১৫ জানুয়ারি ২০২৪, সোমবার, ৩:১৯

জ্বালানি সঙ্কট উৎপাদন ব্যাহত

 

দেশে গ্যাসের তীব্র সঙ্কট চলছে। এই সঙ্কটে সবচেয়ে বেশি ধুঁকছে শিল্পখাত। থমকে গেছে উৎপাদনের চাকা। চড়া দামে বিকল্প জ্বালানি কিনে উৎপাদন ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন গ্যাস ও জ্বালানি নির্ভর রফতানিমুখী শিল্পের মালিকেরা। বিশেষ করে বস্ত্র, ইস্পাত ও তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদনে ধস নেমেছে। গ্যাসের অভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। তাতে শীতেও লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। সেচের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে বোরোর আবাদ। সামনে গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুৎ সঙ্কট চরমে উঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সিএনজি ফিলিং স্টেশনে গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে। গ্যাস না পেয়ে যানবাহন অলস বসে থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবহনখাত। আবাসিক গ্রাহকেরা পর্যাপ্ত গ্যাস পাচ্ছেন না। জ্বলছে না রান্নার চুলা, ঘরে ঘরে হাহাকার। জনজীবনে নেমে এসেছে সীমাহীন দুর্ভোগ। গ্যাস, বিদ্যুৎসহ জ্বালানির অভাবে বিদ্যমান কারখানায় নতুন ইউনিট খোলা যাচ্ছে না। দেশি-বিদেশি নতুন বিনিয়োগও থমকে গেছে। এতে কর্মসংস্থানের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে, বাড়ছে বেকারত্ব। নীরবেই অর্থনীতির গতি কমিয়ে দিচ্ছে তীব্র গ্যাস, জ্বালানি সঙ্কট।

শীতে একদিকে দেশে গ্যাসের চাহিদা বেড়েছে। অন্যদিকে প্রাকৃতিক গ্যাস ক্ষেত্রে কমেছে গ্যাসের উৎপাদন। আবার ডলার সঙ্কটের কারণে এলএনজি আমদানিও নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। গ্যাসের বিকল্প হিসেবে ডিজেল, ফার্নেস অয়েলের মতো জ্বালানির চাহিদা বেড়েছে। তবে ডলার সঙ্কটে রির্জাভ ধরে রাখতে আমদানি কমিয়ে দেওয়ায় এসব জ্বালানিরও সঙ্কট বাড়ছে। পাইপ লাইনেও এলএনজি, ডিজেলসহ নেই পর্যাপ্ত জ্বালানি। ফলে পরিস্থিতি দিনে দিনে আরও নাজুক হচ্ছে। জ্বালানিখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ মুহূর্তে গ্যাস সঙ্কট নিরসনে এলএনজি আমদানি বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু ডলার সঙ্কট আর রিজার্ভের পতন ঠেকাতে আমদানি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে অনিশ্চিয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের সার্বিক জ্বালানি নিরাপত্তা। এতে করে পবিত্র মাহে রমজানে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সঙ্কট বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

চট্টগ্রামে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এক সময় পাওয়া যেত সর্বোচ্চ ৩১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এখন গড়ে প্রতিদিন সরবরাহ মিলছে ২৬০ থেকে ২৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। গত অক্টোবরের শেষ দিক থেকে গ্যাসের তীব্র সঙ্কট চলছে। জানা গেছে, ডলার সঙ্কটের কারণে এলএনজি আমদানি কমিয়ে দেওয়ায় চট্টগ্রামসহ সারা দেশে গ্যাসের সরবরাহ আরো কমেছে। কয়েক মাস আগেও ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি এলএনজি আমদানি করা হতো। এসব গ্যাস কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে দুটি এলএনজি স্টেশনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হতো। দুটি টার্মিনালের মধ্যে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলেটরের টার্মিনালটি মেরামতের জন্য বন্ধ আছে। এটির সবরাহ ক্ষমতা ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। সেখানে সচল টার্মিনাল দিয়ে এখন এলএনজি সরবরাহ চলছে। তবে এলএনজি টার্মিনালের দায়িত্বে থাকা পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা এলএনজি আমদানি স্বাভাবিক আছে উল্লেখ করে গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, একটি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় সরবরাহে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। চালু টার্মিনালেরও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হচ্ছে।

