১৫ জানুয়ারি ২০২৪, সোমবার, ৩:১১

অধিক সম্পদ অর্জনের প্রেরণা ও প্রযত্ন

-ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

 

কারো কারো অধিকতর সম্পদশালী ওরফে ধনী হওয়ার প্রবণতা উদ্বেগ উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে রয়েছে। ১৯৪৩-এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের প্রাক্কালে যেসব প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছিল তার প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি শুধু বাংলাদেশে নয় অনেক অর্থনীতিতেও, ১৯৩০ সালের গ্রেট ডিপ্রেশন কিংবা নিকট অতীতে ১৯৯৭ সালের এশীয় ক্রাইসিস এবং ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার কারণ ও প্রভাবের ভূত দেখা যাচ্ছে সেই ১৮-১৯ থেকে। বোঝা যায়, করোনা কিংবা ক্রেমলিন-কিয়েভ বাংলাদেশের কতিপয়ের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার পথ রুদ্ধ করতে পারেনি। এ কারণে এ সময়ে সমাজে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা আনয়নে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে অধিষ্ঠিত কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্বপালনে অর্পিত ক্ষমতা প্রয়োগে প্রতিশ্রুতি ও দৃঢ়চিত্ত হওয়ার প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গটিও উঠে আসছে। নিজেদের অধিক্ষেত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে আদিষ্ট হয়ে যদি তাদের কর্মধারা পরিচালিত হয়; সে ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠান কার্যকরভাবে জবাবদিহিমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচার ও স্বচ্ছতার অভাবে আকীর্ণ হয়ে উঠতে পারে, স্বেচ্ছাচারিতার অজুহাত যৌক্তিকতা এমনকি স্বজনপ্রীতির পরিবেশ বা ক্ষেত্র তৈরি হয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এটি প্রধান অন্তরায়।

 

যারা নীতি প্রণয়ন করেন, নীতি উপস্থাপন করেন তাদের প্রত্যেকের দৃঢ়চিত্ত এবং নীতি-নিয়ম পদ্ধতির প্রতি দায়িত্বশীল থাকা আবশ্যক। সুশাসন, স্বচ্ছতা-জবাবদিহি প্রয়োজন সবার স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে। এটি পরস্পরের পরিপূরক। আরেকটি বিষয় নীতিনির্ধারকরা বাস্তবায়নকারীদের দিয়ে, তাদের ভুল বা ব্যত্যয়ধর্মী নীতি বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করিয়ে নিতে চাপ সৃষ্টি কিংবা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের নানা সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিয়ে প্রলুব্ধ করতে পারেন, তাদের স্বার্থ উদ্ধার করিয়ে নিয়ে আবার ক্ষেত্রেবিশেষে ষড়যন্ত্রের টোপে ফেলে বিব্রতও করতে পারেন। কায়েমি স্বার্থ উদ্ধারে এ ধরনের ‘রাজনৈতিক’ উৎকোচ কিংবা নিপীড়নের প্রথা প্রাচীনকাল থেকে কমবেশি ছিল বা আছে, তবে তা মাত্রা অতিক্রমণের ফলে সেটি প্রকারান্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক পরিস্থিতির প্রতিবন্ধকতা হিসেবে প্রতিভাত হয়ে থাকে। যেকোনো সমাজে বা অর্থনীতিতে কতিপয়ের অস্বাভাবিক অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ ও প্রযত্ন প্রদান বৈষম্য বৃদ্ধির অন্যতম উপসর্গ। আর এ বৈষম্য বৃদ্ধিতে নানা আত্মঘাতী প্রবণতার প্রবৃদ্ধি ঘটে।

