাদ হোসেন জানান, অতিরিক্ত শীতের কারণে তার সন্তানের নিউমোনিয়া হয়েছে। সেজন্য এসেছেন এই হাসপাতালে।

২৫০ শয্যাবিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতাল আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. ফরিদুল ইসলাম বলেন, ঠাণ্ডাজনিত কারণে আগের তুলনায় হাসপাতালে রোগীর চাপ অনেকটাই বেড়ে গেছে। রোগীর সেবায় ডাক্তার ও নার্স সার্বক্ষণিকভাবে সেবা দিয়ে চলেছে।

২৫০ শয্যাবিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. রতন কুমার রায় জানান, গত ১ সপ্তাহে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ঠাণ্ডা রোগীদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যাই বেশি। তিনি এ ব্যাপারে শিশুদের মায়ের বুকের দুধ খাওনোর পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন।

এদিকে বেলকুচি উপজেলা সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্মকর্তা মোফাখখারুল ইসলাম বলেন, শীতের মাঝামাঝিতে শীতজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছিল, এখন একটু কম। তবে শিশু ও বৃদ্ধরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। রোগীর চাপ থাকলেও হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামে তাপমাত্রার পারদ ৯ থেকে ১৩ ডিগ্রীর মধ্যে উঠানামা করলেও কমেনি শীতের তীব্রতা। একেবারে জুবুথুবু অবস্থা। শীত ও ঠাণ্ডার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হাসপাতালে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা। আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্কারা। হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন বাড়ছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা। গত ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে ৩১ শিশু। সবমিলিয়ে হাসপাতালটিতে ৭২ জন শিশু ভর্তি রয়েছে। এর মধ্যে ডাইরিয়া ওয়ার্ডের ১২ শর্য্যার বিপরীতে ভর্তি আছে ৫৭ জন শিশু।

কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, এ জেলাটি হিমালয়ের কাছে অবস্থান হওয়ায় এখানে ঠাণ্ডার প্রকোপটা একটু বেশি। হাসপাতালে যারা চিকিৎসা নিতে আসছেন অধিকাংশই চরাঞ্চলের মানুষ। ডায়েরিয়া নিউমোনিয়া শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন শীতজনিত রোগীর সংখ্যা হাসপাতালে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশু, নারী ও বৃদ্ধরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।

কুড়িগ্রামের রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, গতকাল রোববার ভোরে কুড়িগ্রামে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। সকাল ৭টায় তা দাঁড়ায় ১১ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। তাপমাত্রা এভাবে উঠানামা করছে। তাপমাত্রা আরো কয়েক দিন এমন থাকবে। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে এ মাসে একটি শৈত্যপ্রবাহ এ জেলার উপর দিয়ে বয়ে যেতে পারে।

ফরিদপুর জেলা ও সালথা সংবাদদাতা জানান, ফরিদপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।
জানা গেছে, গত কয়েকদিন ধরেই জেলাটিতে তীব্র শীত ও ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। গত চারদিন ধরে অধিকাংশ সময়ই আকাশ থাকছে মেঘাচ্ছন্ন। একই সঙ্গে গতকাল রোববার ভোর থেকে ঘন কুয়াশা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মতো পড়ছে।

নওগাঁ জেলা সংবাদদাতা জানান, নওগাঁর উপর দিযে বয়ে যাচ্ছে মৃদু শৈতপ্রবাহ। গত দুই সপ্তাহ যাবত নওগাঁর তাপমাত্রা ৮ থেকে ১৪ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করছে। বিশেষ করে গত সোমবার থেকে নওগাঁর তাপমাত্রা নতুন করে কমতে শুরু করায় কনকনে হাঁড় কাঁপানো শীতে কাহিল হয়ে পড়েছে শীতার্ত মানুষরা।

দুমকী (পটুয়াখালী) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, দুমকী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মীর শহিদুল হাসান শাহীন বলেন, অতিরিক্ত শীতের কারণে শিশু ও বৃদ্ধ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সর্দি, কাশি, এ্যাজমা, নিউমোনিয়ায়, টাইফয়েড ও লান্সের ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

হিলি (দিনাজপুর) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, দিনাজপুরের হিলিতে প্রচণ্ড শীতের কারণে হাসপাতালে বেড়েছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা। প্রতিদিন হাসপাতলে ভর্তি হচ্ছেন সর্দি, কাশি, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীরা। হাকিমপুর হাসপাতালে ভর্তি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, গত শনিবার বিকেল থেকে শীতের কারণে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছি। তাই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে রয়েছি।
হাকিমপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মশিউর রহমান জানান, এই সময়টায় অতিরিক্ত শীতের কারণে সর্দি, কাশি, ডায়রিয়া, মাথা ব্যাথাসহ বিভিন্ন রোগে দেখা দেয়। তাই সকলকে সতর্ক হয়ে চলার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি যারা হাসপাতালে ভর্তি আছেন তাদের ওষুধসহ সবধরনের সহায়তা দেয়া হচ্ছে।

রংপুর : তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশায় উষ্ণতা পেতে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল রোববার সকালে হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে মারা যান ওই নারী। মৃত নাসরিন বেগম রংপুর নগরের তাজহাট এলাকার বাসিন্দা।

এর আগের দিন গত শনিবার সকালে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার বাসিন্দা আমেনা বেগম সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি উপজেলার গোয়ালু গ্রামের মৃত জালাল উদ্দিনের স্ত্রী।

২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে অগ্নিদগ্ধ দু’জন রোগীর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আ. ম. আখতারুজ্জামান। বর্তমানে হাসপাতালের বার্ন ইউনিট এবং সার্জারি, শিশু ও মহিলা ওয়ার্ডে ৪২ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
জানা গেছে, কনকনে শীতে খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে গিয়ে ৪৪ জন দগ্ধ রোগীর মধ্যে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে রংপুরসহ আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে এসব দগ্ধ রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দু’জনের মৃত্যু হয়েছে।

হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ দিনের ব্যবধানে (রোববার দুপুর পর্যন্ত) শীতে আগুন পোহানোসহ গরম পানি ব্যবহার করতে গিয়ে দগ্ধ হয়ে রোগী ভর্তি হন ৪৪ জন। এর মধ্যে বর্তমানে বার্ন ইউনিটে ১১ জন এবং সার্জারি, শিশু ও মহিলা ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন ৩১ জন। চিকিৎসাধীনদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু।

বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চিকিৎসক ফারুক আলম জানান, চিকিৎসাধীন রোগীদের শরীরের ১০ থেকে ৪৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। অল্প কয়েক দিন হলো এ অঞ্চলে কনকনে শীত পড়েছে। শীত থেকে রেহাই পেতে গ্রামাঞ্চলের মানুষজন খড়কুটোয় আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করেন। সেই সঙ্গে গরম পানির ব্যবহারও বেড়ে যায়। অসাবধানতার কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। দগ্ধ রোগীদের সাধ্যমতো চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আ. ম. আখতারুজ্জামান জানান, অগ্নিদগ্ধ হয়ে বর্তমানে মোট ৪২ রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু। ২৪ ঘণ্টায় দুজন নারীর মৃত্যু হয়েছে। প্রতি শীত মৌসুমে এ রকম অগ্নিদগ্ধের ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো দরকার।

https://dailyinqilab.com/national/article/631707