১৪ জানুয়ারি ২০২৪, রবিবার, ৪:০২

অব্যবস্থাপনায় ধ্বংস হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদ

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন’র (বিএফডিসি) অব্যবস্থাপনায় ধ্বংস হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলাধার ও দেশের মিঠাপানির অন্যতম প্রধান মৎস্য উৎপাদনস্থল রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ। এ হ্রদ দেশের বদ্ধ জলাশয়সমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং মিঠাপানির মাছের ভান্ডার হিসেবে পরিচিত। ওই হ্রদের আয়তন ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর এবং এর জলায়তন ৫৮ হাজার হেক্টর যা অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের প্রায় ১৯ শতাংশ।

অভিযোগ ওঠেছে, কাপ্তাই হ্রদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বিএফডিসি রাঙামাটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে হ্রদটি আজ ধ্বংসের পথে। যদিও এই নিয়ে টু-শব্দ করার সাহস পান না কেউই। 

বিএফডিসি কর্তৃপক্ষ বলছে, সেখানে কোনো অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা হয়নি। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। মৎস্য উৎপাদন কমেনি বরং বেড়েছে। মৎস্য উৎপাদন আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। 

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, বিলুপ্তির পথে থাকা মাছগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হ্রদ খননসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে গত কয়েক বছর ধরে সরকারকে সুপারিশ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। সেই সুপারিশ বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

বিএফআরআই’র গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ছোট মাছের উৎপাদন বাড়লেও বিপরীতে কমছে কার্প জাতীয় মাছ। বিএফডিসি’র তথ্য মতে, ১৯৬৫ সালে কাপ্তাই হ্রদ থেকে বাণিজ্যিকভাবে মাছ আহরণ শুরু হয়। ১৯৬৫-৬৬ অর্থ বছরে আহরিত মাছের মধ্যে ৮১ ভাগ ছিল কার্প জাতীয় আর ১৯ ভাগ ছিল ছোট মাছ। বর্তমানে এ কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন কমে দাঁড়িয়েছে ৫ ভাগে। আর ছোট মাছের উৎপাদন ৯৫ ভাগ। ক্রমান্বয়ে ছোট মাছ বাড়ছে আর কার্প জাতীয় মাছ কমছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ভাষ্য, চলতি মৌসুমে পানি বেশি থাকার কারণে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে বেশ ভালোই মাছ বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে রাঙামাটি সদর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে আহরিত মাছ থেকে বিগত বছরগুলোর তুলনায় কয়েকগুণ বেশি রাজস্ব আয় করেছে। লংগদু, মহালছড়ি ও কাপ্তাই উপজেলাধীন কাপ্তাই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রেও একইভাবে রাজস্ব আয় হওয়ার কথা। তবে রহস্যজনক কারণে বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবছর কাগজে-কলমে রাজস্ব কমেছে এই তিন মৎস্য অবতরণ ও বিপনন কেন্দ্রে।

তাদের অভিযোগ, বিএফডিসির ব্যবস্থাপক রাঙামাটি সদর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা কমিটি করে দিয়েছেন। যার কারণে এই কেন্দ্রে সকল প্রকার আয়-ব্যয় হিসাব যথাযথভাবে লিপিবব্ধ হওয়ার কারণে সরকারি কোষাগারে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব জমা হয়েছে। তবে রহস্যজনক কারণে লংগদু, মহালছড়ি ও কাপ্তাই উপজেলাধীন মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে কোনো কমিটি করা হয়নি। এই সুযোগে আহরিত মাছ থেকে আদায়কৃত রাজস্বের অর্থ নয়-ছয়ে চলে গেছে বিভিন্ন জনের পকেটে।

সূত্রে জানায়, হ্রদের মাছ থেকে রাজস্ব আদায় করে বিএফডিসি। বিএফডিসি বর্তমানে যে মাছ থেকে রাজস্ব আদায় করছে তার ৯২ ভাগই হল ছোট মাছ। যেগুলো কেচকি, চাপিলা ও মলা মাছ। 

এক সময় মৎস্য সম্পদে ভরপুর পার্বত্য রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদের বড় বড় মাছ আকৃষ্ট করতো সবাইকে। কিন্তু সেসব এখন কেবলই পুস্তিকায় লিপিবব্ধ গল্প। আগের মতো কার্প জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন হচ্ছে না। হ্রদে নষ্ট হয়ে গেছে কার্প জাতীয় মাছের প্রজনন ক্ষেত্রগুলোর অধিকাংশই। এ হ্রদে প্রাকৃতিকভাবে প্রজনন হতো এমন অনেক প্রজাতির মিটাপানির মাছের বিলুপ্তি ঘটছে। আর তা আহরণের মধ্য দিয়ে সরকারি কোষাগারে জমা হত কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। যদিও প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে কার্প জাতীয় মাছের পোনা ছাড়ছে বিএফডিসি কর্তৃপক্ষ। তবে সেই রাজস্ব আয় আর নেই! 

কাপ্তাই হ্রদ মৎস উন্নয়ন ও বিপনন কেন্দ্রের সরকারি গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার হচ্ছে চট্টগ্রামে। পছন্দের লোককে দেওয়া হয় পদায়ন-পদোন্নতি বা সংযুক্তিতে বদলী। রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় দিবসগুলোতে সরকারি কর্মসূচিতে (অনুষ্ঠানে) কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতি। এমন সব অনিয়ম ও সেচ্ছাচারিতার কারণে সংস্থাটি ভেতরে ও বাহিরে নানান সমস্যায়  জর্জরিত। অন্যদিকে রহস্যজনক কারণে দিন-দিন বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

এ বিষয়ে জানতে বিএফডিসি রাঙামাটির ব্যবস্থাপক মো. আশরাফুল আলম ভূঁইয়া দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, তিনি যোগদান করার পর থেকে মৎস্য উৎপাদন বেড়েছে। উৎপাদন আরও বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য জোর প্রচেষ্টা করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।

তিনি আরও বলেন, ২০২১-২২ অর্থ বছরে রাজস্ব আয় হয়েছে ৭ কোটি ৯২ লাখ ৫০ হাজার ২৯৭ টাকা। পরের অর্থ বছর আয় হয়েছে ৯ কোটি ১৫ লাখ ১ হাজার ৫৬০টাকা। চলতি অর্থ বছরে আয় হয়েছে ১১ কোটি ৬৯ লাখ ২৮ হাজার ৮১৪ টাকা। তিনি প্রশ্ন করেন; এতে বেড়েছে নাকি কমেছে ? 

https://www.dailysangram.info/post/545963