নানা আঙ্গিকে পরীক্ষা-পর্যালোচনায় দেখা যায়, শিক্ষক-চিকিৎসক-আইনজীবী-ব্যবসায়ী এমনকি চাকরিজীবীদেরও বাঞ্ছিতভাবে জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হয় না। অতিমাত্রায় কোটারি, সিন্ডিকেট বা দলীয় বা রাজনীতিকীকরণে পেশাজীবী, সংস্থা সংগঠন এবং এমনকি সুশীল সেবকদের প্রজাতন্ত্রের হয়ে দলনিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে হিমশিম খেতে হয়, গলদঘর্ম হতে হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে এমন একটা পরিবেশ তৈরি হয় যার ছত্রছায়ায় নানাভাবে অবৈধ উপার্জন চলতে এর পথ সুগম হতে পারে। সেবক প্রভুতে পরিণত হলে সম্পদ আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহারে অর্জিত অর্থ দখলের লড়াইয়ে অর্থায়িত হয়ে এভাবে একটা ঘূর্ণায়মান দুষ্টচক্র বলয় হয়ে থাকে। অর্থাৎ সুশাসনের অভাবে স্বচ্ছতার অস্বচ্ছতায় ঘুরে-ফিরে পুরো প্রক্রিয়া বিষিয়ে তোলে। সুতরাং সবক্ষেত্রে সর্বাগ্রে উচিত স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করা। এটি প্রয়োজন গণতন্ত্র ও সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সুশাসন স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে কোনো উন্নয়ন টেকসই হবে না। এটি পরস্পরের পরিপূরক। স্বচ্ছতার অস্বচ্ছতায় যে উন্নয়ন হয় তাতে জনগণের সুফল নিশ্চিত হয় না। এ উন্নয়নের কোনো উপযোগিতা নেই। এটি এক ধরনের আত্মঘাতী অবয়ব। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনো কাজ শেষ করার কথা এবং বরাদ্দ সেভাবে দেয়া আছে। কিন্তু সেই কাজ শেষ করতে যদি বছরের পর বছর সময় লেগে যায়, দ্রব্যমূল্য ও নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে ও অজুহাতে যদি তিন-চার গুণ টাকা খরচ করতে হয়- সেটি সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির দুর্বল পরিস্থিতির পরিচায়ক। আলোচ্য অর্থ দিয়ে একই সময়ে হয়তো আরো অতিরিক্ত দু’টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেত। সময়ানুগ না হওয়া এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে তিন প্রকল্পের অর্থ খরচ করে একটি বাস্তবায়ন করা হলো। বলাবহুল্য অবকাঠামোটি যথাসময়ে নির্মিত হলে সংশ্লিষ্ট খাতে সক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে উপযোগিতা সৃষ্টি হয়ে জিডিপিতে অবদান রাখতে পারত।

সব চাইতে উদ্বেগের বিষয় অধিকতর ও অতিরিক্ত ব্যয়ের টাকা বেহাত হওয়া, এমন হাতে যাওয়া যারা সুশাসন ও জবাবদিহির পরিস্থিতি সৃষ্টিকে অসম্ভব করে তুলতে ওই অর্থ ব্যয় করে থাকে। অধিকতর ধনীরা নীতি-নৈতিকতা ন্যায়-নীতির নির্ভরতার পরিবেশকে কলুষিত করে পুরো সমাজ ও অর্থনীতিকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়।

জিডিপি প্রবৃদ্ধির মূল কথা হলো, যে অর্থ ব্যয় করা হোক না কেন, ওই আয়-ব্যয় বা ব্যবহারে অবশ্য পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হতে হবে। পণ্য ও সেবা উৎপাদনের লক্ষ্যে যে অর্থ আয় বা ব্যয় হবে তা-ই বৈধ। আর যে আয়-ব্যয় কোনো পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে না- সেটি অবৈধ, অপব্যয়, অপচয়। জিডিপিতে এর থাকে না কোনো ভূমিকা। আরো খোলাসা করে বলা যায়, যে আয় পণ্য ও সেবা উৎপাদনের মাধ্যমে অর্জিত হয় না এবং যে ব্যয়ের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হয় না; সে আয়-ব্যয় জিডিপিতে কোনো অবদান রাখে না। এভাবে যে অর্থ আয় বা খরচ করা হয়, তা প্রকারান্তরে অর্থনীতিকে পঙ্গু ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে।

সাম্প্রতিক সময়ের আলোচ্য বিষয়, বিগত বাজেটগুলোতে বিনা ব্যাখ্যায় স্বল্প করারোপে কালো টাকা সাদা করার সুবিধা দেয়া এবং বিদেশে অর্থপাচার বৃদ্ধির প্রসঙ্গে অধিকতর ধনী হওয়ার আনন্দ বিষাদের প্যাথোলজিক্যাল প্রতিবেদন দৃষ্টিসীমায় আসছে। সঙ্গত কারণে এটি উঠে আসছে যে দুর্নীতিজাত কালো টাকা লালন থেকে; তা থেকে সরে না এলে আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য বাড়তে থাকবে। করোনা, যুদ্ধ-বিগ্রহ কিংবা গণতন্ত্রের কফিনে পেরেক মারার এ বৈশি^ক পরিবেশে, এ সম্মোহিত সময়ে, দেশে দেশে জীবন ও জীবিকার সংগ্রাম সন্ধিক্ষণে আর্থ-সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতিতে যে উদগ্র উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে এবং আসন্ন মন্দায় মানবিক বিপর্যয়ের যে ইশারা বা লক্ষণ দেখা দিচ্ছে ওই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আয়-বৈষম্যের উপসর্গটি বিষফোঁড়ায় যেন পরিণত না হয় সে প্রত্যাশা প্রবল হওয়া স্বাভাবিক। প্রকৃতির প্রতিশোধ প্রতিক্রিয়ায় মানবভাগ্যে মহাদুর্যোগ ও বিপর্যয় আসে ঠিক; তবে তা প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ নিরাময়ের নামে মনুষ্যসৃষ্ট রাজনৈতিক অর্থনীতির সমস্যার ঘৃতে অগ্নিসংযোগের শামিল হয়ে দাঁড়ায়।