কর্ণফুলী গ্যাস সরবরাহ কোম্পানির একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আগামী ১৭ জানুয়ারি নাগাদ টার্মিনালটি মেরামত শেষে সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে আসবে। এরপর অন্য টার্মিনালটি বার্ষিক মেরামতের জন্য বন্ধ রাখা হবে। ফলে এটির মেরামত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আগামী দুই থেকে আড়াই মাস গ্যাসের এই সঙ্কট চলবে। তিনি বলেন, সরবরাহ কমেছে, আবার শীতের কারণে গ্যাসের চাপও কমে গেছে। ফলে সঙ্কট তীব্র হয়ে উঠেছে।

গ্যাস সবরাহ কমে যাওয়ায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সারকারখানাগুলো সরবরাহ কমে গেছে। অনেকটা রেশনিং করে গ্যাস সরবরাহ দিতে হচ্ছে। এখানে কর্ণফুলি গ্যাসের মোট গ্রাহক ও সংযোগ আছে ছয় লাখ এক হাজার ৯১৪টি। এর মধ্যে গৃহস্থালি সংযোগ পাঁচ লাখ ৯৭ হাজার ৫৬১টি। অথচ চাহিদার বিপরীতে অর্ধেকের কিছু বেশি ২৮০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ মিলছে। এর মধ্যে দুটি সার কারখানায় দেওয়া হচ্ছে ৯০ মিলিয়ন ঘনফুট, তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৩৭ মিলিয়ন ঘনফুট এবং সিএনজি ফিলিং স্টেশনে ১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বাকি গ্যাস আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহকের দেওয়া হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ব চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড-সিইউএফএল ও বহুজাতিক সার কারখানা কাফকোর উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। তাতে দেশে সারের সঙ্কটেরও আশঙ্কা করা হচ্ছে। ডলার সঙ্কটের কারণে আমদানির বদলে দেশে সারের উৎপাদন বৃদ্ধির যে পরিকল্পনা সেটাও গ্যাস সঙ্কটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

গ্যাসের অভাবে বেশি সঙ্কটে পড়েছে ইস্পাত কারখানাগুলো। এসব কারখানার উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিএসআরএম’র কর্মকর্তা তপন সেন বলেন, কারখানায় দৈনিক চাহিদার চেয়ে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ কম গ্যাস সরবরাহ মিলছে। উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করতে হচ্ছে। তাতে উৎপাদন খরচ আড়াই থেকে তিনগুণ বাড়ছে। টনপ্রতি উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে প্রায় এক হাজার টাকা। ইস্পাত খাতের প্রায় সব কারখানার চিত্র এখন এমন। উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তা পর্যায়ে এসব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।

শিল্প মালিকেরা বলছেন, গ্যাসের বিকল্প জ্বালানি পেতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ আমদানি কমে যাওয়ায় ডিজেল, ফার্নেস অয়েলের সঙ্কট রয়েছে। তবে দেশের একমাত্র জ্বালানি তেল শোধনাগার ইস্টার্ণ রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. লোকমান বলেন, অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের যোগান এবং পরিশোধন স্বাভাবিক আছে। গ্যাসের অভাবে রাউজান তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি এবং শিকলবাহার একটি কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। এতে করে শীতেও বিদ্যুৎ সঙ্কট চলছে। চলছে বোরোর আবাদ, বিদ্যুতের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে সেচ কার্যক্রম। পিডিবি চট্টগ্রামের প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম বলেন, গ্যাস সরবরাহ পেলে গ্যাস নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু রাখা হয়। তবে এখন শীতের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কমে যাওয়ায় তেমন সমস্যা হচ্ছে না। গ্রীষ্মের আগে এসব কেন্দ্র চালু করতে হবে।