সাম্প্রতিক সময়ে আবার অন্য অনেক ক্ষেত্রে (অধিকাংশ অনুৎপাদনশীল খাতে) কর্মকাণ্ড বাড়ছে। যা দেখে সংবাদমাধ্যমের মনে হয়েছে, অর্থনীতিতে গতিশীলতা এসেছে। মনে হয়েছে কর্মচাঞ্চল্য বেড়েছে মানুষের মধ্যে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে আবহমান উৎসবে মানুষের অংশগ্রহণের মাত্রা বাজারে বৈকি, সুতরাং স্বাভাবিকভাবে সে চাঞ্চল্যে নিতান্ত নানাবিধ ব্যয়ের উৎসবে মাতামাতি বেড়েছে। কিন্তু পণ্য ও সেবা উৎপাদনে অগ্রগতি চাহিদা অনুযায়ী না বাড়ায় সরবরাহে কিছু ক্ষেত্রে বড় বৈসাদৃশ্য ও বেমানান বাড়াবাড়িতে সমাজ ও অর্থনীতির দৈন্য ও দুর্দশা ফুটে উঠেছে। এ অবস্থায় সমাজে আর্থিক বৈষম্যের বিবর আরো বেদনাদায়কভাবে উন্মোচিত হতে চলেছে।

প্রভূত পরিসংখ্যান, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও পটভূমিতে আজ এটি স্পষ্ট হচ্ছে যে, বৈষম্য বাড়ছে অনেক ক্ষেত্রে-সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের ও নাগরিকের মধ্যে, করদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে, শিল্পমালিক ও শ্রমিকের মধ্যে, নীতিনির্ধারকের সাথে পোষণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে, উৎপাদনকারীর সাথে খুচরা ক্রেতার, ব্যাংকের আমানতকারীদের সাথে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার, সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় প্রত্যাশার সাথে আর্থিক খরচে কর্মনৈপুণ্যের, রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনার সাথে ব্যয় ব্যবস্থাপনার, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর সাথে সাধারণ মানুষের। সমাজে অর্থ ক্ষেত্রে অপব্যয়ের জৌলুশের চাকচিক্যের ডামাডোলকে মনে হতে পারে এটি পুঁজিবাদী মানসিকতা প্রস্তুত এবং বৈষম্যবিলাসী উদাসীন ঊর্ধ্বতনদের ইচ্ছা ও অভিলাষ উৎসারিত। এ অগ্রগতি গুণগতমান উন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার পাসের হার বৃদ্ধির মতো সাময়িক তৃপ্তিলাভের অগ্রগতি মনে হতে পারে-ভূতভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত করে নয়-সাময়িকভাবে, নিজেদের মতো করে অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সীমিতভাবে সীমাবদ্ধকরণের প্রয়াস উৎসারিত। অর্থনৈতিক বৈষম্য বিভাজন থেকে মুক্তির সংগ্রামে জয়ী একটি স্বাধীন সার্বভৌম অর্থনীতির প্রাণবায়ু যে জবাবদিহি, স্বচ্ছতা ও ন্যায়নীতিনির্ভর, নৈতিক মনোবল ও মূল্যবোধ তার সার্বিক অবস্থান ও উপস্থিতি আপাত প্রাণচাঞ্চল্যে ফিরে আসা অবয়বে উৎসাহিতবোধ করা চলে না। সেগুলো ক্রমশ নির্বাসনে পাঠিয়ে সাময়িক এ প্রগলভতায় সমাজ প্রকৃতপক্ষে এগুচ্ছে না পেছাচ্ছে তার একটা সালতামামি প্রয়োজন। সালতামামি প্রয়োজন দুই হাজার চব্বিশের শুরুর সময়ে। কে কাকে কেন কিভাবে মোকাবেলা করবেন, তা দেখার অপেক্ষায় পুরো জাতি দেশ ও অর্থনীতি।
লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক

 

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/806390