গ্যাস সঙ্কট শতভাগ তৈরি পোশাক খাতের জন্য মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে। পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, গ্যাস সঙ্কটে নীটওয়্যারসহ তৈরি পোশাক খাত চরম সঙ্কটে পড়েছে। এমনিতে আমেরিকা, ইউরোপসহ বিশে^র বাজারে পোশাকের চাহিদা অব্যাহতভাবে কমছে। এই অবস্থায় জ্বালানি সঙ্কট এ খাতকে খাদের কিনারে নিয়ে গেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে জ্বালানি নিশ্চিয়তার কোন বিকল্প নেই। সেই সাথে জ্বালানির দামও সমন্বয় করা জরুরি। চট্টগ্রামে গ্যাসের সঙ্কট সমাধানে তিনি সরকারের তড়িৎ পদক্ষেপ কামনা করেন।

গ্যাসের অভাবে রান্নার চুলা জ্বালাতে না পেরে আবাসিক গ্রাহকেরা পড়েছেন বেশি ভোগান্তিতে। নগরীর অনেক এলাকায় দিনের বেলায় গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। পাইপলাইনে গ্যাস না থাকায় গ্রাহকদের বাধ্য হয়ে এলপিজি সিলিন্ডার, ইলেকট্রিক চুলা ও লাকড়ির চুলা ব্যবহার করতে হচ্ছে। হোটেল, রেস্তোরাঁ, ছাত্রাবাস, হাসপাতাল, এতিম খানার রান্নাবান্নাও বিঘ্নিত হচ্ছে। নগরীর সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোতে যানবাহনের দীর্ঘ লাইন। গ্যাসের অভাবে অনেক গণপরিবহন রাস্তায় নামছে না। তাতে নগরীতে গণপরিবহন সঙ্কট বেড়েছে। এই সুযোগে বাড়ছে পরিবহন ভাড়া।

গ্যাস সঙ্কটে একদিকে বিদ্যমান কল-কারখানায় উৎপদন থমকে যাওয়ায় লাখো শ্রমিক বেকার হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অন্যদিকে নতুন কর্মসংসস্থানও হচ্ছে না। তাতে বেকারত্ব বাড়ছে। সরকার দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আর্কষণে একাধিক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে জ্বালানি সঙ্কটের কারণে সেখানেও বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে। অনেক কারখানা চালুর সব আয়োজন শেষ করেও জ্বালানির অভাবে উৎপাদনে যেতে পারছে না।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের (চুয়েট) পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসলাম মিয়া বলেন, শিল্পায়নের প্রধান নিয়ামক নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি। জ্বালানি নিশ্চিয়তা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হবে না। গ্যাসের যে সঙ্কট তা নিরসনের দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনের পাশাপাশি এলএনজি আমদানির কোন বিকল্প নেই।

ক্যাবের সহ-সভাপতি কে এম নাজের হোসাইন বলেন, অতিরিক্ত দাম দিয়েও আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহকেরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছেন না। এতে জনজীবন ব্যাহত হচ্ছে, চট্টগ্রামের শিল্প উৎপাদন স্থবির হয়ে পড়েছে। একসময় জাতীয় গ্রীড থেকে চট্টগ্রামে সরবরাহ দেওয়া হতো। কিন্তু চট্টগ্রাম এখন শুধুমাত্র এলএনজি নির্ভর। চট্টগ্রামের জন্য বরাদ্দ গ্যাস নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মেঘনাঘাটায় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে। একে চট্টগ্রামের প্রতি বঞ্চণা এবং বৈষম্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানকার শিল্প কারখানা ও নতুন বিনিয়োগের স্বার্থে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক করা জরুরি।

https://dailyinqilab.com/national/article/631722